বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির বিশ্বায়ন
বার্সেলোনায় বাংলাদেশীদের এক অনুষ্ঠানে আমার অগ্রজপ্রতিম তার বক্তব্যে, প্রবাসে আমাদের নতুন প্রজন্মের বাংলা বলা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘আমাদের সন্তানরা টেনেটুনে বাংলা বললেও এখানে তাদের পরবর্তী প্রজন্ম বড়জোর গল্পের ছলে হয়তো বলবে, আমাদের পূর্বপুরুষ একদা বাংলা ভাষায় কথা বলত’। ওনার এই মন্তব্যটি শুনে আমি ভাবনায় পড়ে যাই। কারণ, একই আশঙ্কায় আমিও ভুগি। এখানে প্রতিবেশী কোন বাঙালীর অনুষ্ঠানে গেলে আমি ছোট শিশুদের নিজেদের মধ্যে বাংলা না বলে, স্প্যানিশ ভাষায় কথা বলতে দেখি। আবার একই বাঙালী পরিবারে সন্তানরা নিজেদের মধ্যে বিদেশী ভাষা ব্যবহার করে কথা বলে।
প্রথম প্রথম এমন দৃশ্য দেখে অবাক হতাম। প্রতিবাদও করতাম সন্তাদের মা বাবার কাছে। কিন্তু পরে ব্যাপারটি মেনে নিতে বাধ্য হয়েছি। এখানে স্থানীয় স্কুলে শিশুদের তাদের মাতৃভাষা কাতালান এবং স্প্যানিশ ভাষা শেখানো হয়। স্কুলে সহপাঠীরা নিজেদের মধ্যে ভাব প্রকাশে এই ভাষাগুলোই ব্যবহার করে। কিন্তু স্কুলের গন্ডির বাইরে বাংলা ভাষাভাষি পরিবারের মধ্যে শিশুরা বাংলার পরিবর্তে স্প্যানিশ বলবে কেন?
বাঙালী পরিবারের সন্তানরা নিজেদের মধ্যে কথা বলার সময়ও বাংলা ভাষার বাইরে এই বিদেশী ভাষা ব্যবহার করে। এটা কি সচেতন অভিভাবকের জন্য মেনে নেয়ার মতো বিষয়? আর এর ফলশ্রুতিতে এই জেনারেশনের শিশুরা বড় হয়ে স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে যখন কলেজে ওঠে তখন তাদের মধ্যে অনেকেই বাংলা শুদ্ধ করে বলতে ও লিখতে পারে না। অথচ, ইউরোপে বসবাস করা বেশির ভাগ পরিবারই সন্তান বড় হওয়ার সাথে সন্তানের ভবিষ্যত নিয়ে উৎকণ্ঠায় ভোগেন। চিন্তা করেন, সন্তান না আবার ইউরোপিয়ান কালচারে পেয়ে বসে! কিন্তু সন্তান ছোট থাকা অবস্থায় তাদের সচেতন থাকা জরুরী। সন্তানের মুখে নিজের মাতৃভাষার পরিবর্তে অন্য ভাষা বলার অভ্যাসটাকে দূর করানো উচিত। চেষ্টা করা দরকার, অন্তত নিজেদের কথাবার্তায় বাংলাভাষা ব্যবহারের অভ্যাস করানো। একটা জাতির আত্মপরিচয়ের বহিঃপ্রকাশ হয় তার ভাষায়। ভাষা শহীদদের রক্তে ভেজা বর্ণমালার আবেগ কোমলমতি শিশুদের মধ্যে তৈরি করে দেয়াটা আমাদের দায়িত্ব।
আমাদের বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলনের পর ৬৫ বছর পার হয়ে গেছে। কিন্তু আমাদের মাতৃভাষাকে খোদ স্বভূমিতে আইন করেও এখনও সর্বস্তরে পৌঁছিয়ে দিতে আমরা পারিনি। প্রবাসে দেখি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম থেকে সাইনবোর্ড পর্যন্ত মাতৃভাষার বাইরে অন্য ভাষা ব্যবহার করায় নিষেধাজ্ঞা আছে। ক্ষেত্র বিশেষে অন্য ভাষা ব্যবহার করতে হলে বিশেষ অনুমতি লাগে। আমাদের প্রতিবেশী দেশের দিকেই লক্ষ্য করা যাক। কয়েক বছর আগে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সরকার আইন করে রাজ্যের সব বিলবোর্ডে বাংলা লেখা বাধ্যতামূলক করেছে। যদিও আশির দশকে বাংলাদেশ সরকারও এই আইন করেছিল কিন্তু আমরা তা ধরে রাখতে পারিনি।
