ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

বায়ু দূষণ ও ঝুঁকিপূর্ণ ভবিষ্যত

প্রকাশিত: ০৪:০৩ এএম, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

খাবার, পানি আর বাযু ছাড়া জীবজগতের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। যদিও খাবার বা পানি ছাড়া আমরা বেশ কিছুদিন বেঁচে থাকতে পারি। কিন্তু বায়ু ছাড়া  দিন, ঘণ্টা দূরে থাক; আমরা সর্বোচ্চ তিন মিনিট  অবধি বেঁচে থাকতে পারি। ফলে নির্মল বাযুসেবন প্রতিমুহূর্তের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়- যা আমরা একদমই অস্বীকার করতে পারি না।

খাবার এবং পানি আমরা অর্থমূল্যে কিনে থাকি। কিন্তু জীবনধারনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বায়ু আমরা প্রকৃতি থেকে গ্রহণ করি ইচ্ছেমতো। কোনরকম টাকা-পয়সার বিনিময় ছাড়াই। বাতাস থেকে আমরা  যে অক্সিজেন গ্রহণ করি  তা শরীরের বিপাক ক্রিয়ার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। আবার কার্বনডাইঅক্সাইড ছেড়ে দিয়ে আমরা শরীরকে দূষণমুক্ত রাখি। কিন্তু দুঃখজনক এবং আতঙ্কজনক ব্যাপার হচ্ছে, যে বাতাস আমরা বুক ভরে নিয়ে থাকি তা ধীরে ধীরে বিষময় হয়ে উঠছে। এতদিন  শুনতাম খাদ্যে ফরমালিন নামক বিষের উপস্থিতি। এখন শুনছি বাতাসে নানাধরনের বিষাক্ত উপাদানের উপস্থিতির কথা। বায়ুদূষণের ঝুঁকিপূর্ণ তালিকায় আমাদের রাজধানী ঢাকার অবস্থান নাকি এখন দ্বিতীয়! কি ভয়াবহ ব্যাপার-একবার ভাবুনতো!

এমন  আতংকজনক তথ্য উঠে এসেছে এবার  প্রকাশিত বৈশ্বিক বায়ু পরিস্থিতি-২০১৭ নামক প্রতিবেদনে যা গত ১৫ ফেব্রুয়ারি সারাবিশ্বব্যাপী একযোগে প্রকাশিত হয়েছে। এ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বায়ুদূষণের ক্রমমাত্রায় আমাদের ঢাকার অবস্থান দ্বিতীয়। প্রথম অবস্থানে আছে দিল্লী। এ প্রতিবেদন বলছে গত ২৫ বছরে (১৯৯০-২০১৫) বায়ুদূষণ সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ভারত ও বাংলাদেশে যদিও চীন এ তালিকায় আগে প্রথম অবস্থানে ছিলো। আমাদের ঢাকার বাতাসে সবচেয়ে ক্ষতিকর পদার্থ পি এম২.৫ এর মাত্রা অনেক বেশি।

আসুন দেখে নিই পিএম২.৫ কি জিনিস। পিএম২.৫ হচ্ছে এমন এক ধরনের কঠিন বা জলীয় অতি সূক্ষকণা যা আড়াই মাইক্রোন বা তার নিচে চওড়া। মনে রাখা দরকার যে, এক ইঞ্চি সমান ২৫০০০ মাইক্রোন। যদি উদাহরণ হিসেবে  বলি তাহলে বলা যায়, এ কণা একটা চুল  যতটা চওড়া তার ত্রিশ ভাগের এক ভাগ সমপরিমান চওড়া। ফলে এটা এমন সূক্ষকণা যা খালি চোখে দেখা যায় না।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এ সূক্ষকণা দ্বারা আমরা কিভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবো? উত্তর হচ্ছে,এ কণাগুলো এত সূক্ষ যে খুব সহজেই  প্রশ্বাসের মাধ্যমে  ফুসফুসের গভীরে পৌঁছে যায়। সেখান থেকে  হার্ট হয়ে রক্তের মাধ্যমে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। তারপর শ্বাসতন্ত্রের নানাবিধ রোগ যেমন হাঁচি, কাশি, শ্বাসকষ্ট, নাক দিয়ে পানি পড়া থেকে শুরু করে এমন ছোটখাট অসুখ, ক্রনিক ব্রঙ্কাইটিসসহ হার্ট অ্যাটাক এবং ক্যান্সারের মতো প্রাণঘাতী রোগ সৃষ্টি করতে পারে।

