বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ও এমপি কন্যার বাল্যবিয়ে
কিছুদিন আগেই দেশে বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন পাস হয়েছে, যেখানে বিয়ের ক্ষেত্রে ছেলেদের ২১ আর মেয়েদের বিয়ের বয়স নির্ধারণ করা হয়েছে ১৮ বছর। তারই ধারাবাহিকতায় ৩১ জানুয়ারি ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা উপজেলাকে বাল্যবিবাহ মুক্ত উপজেলা হিসেবে ঘোষণা করেন সেখানকার সংসদ সদস্য সালাউদ্দিন আহমেদ মুক্তি। কিন্তু এর ১৫ দিনের মাথায় এমপি মুক্তা তার ছোট মেয়েকে উপযুক্ত বয়স হওয়ার আগে বিয়ে দিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। পিতা বলতে চাইছেন তার মেয়ে দশম শ্রেণিতে পড়লেও জন্মসনদ অনুযায়ী তার বর্তমান বয়স ১৯ বছর ১ মাস ১৮ দিন। সাধারণত দশম শ্রেণি পড়ুয়া কোনো ছাত্র-ছাত্রীর বয়স হয় ১৫ থেকে ১৬ বছর। আর সেখানে ১৯ বছর বয়সে তো বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনায় হাঁটার কথা। বয়সের হিসাব কেমন যেন গোলমেলে এমপি কন্যার ক্ষেত্রে। সরল অংকটা বেশ জটিলই মনে হচ্ছে এ পর্যায়ে এসে।
এমপি সাহেব ঢাকঢোল পিটিয়ে উপজেলা বাল্যবিবাহ মুক্ত করেছেন তো জনগণের স্বার্থে। আইন তো শুধু জনগণের জন্য, প্রভাবশালী বা ক্ষমতাশীলদের জন্য কেনই বা কোনো আইন থাকবে? তারা তো আইনের ঊর্ধ্বে। হতে পারে আইন তাদের জন্য অন্ধ। এমপি কিংবা সরকারি আমলারা বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ভঙ্গ করলে তাদের জন্য কোনো শাস্তির বিধান রয়েছে কিনা তা জানা নেই। এখন অবশ্য এমপির আইন ভঙ্গ করা নিয়ে প্রকাশ্যে কিছু বললে, তিনি বলবেন তার বিরুদ্ধে একটি স্বার্থান্বেষী মহল ষড়যন্ত্র লিপ্ত হয়েছে। এমপি সাহেব, আপনারা ক্ষমতা ও সম্মানের অধিকারী আর তার উপর রয়েছে আপনাদের বিশাল অনুসারী দল। আপনি কিছু বললে বা করলে তার কিন্তু একটা প্রভাব সমাজে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবেই পড়বে। আধুনিক প্রযুক্তির কবলে পড়ে দুনিয়া কিন্তু এখন ছোট হয়ে গেছে। মালয়েশিয়া কিংবা ময়মনসিংহ স্থান যেটিই হোক না কেন, খবর চাউর হতে কিন্তু সময় লাগে না একদমই।
বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন যেই ভঙ্গ করুক না কেন তার কুফল কিন্তু বেশির ভাগ ভোগ করছে অল্পবয়সী মেয়েরা। বাল্যবিবাহের মাধ্যমে মেয়েরা অবরুদ্ধ হয়ে পড়ছে তাদের কৈশোর কিংবা শৈশবকালেই। স্কুল থেকে ঝরে পড়া মেয়ে শিশুর সংখ্যা কমছে দিনকে দিন। আর এর ফলে সমাজে নারী শিক্ষার হার কমছে ধীরে ধীরে। শুধু তাই নয়, অল্প বয়স্ক মেয়েরা মা হওয়ার দরুন শিশু ও তাদের উভয়েই অপুষ্টিতে ভোগে। আত্মহত্যা, নারী নির্যাতন, পারিবারিক দ্বন্দ্ব অনেকাংশেই তৈরি হয়, যখন অপ্রাপ্ত বয়স্ক একটি মেয়ে তার পারিবারিক ঝামেলা সামলাতে ব্যর্থ হয়। এগুলো আসলে আমরা জেনেও না জানার ভান করে থাকি।
মাস দুয়েক আগে সংসদে দাঁড়িয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এক হাত নিলেন তাদের বিরুদ্ধে যারা বাল্যবিবাহ আইনে বিশেষ বিধানের বিপক্ষে কথা বলেছেন। শুধু তাই নয়, যারা এ বিশেষ আইনের বিরোধিতা করেছেন তাদেরকে এনজিও সনদ দিয়ে কটাক্ষ করতেও পিছপা হননি তিনি। এখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠতে পারে বাল্যবিবাহ আইন ভঙ্গ করে কেউ যদি তার মেয়ে কিংবা ছেলেকে বিয়ে দেন তাহলে তার কি কোনো শাস্তির বিধান রয়েছে। আর এ বিয়ে কি তবে বিশেষ বিধানে বিয়ে হিসেবে গণ্য হবে?
জানিয়ে রাখা ভালো যে, সরকারি পরিসংখ্যান বলছে দেশে এখনো ৫৮.৬ শতাংশ শিশুর ১৮ বছরের নিচে বিয়ে হচ্ছে। আর ইউনিসেফের তথ্যমতে, বাংলাদেশে বাল্যবিবাহের হার সবচেয়ে বেশি দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে যা গড়ে ৬৫ শতাংশ। যেখানে যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানে বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে আমাদের দেশের চেয়েও ভালো অবস্থানে রয়েছে। ৫৪ শতাংশে অবস্থান করেও আফগানিস্তান বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের চেয়ে ভালো জায়গায় রয়েছে। ২০১৬ সালের বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনে শাস্তি সর্বনিম্ন ৬ মাস সর্বোচ্চ ২ বছরের কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে, একই সঙ্গে সর্বোচ্চ অর্থদণ্ড ১ লাখ টাকা, সর্বনিম্ন ১০ হাজার টাকা। তবে প্রভাবশালীদের জন্য টাকার অংকটি খুব সামান্যই মনে হচ্ছে। আর এ কারণেই তারা আইনের তোয়াক্কা না করে অপরাধ করে যাচ্ছে। বিশেষত জনপ্রতিনিধিরা যখন আইন সম্পর্কে সচেতন হয়েও ভুল করেন তখন সাধারণ জনগণকে দোষারোপ করাটা কতটা যুক্তিযুক্ত? জনপ্রতিনিধিদের ক্ষেত্রে কি সাত খুন মাফ? সরকারের বোধহয় এখন সময় এসেছে বাংলা প্রবাদ প্রবচনটি অনুসরণ করার-ঝিকে মেরে বউকে শেখানো। তবে যদি কোনো আইন সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হয়।
লেখক : টিভি নিউজ প্রেজেন্টার।
এইচআর/পিআর