প্রতিবেশী দেশ নেপালে ২০১২ সালে তাদের সরকার ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম বিদেশী ভাষা পরিবর্তন করে স্থানীয় ভাষায় রাখার আদেশ জারি করে এবং দুই মাসের মধ্যে নাম পরিবর্তন না করলে ঐসব প্রতিষ্ঠানের অধিভুক্তি বাতিল করে শাস্তি প্রদানের কথা বলা হয়েছে। অথচ বাংলাদেশে শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকগুলো বাদে সবই ইংরেজী নামে চলছে। সরকার সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন করতে চাইলে মন্ত্রণালয় বা মঞ্জুরি কমিশন প্রস্তাব করতে পারে ইংরেজী নাম পরিবর্তন করে বাংলায় নামকরণ করার জন্য। মুক্ত বাজার অর্থনীতি তথা বিশ্ব বাজারের দ্রুত সম্প্রসারণের নামে আমরা দেশে উৎপাদিত পণ্যের গায়েও বাংলার পরিবর্তে ইংরেজী ভাষা ব্যবহার করতে দেখি। ‘আমের স্বাদ’ না লিখে লেখা হয় ‘ম্যাঙ্গো ফ্লেভার’।
ইংরেজ, জার্মান, ফরাসিরা তাদের ভাষাকে অন্য ভাষাভাষীর মানুষের কাছে ছড়িয়ে দিতে রাষ্ট্রীয়ভাবে কোটি কোটি টাকা খরচ করে চলছে। কিন্তু সে তুলনায় প্রবাসে বাংলা ভাষার চর্চার জন্য সরকারী কোন সহযোগিতা নেই। আর বিদেশীদের বাংলা ভাষা চর্চার জন্য উৎসাহ প্রদানে কিংবা বাংলা ভাষার আধিপত্য বা বিস্তৃতির ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের কোন আন্তর্জাতিক নীতিমালাও নেই।
তবুও ভাষা বহে চলা নদীর মতো। বাংলাদেশের মানুষ পৃথিবীর যে প্রান্তেই গিয়েছে মুখে তার নিজের মাতৃ ভাষাটাকে সঙ্গী করে নিয়েছে। সেখানে সে মাতৃভাষাকে প্রকাশের চেষ্টা করেছে। বর্তমান পৃথিবীতে প্রায় ২৮ কোটি বা তারও বেশি মানুষের ভাষা বাংলা। এর মধ্যে বাংলাদেশে ১৬ কোটি, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা, বিহার ও ওডিশাসহ আছে প্রায় ১২ কোটি বাংলা ভাষাভাষী। আর পৃথিবীময় ছড়িয়ে আছে দেড় কোটিরও বেশি মানুষ।
এই দেড় কোটি মানুষ প্রবাসে আমাদের বাংলা ভাষার প্রতিনিধিত্ব করে। বাংলা ভাষাকে ছড়িয়ে দেয় বিশ্বময়। বাংলা ভাষা চর্চার ক্ষেত্রে বহির্বিশ্বে স্বাধীনতার পূর্বে ইংল্যান্ড, জাপান, আমেরিকা এবং পরে আশির দশক পর্যন্ত তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিল। সেখান থেকে বাংলা ভাষার সেরা সব ক্লাসিক গ্রন্থাবলী প্রকাশিত হতো। ছাপানো হতো শিশু, নারীসহ নানা বিষয়ভিত্তিক আকর্ষণীয় পত্রিকা। এ সব প্রকাশনা কাজে বিভিন্ন সময় জড়িত ছিলেন ননী ভৌমিক, হায়াত মামুদ, প্রফুল্ল রায়সহ অনেক খ্যতিমান ব্যক্তিত্ব। পৃথিবীতে এই বিপুল সংখ্যক বাংলাভাষী মানুষের সংখ্যা বিবেচনায় রেখেই বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা, রেডিও তেহরানসহ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো তাদের নিজেদের দেশ থেকে বাংলা ভাষায় বিভিন্ন অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে যাচ্ছে।
