ভাস্কর্য সরানো : একটি ‘হাটহাজারীয়’ আব্দার জনগণের নয়
যতদূর বোঝা যাচ্ছে তাতে সুপ্রিম কোর্টের সামনে ন্যায় বিচারের প্রতীক ভাস্কর্যটি অপসারণে এদেশের তথাকথিত ইসলাম-পসন্দ রাজনৈতিক প্ল্যাটফরমটি একটা ‘পয়েন্ট অব নো রিটার্নের’ দিকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, এই যে রাজনৈতিক প্ল্যাটফরমটির কথা বললাম, তারা আসলে এদেশের রাজনীতিতে সিজারিয়ান বেবি। একেক সময় একেক রাজনৈতিক দল বিশেষ করে দেশের প্রধান দু’টি রাজনৈতিক দল তাদের প্রয়োজনে এদেরকে জন্ম দেয় আবার পরিত্যাগও করে। যেমন ২০১৩ সালে সরকার পতন ও যুদ্ধাপরাধের বিচার ঠেকানোর আন্দোলনে শক্তি অর্জনের জন্য বিএনপি-জামায়াত হেফাজতে ইসলাম নামে একটি সংগঠন ও তার নেতৃবৃন্দকে ঢাকায় নিয়ে আসে। তাদেরকে দলবলসহ ঢাকা নিয়ে আসার জন্য বিএনপি-জামায়াতের বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্ব যেমন মাহমুদুর রহমান একাধিকবার চট্টগ্রামের হাট হাজারী মাদ্রাসা সফর করেন বলে রিপোর্ট প্রকাশিত হয়।
২০১৩ সালের ৫ মে ঢাকায় হেফাজতে ইসলামকে মূলতঃ জড়ো করা হয়েছিল কিংবা পানি পান করানো হয়েছিল নির্বাচিত আওয়ামী লীগ সরকারকে সরানো ও যুদ্ধাপরাধের বিচার বন্ধ করার জন্য। সরকার কঠোরভাবে ২০১৩ সালের ৫ মে’র সেই সমবেত হওয়াকে সামলায়, বড় কোনো রক্তপাত ছাড়াই। কিন্তু দিকে দিকে রটানো হয় যে হাজারে হাজারে লাখে লাখে কচি কচি মুসল্লিদের হত্যা করেছে আওয়ামী লীগ সরকার ও তার বাহিনী। ধরা যাক যেদিন যদি হেফাজত আওয়ামী লীগ সরকারকে হটানোয় সফল হতো তাহলে কেমন বাংলাদেশ আমরা পেতাম? আমি নিশ্চিত যে, বাংলাদেশের নাম থাকতো সোমালিয়া, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের পরেই বা এই তালিকার যে কোনো জায়গায়।
শেখ হাসিনা সরকারের কৃতিত্ব এখানেই যে, ২০১৩ সালে দেশকে একটি সম্ভাব্য ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচিয়েছে। কিন্তু একথাও সত্য যে, ২০১৩ সালের ৫ মে ও তার আগে-পরে যে তাণ্ডব দেশবাসী দেখেছে এদেশে তাতে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে দেশবাসী স্বতঃস্ফূর্তভাবেই বৈধতা দিয়েছে। কিন্তু একথা অনেককেই বোঝানো যাবে না। বিশেষ করে এদেশের সাবেক ও বর্তমান বামধারার নেতা, কর্মী ও সমর্থকদের। আর যারা বামধারা থেকে বকেয়া হয়ে পঁচে হেজেমজে গিয়েছে, তারাতো এখন হেফাজতের বি-টিম হয়ে এদেশে টিকে আছে, একমাত্র আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনা-বিরোধী হয়ে। কিন্তু হেফাজতে ইসলাম নামক রাজনৈতিক প্রয়োজনে সৃষ্টি করা রাজনৈতিক প্ল্যাটফরমটির সঙ্গে আওয়ামী লীগের সম্পর্ক তৈরি হলো কেন? