একটি নারী দিবস ও আমাদের নিরন্তর লড়াই
সেই কবে থেকে নারীদিবস পালন করে আসছি আমরা! এই এতো বছরে নারী দিবসের জন্য বেগুনী শাড়ির চল যতটুকু দৃশ্যমান হয়েছে, থিম পরিবর্তন হয়েছে, ততটুকু দৃশ্যমান কি হয়েছে নারীর আন্দোলন, লড়াই সংগ্রাম আর ইউনিটি? এই যে এতো বছরের নারী দিবস উদযাপনের ইতিহাস, তাতে কি আমাদের লড়াইয়ের ক্ষেত্র কিছুটা কমেছে? কিছু পুনঃনির্মাণ কি হয়েছে নারীর জন্য? নারী দিবসের আয়োজনকে সামনে রেখে এই প্রশ্নগুলো আমরা আলোচনা করতে চাইছি যখন, ঠিক তখনই অন্যপক্ষ থেকে যথারীতি সেই পুরুনো প্রশ্নগুলোও বারবার সামনে আসছে, “আমাদের লড়াই আসলে কার সাথে? আমরা আসলে কী চাই? আমরা কি পুরুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছি?...”
আসুন অন্যভাবে ভাবি। আমাদের লড়াই কার সাথে সে প্রশ্ন না করে বলুন আমাদের লড়াই কার সাথে নয়? আমাদের এতো রাগ কেন, সেই প্রশ্ন না করে বরং বোঝার চেষ্টা করুন রাগ না হওয়ার মতো কী ঘটেছে আমাদের সাথে? একটা বেগুনি রঙের নারী দিবস, সংসদে কিছু সংরক্ষিত আসন, পুরুষতান্ত্রিক বিধি বিধানের কিছু আইন, চাকরিতে প্রতিবন্ধী কোটার মতো বিশেষ কোটা, বাসের ক’টা রিজার্ভ সিট, স্বামীর দয়ায় একটা সাপ্লিমেন্টারি কার্ড বা অতিদূর একটা ফ্ল্যাটের দলিল দিয়েই ভাবছেন সব ঠিক হয়ে গেছে? ঠিক যেমন ‘আর কত চাই তোমার’!! এই রাজনীতি কি এতো সরল? “অধিকারবোধ বা চেতনার জাগরণ সীমান্ত পেরোনোর মতো নয় যে, এক পা এগুলেই তুমি অন্যদেশে। নারী যতদিন নিজের কথা নিজে না লিখবে, যতদিন নিজের প্রথা নিজেই না তৈরি করবে, যতদিন আমরা দূরত্বে থেকে দেখার চেষ্টা করবো, ততদিন মেয়েদের বাস্তব অবস্থার সাথেই বিশ্বাসঘাতকতা করা হবে” (অ্যাড্রিয়েন রিচ)।
যে কোন অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে প্রতিপক্ষ নিশ্চিত করতে হয়। পিতৃতান্ত্রিক সভ্যতার প্রথম শোষকশ্রেণি ‘পুরুষ’ আর প্রথম শোষিতশ্রেণি ‘নারী’, সুতরাং লড়াইটা এই দুই শ্রেণির মধ্যেই। তাই নারীর অধিকার আদায়ের সংগ্রামের ও নিশ্চিত প্রতিপক্ষ হলো সেইসব পুরুষ বা নারী, প্রথা-নিয়ম-কানুন, আইন, ধর্ম, ভাষা, সাহিত্য, বিজ্ঞাপন, চলচিত্র, যা পুরুষতন্ত্রের ক্ষমতা আর আধিপত্যের জমিনকে পোক্ত করে। এখানে গোপনীয়তার কিছু নেই। এটা খুবই পরিষ্কার, এ লড়াইটি দুটো মতাদর্শ ও বিশ্বাসের মধ্যে, দুটো মানুষের মধ্যে নয়। এর একদিকে রয়েছে যারা নারী-পুরুষের মধ্যকার বৈষম্য ও উঁচু-নিচু ধারণাকে বাতিল করে সমতা, সমতার সমাজ গড়তে চায়; আর অন্যদিকে রয়েছে যারা বিদ্যমান অবস্থা বজায় রাখার জন্য নারী নিপীড়নকে যে কোন ধরনের যুক্তি দিয়ে জাস্টিফাই করে, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে ভিক্টিমকে ব্লেইম করে থাকে।