আমার লেখার প্রথমে প্রবাসে শিশুদের বাংলা সেখানোর জন্য অভিভাবকদের যে অসচেতনতার কথা বলেছি সেটার ফল নেতিবাচক হয়। কিন্তু প্রবাসে বাংলা ভাষাকে টিকিয়ে রাখতেও অনেক উদ্যোগ নিয়েছে প্রবাসীরা এবং বাংলাদেশী কমিউনিটিসহ বাংলা ভাষাকেন্দ্রিক বিভিন্ন গণমাধ্যম ও প্রতিষ্ঠান। আমাদের ভাষাদিবস ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে দু’জন প্রবাসী বাংলাদেশীর উদ্যোগে। ১৯৯৮ সালে কানাডা প্রবাসী রফিকুল ইসলাম এবং আবদুস সালাম প্রাথমিক উদ্যোক্তা হিসেবে এই দিনকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণার আবেদন জানিয়েছিলেন তৎকালীন জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনানের কাছে। এরই ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশ সরকারের সহযোগিতায় ২০১০ সালের ২১ অক্টোবর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৬৫তম অধিবেশনে এই প্রস্তাব সর্বসম্মতভাবে পাস হয়েছে। অমর একুশ এখন গর্ব ভরে স্মরণ করে সারা বিশ্ববাসী।
সারা ইউরোপ জুড়ে যেখানে বাংলাদেশী কমিউনিটি আছে সেখানেই প্রবাসীরা নিজেদের উদ্যোগে বাংলা স্কুল তৈরি করে স্বল্প পরিসরে হলেও নিজেদের সন্তানদের বাংলা শিক্ষা দেয়ার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এই প্রচেষ্টার পেছনে মূল কারণ, সন্তানের ভেতর নিজের দেশের ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতিফলন ঘটানো। প্রবাসে বিশেষ করে ইউরোপ, আমেরিকা, জাপানসহ বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় প্রতিনিয়ত বাংলা চর্চার জন্য বিভিন্ন সুযোগ প্রবাসীরা তৈরি করছে। প্রবাস থেকে প্রায় ৫০ থেকে ৬০টি অনলাইন ও প্রিন্ট সংস্করণে বাংলা ভাষায় পত্রিকা ম্যাগাজিন বের করছে। বর্তমানে ইউরোপে প্রায় ৭ থেকে ৮টি বাংলা টিভি চ্যানেল বাংলা খবরসহ বিনোদন অনুষ্ঠান প্রচার করছে। ইংল্যান্ডের ইস্ট লন্ডন ও বার্মিংহামসহ দেশ জুড়ে ৪ লাখেরও বেশি বাংলাভাষাভাষী মানুষের বাস। সেখানকার সরকারী স্কুলগুলোতে বাংলা শেখার ও চর্চার সুযোগ রয়েছে।
এছাড়া কমিউনিটির উদ্যোগে ব্যক্তিগত অনুদানের মাধ্যমেও বাংলা স্কুল তৈরি করে শিশুদের জন্য বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি চর্চার সুযোগ করে দেয়া হচ্ছে। এ রকম প্রায় শ’খানেক বিদ্যালয় আছে যেখানে বাংলা শেখানো হয়। বাংলাদেশের স্বাধীন হওয়ার পূর্ব থেকেই ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের প্রাচ্যবিদ্যা ও ভাষা চর্চা বিভাগের অধীনে বাংলা ভাষার চর্চা ও গবেষণা চলছে। এ কাজে বাংলা ভাষাভাষীদের পাশাপাশি কাজ করছেন টিডব্লিও ক্লার্ক, জেডি এন্ডারসন, জনবোল্টন, উইলিয়াম রাদিচে, হ্যানা থমসন প্রমুখ। ইংল্যান্ডের পর বাংলা ভাষা চর্চা ও গবেষণার জন্য অন্যতম হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।