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে আমরা চলমান ভাস্কর্য সরানোর প্রসঙ্গে যাবো। ২০১৩ সালের ৫ মে যে ‘বালা-মুসিবতের’রূপ ধরে হেফাজত শিশুদের পর্যন্ত ঢাকায় হাজির করেছিল তা যেমন ছিল প্রচণ্ড এক আতঙ্কের বিষয়, তেমনই ভোটের রাজনীতিতে এই প্ল্যাটফরমটির ভবিষ্যত ‘নিয়ামক’ হয়ে ওঠার আলামতটিও স্পষ্ট হয়েছিল সেদিনই।
আমি মনে করি যে, স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসন জারি ও দেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর এই হেফাজতে ইসলামের ৫ মে’র ঘটনা ‘প্যারাডাইম শিফট’ বা অত্যন্ত ‘মোড় ঘোরানো’ ঘটনা। জিয়াউর রহমান যুদ্ধাপরাধীদের ফিরিয়ে এনে বহুদলীয় গণতন্ত্রের নামে তাদের হাতে রাজনীতি ফিরিয়ে দিয়ে এবং সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতাকে বিদায় করে দিয়ে যেমন দেশটিকে একটি ‘হাঁসজারু’ ধরনের আধা-ধর্মতন্ত্রের পথে এগিয়ে দিয়েছিলেন তেমনই হেফাজতের ৫ মে ২০১৩-র সমাবেশ বাংলাদেশের এক শ্রেণির মানুষকে আশাবাদী করেছে একটি পূর্ণ ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার স্বপনে, একই সঙ্গে বাংলাদেশের গণতন্ত্রকামী, ধর্মনিরপেক্ষ, অসাম্প্রদায়িক শক্তিকে বুঝিয়ে দিয়েছে যে, এদেশে আসলে উগ্র রাজনৈতিক ধর্মের সঙ্গে সাধারণ, স্বাভাবিক, গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক বিশ্বাসের সঙ্গে একটি প্রবল রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ একেবারেই আসন্ন হয়ে পড়েছে।
আমার বিশ্বাস আওয়ামী লীগ ও তার নেতৃবৃন্দ এই শেষোক্ত অবস্থানে নিজেদের দেখেন এবং সে কারণে হেফাজতে ইসলামের নেতৃবৃন্দকে জমি-অর্থ-ক্ষমতা দিয়ে তোয়াজ করে তাদেরকে বসে রাখার চেষ্টা করে গেছেন। এতে তাদের রাজনৈতিক লাভের কথাও হয়তো তারা ভেবেছেন, কিন্তু উগ্র ধর্মবাদ যখন রাজনৈতিকভাবে উচ্চাভিলাষী হয়ে ওঠে তখন তাদের কোনো লোভ বা নজরানা দিয়ে ঠেকানো গেছে পৃথিবীতে এমন নজির আছে বলে আমার অন্ততঃ জানা নেই। পাকিস্তানের মতো রাষ্ট্র ভেবেছিল যে, মুফতি-মাওলানা-আল্লামাদের সঙ্গে মিলিটারিকে মিলিয়ে দিয়ে পাকিস্তানকে একটি না-ধর্মরাষ্ট্র, না-গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বানিয়ে কাজ চালিয়ে যাবে। কিন্তু এখন যে পাকিস্তান আসলে কে চালাচ্ছে তা নিয়ে বিদেশের গণমাধ্যমও পরিহাস করে বলে যে, দেশটি আসলে নির্ভর করছে তিনটি ‘এ’-র ওপর, আর এই ‘এ’-গুলো হচ্ছে “আল্লাহ্, আর্মি অ্যান্ড আমেরিকা”।
