ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

সুপবন থামিয়ে দেয়া?

প্রকাশিত: ০৫:৩৮ এএম, ০৪ মার্চ ২০১৭

বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে অনেকদিন ধরে সুপবন বইছে। অনুকূল পরিবেশের দাক্ষিণ্যে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মেয়েরাও সামাজিক শক্তির সাহায্যে বাবা-মা, অভিভাবক, পরিবারের চাপ উপেক্ষা করে বাল্যবিবাহের অভিশাপ হতে নিজেদের মুক্ত করে পড়াশোনার পথে এগিয়ে চলেছে। কিন্তু তাদের সেই এগিয়ে চলায় সহযোগী নয়, বাধা হিসেবেই এগিয়ে এলো রাষ্ট্র।

সম্প্রতি জাতীয় সংসদে ‘বিশেষ প্রেক্ষাপটে’ বিয়ের বয়সসীমা শিথিল করে বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন পাস হয়েছে। সংসদে উত্থাপিত বিলে বিশেষ বিধান সম্পর্কে বলা হয়েছিল, “এই আইনের অন্যান্য বিধানে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, কোনো বিশেষ প্রেক্ষাপটে অপ্রাপ্তবয়স্ক কোনো নারীর সর্বোত্তম স্বার্থে আদালতের নির্দেশনাক্রমে এবং মাতা-পিতার সম্মতিক্রমে বিধি দ্বারা নির্ধারিত প্রক্রিয়া অনুসরণক্রমে বিবাহ সম্পাদিত হইলে উহা এই আইনের অধীন অপরাধ বলিয়া গণ্য হইবে না।”

যদিও নতুন এই আইনকেও নিরোধ আইন বলা হচ্ছে বাস্তবে দেশে এখন বাল্যবিবাহ নিরোধ করার মতো আইন আর থাকলোনা। যে কেউ যে কোন মেয়েকে যখন তখন বিয়ে দিয়ে দিতে পারবে। মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের পর দেশের নারী সংগঠনগুলোর পাশাপাশি হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো বিলটি পাস না করতে বাংলাদেশের আইনপ্রণেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে আসছিল। এই আপত্তির মধ্যেই ‘বাল্যবিবাহ নিরোধ বিল-২০১৭’ সংসদে পাসের প্রস্তাব করেন মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি। কণ্ঠভোটে এটি পাস হয়ে যায়। না হওয়ারও কোন কারণ নেই। কারণ এই সংসদ পুরোটাই প্রায় সরকারি দলের।

বাংলাদেশে বাল্যবিবাহের হার ৬৬ শতাংশ। ১৮ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই তাদের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। এর অধিকাংশই মেয়েশিশু। অর্থাৎ গড়ে প্রতি তিনটি বিয়ের মধ্যে দুইটিই বাল্যবিয়ে। এর অনিবার্য পরিণতি মেয়েদের অকালমাতৃত্ব। সমাজ এগিয়ে চলে প্রগতির পথে। কিন্তু আমরা কেবলই পেছনে হাঁটি। ১৯২৯ সালের আগের আইনে যেখানে মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৮ বছর রাখা হয়েছিল, সেখানে ২০১৬ সালে এসে আইনে ‘বিশেষ বিধান’ রেখে ১৮ বছরের কম বয়সের মেয়েদের বিয়ে জায়েজ করা হলো।

‘বিশেষ পরিস্থিতির’ জন্য এই বিধান রাখা হয়েছে। ১৮ বছরের নিচে বিয়ে হলে তা অপরাধ; তবে ‘বিশেষ কেইসের’ ক্ষেত্রে তা হবে না। তবে আইনে ‘বিশেষ প্রেক্ষাপটের’ কোনো সংজ্ঞা রাখা হয়নি। এখানেই আইনটি বাল্যবিয়ে রোধ করার পরিবর্তে তাকে আরো উৎসাহিত করবে বলে মনে হচ্ছে।

‘বিশেষ বিধান’ রেখে আইন প্রণয়ন করা মানেই আইনি ভিত্তিকে দুর্বল করে দেয়া। নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে যে অগ্রগতি নিয়ে আমাদের এতো গর্ব, তা থেকে পিছিয়ে যাওয়ার আয়োজন এই বিশেষ বিধান। এর কারণে অপরিণত বয়সে সন্তান ধারণের কারণে বাড়বে মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর হার। বাড়বে নারী নির্যাতন। বাধাগ্রস্ত হবে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) অর্জন।