পরিবারে, সমাজে, প্রতিষ্ঠানে, রাজনৈতিক দলে পিতৃতন্ত্রেরই জয়গান, সেখানে নারীর মর্যাদার প্রশ্নটি অনেক ক্ষেত্রেই উপেক্ষিত। ধর্মের বইতে এই বৈষম্যের শুরু আর আইনে তার প্রতিধ্বনি। আমরা আইনের বৈষম্যগুলো দূর করতে চাই যেখানে ‘মা’ কে তার গর্ভজাত সন্তানের অভিভাবকত্বের অধিকারটুকু দেয় না, সম্পত্তিতে নারী-পুরুষের সমান অধিকার স্বীকার করেনা, যে আইনের প্রক্রিয়ায় ধর্ষণের জন্য ধর্ষিতাকে দ্বারে দ্বারে ঘুরে বারবার ধর্ষিত হতে হয়। আমাদের নিজস্ব আন্দোলন, নিজস্ব রাজনীতি দিয়ে আমরা লড়াই করি মৌলিক অধিকারের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ সব আইন পরিবর্তন, সংশোধন ও নারীবান্ধব আইন তৈরি করার জন্য।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে এটাই সত্যি যে, আমরা যখন বিশ্বব্যাপী নারী নির্যাতন, সহিংসতা, নিপীড়ন এবং বৈষম্য নিয়ে লিখি, তার প্রথম আঘাতটা পুরুষের ঘাড়েই পড়ে। কারণ নারীকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য পুরুষতান্ত্রিক এসব নিয়মের জন্ম দিয়েছে পুরুষ এবং সেসবের সুবিধা নিয়ে এসব নির্যাতন আর বৈষম্য পুরুষের হাত দিয়েই ঘটে। যেমন, নারীকে ধর্ষণ করে একজন পুরুষ, নারীকে এসিডে ঝলসে দেয় একজন পুরুষ, নারীকে কোপায় একজন পুরুষ, নারীর চরিত্রহনন করে একজন পুরুষ। শিশুমেয়ে বিয়ে করে একজন পুরুষ, যে পিতা কন্যাসন্তানকে জীবন্ত কবর দিত, সেও একজন পুরুষ। দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত এমন কোন ক্ষেত্র নেই যেটি পুরুষ তার নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নারীর বিরুদ্ধে ব্যবহার করেনি।
আমরা সেই নারীদেরও সমালোচনা করি, সেই সব নারীদের সাথেও আমাদের লড়তে হয় যারা পুরুষতন্ত্রের পার্পাস সার্ভ করতে গিয়ে নারীবাদ আন্দোলনকে বিতর্কিত করে, নারীবাদ আর মানবতাবাদের বিতর্ক জুড়ে দিয়ে বিভাজন তৈরি করে, শুদ্ধ-অশুদ্ধ, তাত্ত্বিক বা ব্যবহারিক নারীবাদের ধোয়া তুলে নারীদের বিভক্ত করে। আমাদের শক্তিক্ষয় করতে হয় সেই নারীদের পেছনে, যারা পুরুষতন্ত্রের ভাষায় কথা বলেন, পুরুষের পক্ষ হয়ে অধিকারকামী নারীদের আক্রমণ করেন, পুরুষতন্ত্রের সুবিধা নিয়ে সমাজের মনমতো ‘আদর্শ’ তৈরি করেন, নিজেদের মতো করে সেই আদর্শের ব্রান্ডিং করেন এবং পুরুষের তৈরি বৈষম্যমূলক নিয়ম ও শাসনের ভিত্তি পাকা করেছেন।
আমাদের লড়তে হয় সেই ভাষা ও সাহিত্যের বিরুদ্ধে যা পুরুষের শ্রেষ্ঠত্ব বহন করে এবং নারীকে হেয় করে। আমরা সেই ভাষা পুনঃনির্মাণের কথা বলি, যে ভাষার রাজনীতি ‘বেশ্যা-পতিতা-খানকি-ছিনাল-বনিতা-ভ্রষ্টা-কুলটা-বন্ধ্যা–মাগী-ব্যাভিচারীনি, দ্বিচারিনি’ এরকম হাজার একপেশে শব্দ তৈরি করে নারীকে কলঙ্কিত করেছে। আমরা চাই নারী তার চারিত্র্যিক নিপীড়নের ভাষাকে চ্যালেঞ্জ করে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলুক ‘পতিত’ ‘রক্ষিত’ ‘ভ্রষ্ট’ ‘নষ্ট’ হতে পারে পুরুষও। পতিতা বলে যদি নারীর চরিত্র হনন করা হয় তবে ‘জিগোলো’ শব্দটি পরিচিত করা হোক, যৌন সেবা দেয়া ‘চরিত্রহীন’ ‘পতিত’ পুরুষদের জন্য।
আমরা নারী ও পুরুষের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে চাই, প্রেমের নামে পুরুষতান্ত্রিক সাহিত্য ও কবিতা কিভাবে নারীর উপর পুরুষের প্রভুত্বের বর্ণনা করেছে, “সুরঞ্জনা, ওইখানে যেওনাকো তুমি/বলোনাকো কথা ওই যুবকের সাথে”। শুধু পুরুষ নয়, পুরুষতন্ত্রে মেয়েদের মনস্তত্ব এমন করে গড়ে তোলা হয় যে, কবিতায় বা সাহিত্যে নারীরা শুধু পুরুষকেই খুঁজে বেড়ান, “আমাদের দেশে কবে সেই ছেলে হবে”। আমরা তাই এই সাহিত্যের নতুন নির্মাণ করে বলি, “আমাদের দেশে কবে সেই মেয়ে হবে...” অথবা, “যাবোনা কেন? যাবো”।