আওয়ামী লীগ তার ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র হারিয়েছে এবং এ বিতর্ক এখন তোলা জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, দলটি কি নিজেদের “ধর্ম সম্মিলনের” অর্থাৎ এদেশে সকল ধর্ম-বর্ণ-বিশ্বাসের মানুষকে নির্বিঘ্নে বসবাস করতে দিতে আগ্রহী কিনা সেটি স্পষ্ট করতে হবে এবং সেটা আগামি নির্বাচনের আগেই। নির্বাচনের আগে দলটিকে এ প্রতিশ্রুতি দিতে হবে যে, ধর্ম সম্মিলনের সফল বাস্তবায়ন ঘটাতেই হবে এদেশে। ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটি এতোটাই এখন প্রশ্নবিদ্ধ যে, এটি বোধকরি এদেশে আর বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। যদি সম্ভব হতো তাহলে দেশের সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে জাতীয় ঈদগাহ্ নিয়ে তো কেউ প্রশ্ন তুলছে না। কিন্তু ওখানে কি সর্বজনীন দুর্গোৎসব বা বড় দিনের পার্টি আয়োজনের অনুমতি পাওয়া যাবে? আমি নিশ্চিত যে, বাংলাদেশের সামরিক আইন-কে বরং মানুষ মেনে নেবে কিন্তু এটি মেনে নেবার সক্ষমতা আমাদের এখনও তৈরি হয়নি, কখনও হবে বলে মনে হয় না।
সুপ্রিম কোর্টের সামনে ভাস্কর্যটি নিয়ে নানাবিধ মন্তব্য শুনি একেক সময়। যেমন, হেফাজতের মুখপাত্র বাবুনগরী বলছেন যে, তারা মূর্তি বা ভাস্কর্যের বিরোধী নন, কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের সামনে একটি নারী মূর্তি থাকবে সেটি তারা মেনে নিতে পারছেন না। তাদের সমস্যা কি নারীতে? নাকি মূর্তিতে? ধরে নিচ্ছি দু’টোতেই। কিন্তু তারা কি এই নিশ্চয়তা দেবেন যে, সুপ্রিম কোর্টের সামনের ভাস্কর্যটি একটি পুরুষের হলে তারা সেটি ভাঙবেন না? না তারা সেটি বলছেন না। প্রশ্ন যদিও সেটি নয়, প্রশ্ন হলো, হেফাজতে ইসলাম যদি নির্দেশ করে দেয় যে, দেশের কোনটি ভাস্কর্য আর কোনটি মূর্তি এবং মূর্তি বা ভাস্কর্য দেশের কোথায় থাকবে আর কোথায় থাকবে না, তাহলেতো এটাই প্রমাণিত হয় যে, ক্ষমতায় না থেকেও তারা আসলে ডি-ফ্যাক্টো ক্ষমতাবান। আমরা দেখেছি যে, সরকার কেবল তাদের জমিজমা, অর্থ দিয়েই তোষণ করছে তা নয়, বরং তাদের দাবিনামা অনুযায়ী পাঠ্যপুস্তকে পর্যন্ত পরিবর্তন আনা হয়েছে। শিক্ষানীতি, নারীনীতি বাস্তবায়নে হেফাজতে ইসলামের বাধাকেই সরকার সবচেয়ে বড় বাধা ধরে নিয়ে তা সম্পূর্ণ বাস্তবায়নে ‘ধীরে চলো’ নীতিতে এগুচ্ছে। কিন্তু এতো করেও হেফাজতের মন আওয়ামী লীগ পাবে?