মেয়েদের বাল্যকালে বিয়েতে বাধ্য করা এদেশের এক শতাব্দী-প্রাচীন সমস্যা। এর জন্য দায়ী দারিদ্র্য, অশিক্ষা ও লিঙ্গবৈষম্য। সরকারি প্রচেষ্টায় মেয়েরা আজ শিক্ষায় অনেকদূর এগিয়ে। কিন্তু তবুও গ্রামেগঞ্জে, শহরাঞ্চলেও বাবা-মা ও অভিভাবকদের একটা বড় অংশ মনে করেন মেয়েদের শিক্ষার জন্য টাকাপয়সা খরচ করা মানে অপচয়। তার চেয়ে বরং অল্প বয়সে পাত্রস্থ করতে পারলে সংসারে এক জনের অন্ন খরচ কমে। একটা বড় ভাবনা হলো বিয়ে দিতে দেরি করা মানেই পাত্রীর চাহিদা কমে যাওয়া ও পাশাপাশি আছে যৌতুকের চাপও। তাই তাদের বিবেচনায় মোটামুটি ভাল পাত্র পাওয়া মাত্রই আর দেরি করতে চান না অভিভাবকরা।

অকুতোভয়ে কত মেয়ে কত কষ্ট আর দুঃসাহসের সাথে নিজের পায়ে দাঁড়াবার সংগ্রাম করছে। দারিদ্র্যের বাধ্যতা, পরিবারের বাধা, সমাজের রক্তচক্ষু অগ্রাহ্য করে এমনকি বিয়ের আসর থেকে সাহসী কন্যারা উঠে আসছে শিক্ষার জগতে। না, এর পিছনে কোনো সমাজ-সংস্কারক নেই, আন্দোলন নেই, কোনো এনজিওর প্রেরণাও নেই। আছে ওই কিশোরীদের স্বাবলম্বী হবার দুর্মর তাগিদ, পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে বিকশিত হওয়ার দাবি। কিন্তু তাদের সব কিছুকে আজ দমিয়ে দিতে পারে এই বিশেষ বিধান রাখা আইন।

আইন পাশ হয়ে গেছে। অনেক অনুরোধ করেও সরকারকে পেছানো যায়নি। কি কারণে এই আইন করতে সরকার আগ্রহী হলো তা পরিষ্কার হলোনা কোনোভাবেই। আজ বিশেষ বিধানের নামে বাঁধন হাল্কা হবার আশংকা রয়েছে। আর তা যদি একবার শুরু হয় তাহলে এই সাহসিকাদের বিরুদ্ধে একজোট হবে পুরো পুরুষ সমাজ, গ্রামে, শহরে সর্বত্র। বাল্যবিয়ে মানেই ধর্ষণকে বৈধতা দেয়া। ১৮ বছরের আগে বিয়ে মানেই হলো দিনের পর দিন একটি মেয়েকে নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে স্বামীর যৌন নির্যাতনের শিকার হতে দেয়া। এমনিতেই আমাদের সামাজিক কাঠামোতে বড় সমস্যা আছে। তার উপর একবার যদি আইনি সমর্থন পাওয়া যায়, তবে আরো বেশি দুর্বিনীত হয়ে উঠবে এক শ্রেণির পুরুষ।

দেশ জুড়ে মেয়েদের ওপর বেড়ে চলা যৌন-হিংসার জেরে, সর্বত্র মেয়েদের, বিশেষত অল্পবয়সী মেয়েদের, পথেঘাটে বেরোনোর আত্মবিশ্বাসে অনেকটাই ফাটল ধরেছে। নতুন আইন অনুযায়ী ইভটিজিংয়ের শিকার মেয়েদের দ্রুত বিয়ের আয়োজন করবেন বাবা-মা’রা এবং তারা ব্যবহার করবে এই বিশেষ বিধান রাখা আইন। যখন প্রয়োজন নিরাপত্তার অভাবে ভুগতে-থাকা মেয়েদের মনে সাহস জোগানো, তখন এমনটাই ঘটতে চলেছে আগামী দিনগুলোতে।

আমাদের পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় ছেলে ও মেয়েদের ছোট থেকেই আলাদা সামাজিকীকরণ হয়। কোনো মেয়ে যৌন হেনস্থার শিকার হলে বেশির ভাগ সময় তার উপরই অপরাধের দায় চাপানো হয়। এমন এক সমাজে, সচেতন সরকার কি করে আইনের মাধ্যমে সুযোগ করে দেয় দুষ্টচক্রকে? প্রশ্ন আছে, উত্তর নেই।

লেখক : বার্তা পরিচালক, একাত্তর টিভি।

এইচআর/এমএস

আরও পড়ুন