সেখানে প্রায় ১০টি বিশ্ববিদ্যালয় ও এশিয়া গবেষণা কেন্দ্রে বাংলা ভাষা চর্চা হয়। ভাষা চর্চা ছাড়াও গবেষণা হয় বাংলা ভাষার লেখক রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর, নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ ও লালন ফকিরকে নিয়ে। কানাডায় জোসেফ ও কনেল, ব্যারি মরিসনসহ (ভ্যাংকুভার) বেশকিছু প্রবাসী ব্যক্তি বাংলায় অধ্যাপনা ও গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। ভবিষ্যত প্রজন্মকে মাতৃভাষা শেখানোর জন্য অস্ট্রেলিয়াতে প্রায় ২০টি স্কুল পরিচালনা করছে বাংলাদেশীরা। গবেষণার ক্ষেত্রে মানিয়ন মাডার্ণসহ শিবনারায়ণ রায়, আবু সাঈদ আইয়ুব গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। এশিয়ার মধ্যে জাপান, কোরিয়া, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে বাংলাভাষার চর্চা আছে। জাপানে প্রায় ৬০ বছর আগে কাজুয়ো আজুমা রবীন্দ্রনাথকে ভালোবেসে বাংলা চর্চা শুরু করেছিল। চীনে রেডিও বেইজিং বাংলা সম্প্রচার করে। চীন থেকে প্রকাশিত হয়েছে বেশ কিছু বাংলা অনুবাদ কর্মও। মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থানরত প্রায় এক কোটি বাঙালি বাংলায় কথা বলে বাংলা ভাষার আধিপত্য ধরে রেখেছে।
বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে বাংলাদেশের যেহেতু অর্থনৈতি আধিপত্য এখনও তৈরি হয়নি, সেহেতু বিদেশী নাগরিক তো দূরের কথা, বাংলাদেশী বংশোদ্ভূতরাও বাংলা ভাষাচর্চায় উৎসাহী হয় না। যদিও ইউরোপে, আমেরিকায় নিয়ম হচ্ছে, মাধ্যমিক স্কুল উত্তীর্ণ হবার পর শিক্ষার্থীদের দ্বিতীয় একটি ভাষা শেখার সুযোগ দেয়া হয়। কিন্তু বাংলা ভাষাকে সেই দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চালু করার উদ্যোগ বাংলাদেশ সরকারকেই নিতে হবে। প্রবাসে যে এত বৃহৎ সংখ্যক বাংলা ভাষাভাষী ছড়িয়ে আছে সেটা বাইরের পৃথিবীকে বোঝাতে হবে। পৃথিবীতে এমন অনেক প্রধান ভাষা আছে যেসব ভাষায় কথা বলা মানুষের সংখ্যা এক কোটিরও কম। সেই তুলনায় বাংলা ভাষাভাষীদের মূল ভূখণ্ড বাদ দিয়ে শুধু বহির্বিশ্বেই বাংলায় কথা বলা মানুষের সংখ্যা প্রায় দুই কোটি। নতুন বিশ্বায়নের এই যুগে এই দুই কোটি বাংলা ভাষাভাষীদের হাত ধরেই পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশ তার ভাষার ও অর্থনৈতিক অধিপত্য বিস্তার করতে পারে। এর জন্য উদ্যোগ নিতে হবে বাংলাদেশ সরকারে। উদ্যোগ হিসেবে দরকার বাংলা ভাষার বিস্তারে আন্তর্জাতিক নীতিমালা প্রণয়ন ও সহযোগিতা। দুই কোটি প্রবাসী আমাদের মাতৃভাষা, সংস্কৃতি ও দেশের অর্থনীতিকে পৃথিবীময় ছড়িয়ে দিতে উন্মুখ হয়ে আছে।
লেখক: জাগো নিউজের স্পেন প্রতিনিধি।
এইচআর/আরআইপি