আগেই বলেছি যে, এদেশে রাজনৈতিক ইসলামকে পুঁজি করে যে বা যারাই রাজনীতি করে তাদের মূল ও প্রধান শত্রু মুক্তিযুদ্ধ আর মুক্তিযুদ্ধের সূত্র ধরেই তার নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও তার নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ। এই সত্য বুঝতে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু আওয়ামী লীগের কিছু আঞ্চলিক নেতা ও কেন্দ্রীয় নেতাদের কেউ কেউ হয়তো এ সত্য বুঝতে পারছেন না বা বুঝলেও আপাতঃ কৌশলের রাজনীতিকে বেছে নিয়েছেন সংকট উত্তরণে। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতি এখন আর ততোটা সরল নেই যতোটা সরল(?) ৫ জানুয়ারি নির্বাচন-পরবর্তী বছরেও ছিল। বিশেষ করে ৫ জানুয়ারি নির্বাচন-পরবর্তী দুর্বল আওয়ামী লীগ সরকারকেও শেখ হাসিনা একক ক্যারিশমা দিয়ে পাঁচ বছর টিকিয়ে দেওয়ার যে সাফল্য দেখিয়েছেন তাতে অনেকেই বিস্মিত, ঈর্ষান্বিত ও নিজেদের রাজনৈতিক ভবিষ্যত নিয়ে সন্ধিহান হয়ে পড়েছেন।
তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিদেশি শক্তিদের শেখ হাসিনা-বিরোধী তথা বাংলাদেশ-বিরোধী তৎপরতা, বিশেষ করে বাংলাদেশ এগিয়ে গেলে যে বা যাদের স্বার্থে বড় ধরনের ব্যাঘাত তৈরি হয় তারা দেশে ও বিদেশে ব্ যুহ বেঁধে তৈরি হচ্ছে। এ বছরের শেষে বা তারও আগে আমরা দেখতে পাবো এই সম্মিলিত আওয়ামী লীগ তথা শেখ হাসিনা-বিরোধী শক্তির সাঁড়াশি আক্রমণ। সে আক্রমণের মুখে দলটির হেফাজত-তোষণ একটি অপূরণীয় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের আওয়ামী লীগ ও হেফাজতের গোপন-সন্তান “আওয়ামী উলামা লীগকে” রাজনৈতিক দোকান আখ্যা দিয়ে তা বন্ধের কথা বলেছেন সম্প্রতি, জানি না একটু দেরি হয়ে গেলো কি না, কিন্তু “বেটার লেইট দ্যান নেভার”, সে কারণে তাকে ধন্যবাদ।
হেফাজতে ইসলামের কাজ এদেশে মূর্তি, ভাস্কর্য, গণতন্ত্র ও অসাম্প্রদায়িকতার বিরোধিতা করা এবং সে জন্য তাদের রাজনৈতিক ইসলামকে ব্যবহার করার ম্যান্ডেটও রয়েছে। তাদের সঙ্গে যারা যুক্ত হয়ে আগামী নির্বাচনে রাজনৈতিক বিজয় অর্জনের স্বপ্ন দেখছেন তারাও মূলতঃ অন্তরে হেফাজতে ইসলাম, বাইরে জামায়াত কিংবা বিএনপি। কিন্তু আওয়ামী লীগকে সে পথে হাঁটতে হবে কেন? দেশের জনগণের ওপর কেন দলটি বিশ্বাস হারাবে? জনগণের গরিষ্ঠ অংশ একাত্তরে প্রমাণ দিয়েছে, নব্বইয়ে প্রমাণ দিয়েছে, ছিয়ানব্বই সালে প্রমাণ দিয়েছে এমনকি ২০১৩ ও ২০১৪ সালেও আওয়ামী লীগকে প্রমাণ দিয়েছে যে, তারা আসলে আওয়ামী লীগের অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক রাজনীতিকেই ভালোবাসে। কোনো নির্দিষ্ট ধর্মের প্রতি ঝুঁকে পড়া আওয়ামী লীগকে নয়। আর সে কারণেই, সুপ্রিম কোর্টের সামনে থেকে ভাস্কর্য সরানোর এই ‘হাটহাজারীয়’ আব্দার ঠেকানোর দায় ও দায়িত্ব আওয়ামী লীগেরই।
যুদ্ধাপরাধের বিচারের মতো এতো বড় একটি দুরূহ কাজ সম্পাদন করতে পারলে এটা করতে পারবে না আওয়ামী লীগ সেটা আমি বিশ্বাস করি না। প্রতি শুক্রবার বায়তুল মোকাররমের সামনে যে বা যারা জড়ো হয়ে মূর্তি সরানোর আব্দার করে তারা কোনো ভাবেই দেশের গরিষ্ঠ জনগণ নয়, তারা মূলতঃ হাটহাজারি ও হাটহাজারি আর আওয়ামী লীগের ‘গোপন সন্তান’ উলামা লীগের লোকজন। আওয়ামী লীগকে বা দলটির নেতৃত্বে গঠিত সরকারকে এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে, তারা হাটহাজারিকে দমন করবে নাকি দেশের গরিষ্ঠ সংখ্যক মানুষের কথা শুনবে।
ঢাকা ১৪ মার্চ, মঙ্গলবার ২০১৪
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।
[email protected]
এইচআর/পিআর