কিল মারার গোসাই
গ্যাসের দাম বাড়ানো নিয়ে হইচই হচ্ছে খুব। প্রতিবাদে হরতালও ডাকা হয়েছে। এটা ঠিক, যৌক্তিক হোক আর অযৌক্তিক, বাংলাদেশে যে কোনো জিনিসের দাম বাড়লেই হইচই হয়, প্রতিবাদ হয়। মাটির নিচের গ্যাস আমাদের জন্য প্রকৃতির আশীর্বাদ। তবে প্রাকৃতিক গ্যাস অফুরন্ত নয়। অপ্রয়োজনে পুড়িয়ে ফুরিয়ে ফেললে, পরে আমাদের হায় হায় করতে হবে। তাই গ্যাস সম্পদের সর্বোচ্চ সুব্যবহার নিশ্চিত করা আমাদের সবার দায়িত্ব। আর সরকারেরও তো দেশ চালানোর জন্য টাকা লাগবে, সেটা ট্যাক্স থেকে হোক, ভ্যাট থেকে হোক, এমনকি গ্যাস বেঁচে হোক। তবে সরকার ব্যবসায়ী নয়। লাভ করা নয়, তাদের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত জনগণের কল্যাণ।
গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানো বা সমন্বয় করা একটি চলমান প্রক্রিয়া। তবে নিত্য ব্যবহার্য তেল-গ্যাস-বিদ্যুতের দাম সমন্বয়ের আগে প্রতিক্রিয়ার বিষয়টি ভাবা উচিত। দাম সমম্বয়ের সুফল বা কুফল জনগণের ওপর কতটা পড়বে, কত বেশি মানুষ লাভবান হবে বা ক্ষতিগ্রস্ত হবে; বিবেচনায় নিতে হবে সেটাও। একসময় জ্বালানি তেলে বাংলাদেশকে বিপুল ভর্তুকি দিতে হতো। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমে যাওয়ায় সরকার এখন আগের ক্ষতি পুষিয়ে বিপুল লাভ করছে। বিভিন্ন মহলের দাবির মুখে সরকার একবার জ্বালানি তেলের দাম নামকাওয়াস্তে কমিয়েছে। কিন্তু তখন আমি দাম কমানোর প্রতিবাদ করেছিলাম। কারণ জ্বালানি তেলের দাম, কমানোতে সরকারের কিছু লস হয়েছে। কিন্তু জনগণ তার কোনো সুফল পায়নি। তার মানে জ্বালানি তেলের দাম কমানোর সুফলটা হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে।
আমি দাম কমালেই খুশি হওয়া, বাড়ালেই বেজার হওয়ার দলে নই। দাম সমন্বয়ের যুক্তিটা আমি বোঝার চেষ্টা করি। যতটুকু বুঝেছি, গ্যাসের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্তটি আমার কাছে যৌক্তিক মনে হয়নি। অন্য অনেক খাতে সরকারের লস হলেও গ্যাস খাতে লাভ হয়। কিন্তু লাভ হয় বলেই প্রাকৃতিক এই সম্পদ পানির দামে বিলিয়ে অপচয় করতে হবে, এমন ধারণার সাথেও আমি একমত নই।সরকার অনেক চালাক। একবারে দুই দফায় দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। একদফা ১ মার্চ থেকে, দ্বিতীয় দফায় বাড়বে ১ জুন থেকে। আন্দোলন, বিক্ষোভ, হরতাল যা হওয়ার তা তো একবারেই হবে।
গ্যাসের দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে বিবেচনাটা হওয়া উচিত, এতে সরকারের কত লাভ হবে আর কত বেশি মানুষের ওপর এর প্রভাব পড়বে। এবার সব ক্ষেত্রেই গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে। তাই সাধারণ মানুষের ওপর এর প্রভাবটা হবে বহুমুখি এবং ব্যাপক। বিদ্যুতের দাম যে আবার বাড়ছে, ইতিমধ্যেই সে ঘোষণা দিয়েছেন বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী। শিল্পে খরচ বাড়বে, যার প্রভাব পড়বে সাধারণ মানুষের ওপর। জ্বালানি তেলের দাম কমলে যানবাহনের ভাড়া কমে না। কিন্তু সিএনজির দাম বাড়লে যে যানবাহনের ভাড়া বাড়বে, এটা অবশ্যম্ভাবী। তবে ব্যক্তিগত গাড়িতে সিএনজি ব্যবহার বন্ধের পক্ষে আমি। তাতে গাড়ির ব্যবহার কমবে, কমবে যানজটও।