এ কারণে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)এবং আন্তর্জাতিক ক্যান্সার গবেষণা সংস্থা(IARC)  পিএম২.৫ কে  ‘জি-১ কার্সিনোজেন ‘ এর তালিকাভুক্ত করেছে। অর্থাৎ এ কণা মানদেহের ক্যান্সার সৃষ্টিতে একদম প্রথম সারিতে অবস্থান করছে। তাছাড়া, বৃদ্ধ এবং বাচ্চাদের জন্য এ কণা আরো বেশি ক্ষতিকর।

‘বৈশ্বিক বায়ু পরিস্থিতি-২০১৭’  নামক এ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বায়ু দূষণের কারণে আমাদের দেশে প্রতি বছর প্রায় ১লাখ ২২ হাজার ৪০০ মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী ২০১৫ সালে সাকুল্যে ৪২ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে বায়ু দূষণের কারণে।

অন্যদিকে, প্রভাবশালী চিকিৎসা জার্নাল ল্যানসেট জুন,২০১৬ সালের প্রতিবেদনে  ১৮৮ টি দেশের ২৩ বছরের (১৯৯০-২০১৩)তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছে যে  ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে মানুষ তাদের জীবনযাপন পদ্ধতি এবং আচরণগত পরিবর্তন এনে স্ট্রোক প্রতিরোধ করতে পারে। নিশ্চয় এটা সুখবর। কিন্তু এটা যদি হয় সুখবর তাহলে উক্ত প্রতিবদেনের খারাপ খবর হচ্ছে,  নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলোতে বায়ু দূষণ স্ট্রোকের বড় কারণ হিসেবে দেখা দিয়েছে। যদিও এ সম্পর্কিত বিস্তারিত তেমন কোন তথ্য বিশেষজ্ঞদের কাছে নেই।

এছাড়াও এ প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশে ২২ শতাংশ মানুষ বাতাসে ভাসমান বস্তুকণা ও ৩০ শতাংশ মানুষ জ্বালানি-সংশ্লিষ্ট দূষণের শিকার। স্ট্রোকের কারণে  ৪০ বছরের কম বয়সী যুবক এবং তরুণদের মৃত্যুহার বাড়ছে। সুতরাং বায়ুদূষণের এমন ভয়াবহ  এবং আগ্রাসী তৎপরতাকে  হেলাফেলা করার সুযোগ খুব একটা কি আছে?

বাতাসে পিএম২.৫ এর স্বাভাভিক বা গ্রহণযোগ্য মাত্রা কত সেটা  নিয়ে বিভ্রান্তি আছে। ফলে বাতাসে এর গ্রহণযোগ্য মাত্রার ব্যাপারে বিশ্বব্যাপী গ্রহণযোগ্য কোন নির্দিষ্ট পরিমাপক নেই। আমেরিকার পরিবেশ রক্ষাবিষয়ক সংস্থা (EPA) ২০০৬ সালে বলেছে, স্বল্পমেয়াদে বাতাসে এর গ্রহণযোগ্য মাত্রা হতে পারে প্রতি ঘনমিটারে ৩৫ মাইক্রোগ্রাম। কিন্তু যদি দীর্ঘমেয়াদী বায়ু দূষণ হয় তাহলে এর গ্রহণযোগ্য মাত্রা প্রতি ঘনমিটারে হবে মাত্র ১৫ মাইক্রোগ্রাম।