নারীর জন্য একটি মানুষের পৃথিবী নির্মাণ করার জন্য আমাদের লড়তে হয় পুরুষতন্ত্রের সৌন্দর্যের রাজনীতির ও পুঁজিবাদী সৌন্দর্য ব্যবসার সাথে। যে রাজনীতি মেয়েদের এন্টিএইজিং, ওয়েক্সিং, ফেসিয়াল, জিরো ফিগার, ট্রেডমিল, সিলিকন ব্রেস্ট এ ব্যস্ত রেখে ভুলিয়ে রাখে নিজের অধিকার বোধ থেকে, যেন তারা নিজেদের রোজগার, মেধা, সময়, সবকিছু ওই সৌন্দর্য চর্চার পেছনে খরচ করে স্বনির্ভরতার চিন্তা থেকে দূরে থাকে। যেখানে পুরুষতন্ত্র নারীকে বেঁধেছে চুলের মসৃণ শেকলে, যে শেকল সাজাতে জীবন যায় মেয়েদের। চুলের যত্ন করে, বিনুনি গেঁথে, বাহারী খোপা বেঁধে, সময় কাটিয়ে নারী দূরে থাক উৎপাদনশীলতা থেকে, নিজের রোজগারের টাকা উড়িয়ে দিক সেক্সি হেয়ার স্টাইলের পেছনে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় চলে যাক বিউটি সেলুনে আর পুরুষ এই ফাঁকে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে থাকুক এবং আরো যোগ্য করে তুলুক, নিজের মোটা পকেট আরো মোটা করতে থাকুক, আরো বেশি রোজগারে মন দিক, স্বপ্নকে আরো উঁচুতে নিয়ে যাক।
আমাদের লড়াই করতে হয় পুরুষতান্ত্রিক গণমাধ্যম ও বিজ্ঞাপনের সাথে যেখানে নারী মানেই বাথরুম ক্লিনার, কাপড় ধোয়া, পরিষ্কার না হলে স্বামীর ঝাড়ি খাওয়া, ডিস ওয়াস, রান্না করা, পাশে দাঁড়িয়ে থেকে পুরুষকে খাওয়ানো। নারীকে দেখানো হয় স্বামীর সকাল বেলার খবর পড়ার আয়েশ নষ্ট করে খুন্তি হাতে বাজারে যাওয়ার তাগাদা দিতে থাকা দজ্জাল বৌ হিসেবে! বেবি ফুড বা টয়লেট্রিস এর বিজ্ঞাপনে বার্তা দেয়া হয় যে শিশুর স্বাস্থ্য ও আরামের জন্য মাকেই সব কিছু করতে হয়, “ছোট্ট সোনামনিকে ভালো বোঝে মা আর জনসন”…ব্যস! বাবার কোন দায়ই নেই বাচ্চাকে বোঝার!! হেলথ ড্রিংক এর বিজ্ঞাপনে ছেলেদের সম্পর্কে বলা হয় ‘শক্তির পাওয়ার’ আর মেয়েদের সম্পর্কে বলা হয় ‘পুষ্টির পাওয়ার’। সার্ফ এক্সেল এর বিজ্ঞাপনে দেখাচ্ছে অনেক লোকের ভীড়, কাঁটাতার পেরিয়ে হিরোর অটোগ্রাফ আনতে পেরে ভাইটি বোনের চোখে রিয়েল ‘হিরো’ হয়ে যায় আর বোনটি হতাশায় ভেঙে পড়ে বলে, “আমি কোনদিন অটোগ্রাফ পাবোনা”!
এ লড়াই এক দীর্ঘযাত্রা পথের শেষবিন্দু হয়ে আছে এখনো। পুরুষতান্ত্রিক রাজনীতি যেভাবে নারীকে নিপীড়ন করেছে এতোকাল, তাকে অতিক্রম করে গড়ে উঠছে আজকে আমাদের নিজস্ব আন্দোলন, আমাদের নিজস্ব রাজনীতি। অবধারিতভাবেই এই রাজনীতির পথ কণ্টকময়, কলঙ্কিত, এবং বন্ধুর। কিন্তু নতুন প্রাণের আবির্ভাবের জন্য পুরোনো বীজকে ভাঙতে হয়, যে বীজ ভাঙেনা, বা শস্য জন্মের জন্য নিজে ধ্বংস হয় না, তা মৃতবীজ। বেদনা ছাড়া সন্তান প্রসব হয় না। এ কথা জেনেই আমরা পরিবর্তনের এই লড়াইয়ের যন্ত্রণাকে স্বীকার করে নিয়েছি। একদিন নারীদিবস আসবে প্রাপ্তির ফসল কাটার কাস্তে নিয়ে, সেই দিনের জন্য এই বেদনাকে আমরা বারবারই আলিঙ্গন করতে চাই।
লেখক : কলামিস্ট।
এইচআর/আরআইপি