গ্যাসের দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হয় গৃহস্থালীর দাম নিয়ে। কারণ এর সরাসরি প্রভাব পড়বে ঘরে ঘরে। দেশে এখন ২৭ লাখ আবাসিক গ্রাহক পাইপলাইনে গ্যাস সুবিধা পান। প্রত্যেক ঘরে গড়ে ৫ জন মানুষ থাকলে এর সুবিধাভোগী ১ কোটি ৩৫ লাখ। বাস্তবে এ সংখ্যা অনেক বেশি। কারণ অনেক ঘরে মানুষ বেশি, অনেক মেসে এক চুলা অনেকে ব্যবহার করেন। ২৭ লাখ গ্রাহককে গড়ে ৫০০ টাকা করে বাড়তি দিতে হলে তাতে সরকারের বাড়তি আয় হবে ১৩৫ কোটি টাকা। কিন্তু মাত্র ১৩৫ কোটি টাকার জন্য ২৭ লাখ পরিবারকে দুর্ভোগে ফেলা কল্যাণমূলক সরকারের লক্ষণ নয়।
আবাসিক গ্রাহকদের বিরুদ্ধে একটা বড় অভিযোগ, তারা গ্যাসের অপচয় করেন, একটা ম্যাচের কাঠি বাঁচানোর জন্য চুলা জ্বালিয়ে রাখেন, গ্যাসের চুলায় কাপড় শুকান। এই অভিযোগগুলো মিথ্যা নয়। কেউ কেউ হয়তো করেনও। গ্যাসের দাম বাড়ানোর পর তো একজন ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে ঘোষণা করেছেন, এখন থেকে সব কাপড় তিনি গ্যাসের চুলায় শুকাবেন। তবে কেউ কেউ অপচয় করেন বলে, এর দায় সবার ওপর চাপানো ঠিক নয়। আর দাম বাড়িয়ে অপচয় রোধ করা সম্ভব নয়। এটা নিশ্চিত করতে হলে মিটারের ব্যবস্থা করতে হবে। যার যত ব্যবহার, তার বিল তত।
যেহেতু মাত্র ২৭ লাখ পরিবার পাইপলাইনে গ্যাসের সুবিধা পান। আর এই সুবিধাভোগীরা বেশির ভাগই শহুরে। তার মানে দেশের সিংহভাগ মানুষ এই সুবিধার বাইরে। তাই গৃহস্থালী গ্যাসের দাম বাড়লে সুবিধার বাইরে থাকা মানুষ খুশি হন। সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আর কাউকে পাইপলাইনে গ্যাস দেয়া হবে না। সবাইকে সিলিন্ডারের গ্যাস ব্যবহার করতে হবে। কিন্তু সিলিন্ডারের গ্যাসে খরচ অনেক বেশি। দাম বাড়ার পরও ২ চুলায় খরচ হবে ৯৫০ টাকা। আর সিলিন্ডারে এই খরচ ২ হাজার টাকার বেশি। গৃহস্থালী গ্যাসের দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে এটাও একটা যুক্তি, বৈষম্য কমিয়ে আনা, ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা। আহা যেন, দেশের অন্য সব ক্ষেত্রে বৈষম্য দূর হয়ে গেছে, শুধু পাইপলাইনে গ্যাসের দাম বাড়ালেই যেন ন্যায় প্রতিষ্ঠা হয়ে যাবে। চাইলে তো সিলিন্ডারের গ্যাসের দাম কমিয়েও বৈষম্য কমানো সম্ভব ছিল। কিন্তু প্রায় দেড় কোটি মানুষের পকেটে চাপ দেয়া যত সহজ, সিলিন্ডার ব্যবসায়ীদের ওপর চাপ দেয়া তত সহজ নয়।
ইদানিং পত্রপত্রিকায় সবচেয়ে বেশি নিউজ হয় গ্যাসের চাপ নিয়ে। ঢাকার একটি বড় অংশে দিনের একটা বড় সময় গ্যাস থাকে না। গ্যাস যদি নাই থাকে, তাহলে বাড়তি দাম কেন দেবে মানুষ। আগে তো ভাতটা দেন, তারপর কিলটা মাইরেন।
২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭
[email protected]
এইচআর/জেআইএম