যদিও  ২০১৩ সালে ইউরোপীয় দেশগুলোতে পরিচালিত তিন লাখ বারো হাজার নয়শ চুয়াল্লিশ জন মানুষের উপর গবেষণার যে ফল প্রকাশিত হয়েছে সেখানে বলা হয়েছে যে, মানবদেহে এসব সূক্ষকণার কোন গ্রহণযোগ্য মাত্রা নেই। বরং সেখানে বলা হয়েছে প্রতি ঘনমিটারে যদি সুক্ষ  কণার(পিএম১০) পরিমাণ ১০ মাইক্রোগ্রাম হয় তাহলে ফুসফুসের ক্যান্সারের ঝুঁকি ২২ শতাংশ বেড়ে যায়। আর সূক্ষকণা যদি পিএম ২.৫ হয় ( অর্থাৎ বেশি সূক্ষ কণা)  সেক্ষেত্রে ফুসফুসের ক্যান্সারের হার বেড়ে ৩৬ শতাংশে পৌঁছে এবং মারাত্মক মৃত্যুঝুঁকিও তৈরি করে।

আমাদের দেশ বায়ুদূষণের বড় কারণ হচ্ছে, যাচ্ছেতাইভাবে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা। যত্রতত্র ইট, বালু, সুরকি ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা। সময়মতো কাজ শেষ না হওয়া এবং যথেষ্ট সতর্কমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করে এমন উন্নয়ন কাজ পরিচালনার কারণে বাতাস ভয়াবহভাবে দূষিত হচ্ছে। আগে মগবাজার এলাকায় ফ্লাইওভার তৈরির সময় ওই এলাকা ছিলো ধুলার স্বর্গরাজ্য। আর এখন মেট্রোরেল এর কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য মিরপুর যেন ধুলার সাথে মিতালী করেছে। নাকচেপে, মাস্ক পরে, গাড়ির জানালা বন্ধ করে-এমন নানা কসরত করে ধুলার হাত থেকে বাঁচার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু আসলে তা কি সম্ভব যদি বাতাস হয় ধুলিময়? আর তার সাথে  সূক্ষকণার পরিমান যদি থাকে ব্যাপকমাত্রায়!

তাছাড়া কলকারখানার ধোঁয়া, কয়লা, ডিজেল, পেট্রোল, অকটেন সহ জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানো, ইটভাটার কালো ধোঁয়া ইত্যাদি মিলেমিশে আমাদের বাতাসকে প্রচণ্ডভাবে দূষিত করে তুলেছে। বাতাসে  সূক্ষধূলিকণা বাড়ছে হু হু করে। এর ফলে আমাদের জিনেটিক পরিবর্তনসহ মৃত্যু ঝুঁকির আশংকা দ্রুতগতিতে বাড়ছে।

এখনই এর লাগাম টেনে না ধরতে পারলে শ্বাসজনিত নানা রোগ, হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, ক্যান্সার এবং জিনেটিক পরিবির্তনজনিত নানা অজানা রোগে ভুগতে হতে পারে চরমভাবে। এতে একদিকে যেমন চিকিৎসা ব্যয় বেড়ে যাবে তেমনিভাবে অসুস্থ মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার কারণে উৎপাদনশীতাও ব্যাপকভাবে কমে যেতে পারে।

ছোট ছোট বাচ্চারা যেভাবে বায়ু দূষণের শিকার হচ্ছে তাতে আমাদের  ভবিষ্যত প্রজন্মকে আমরা কোথায় ঠেলে দিচ্ছি সে খবর এখন রাজনৈতিক ডামাডোল আর উন্নয়ন খবরের ভীড়ে হারিয়ে যাচ্ছে। আমরা রাজনৈতিক সুস্থিরতা, উন্নয়ন চাই। কারণ এর বিকল্প নেই। কিন্তু নীরব ঘাতক এ বায়ু দূষণের ব্যাপারে কি আমরা এতটুকু সোচ্চার? নাকি যেমনভাবে বায়ু দূষণ হচ্ছে সেটা দিন দিন বেড়েই চলবে  আর আমরা চেয়ে চেযে দেখব? ত্বরিৎ ব্যবস্থা গ্রহণ এখন থেকেই শুরু না করলে অনিশ্চিত ভবিষ্যতই হবে হয়তো আমাদের ললাট লিখন!

লেখক : চিকিৎসক।

এইচআর/পিআর

আরও পড়ুন