ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

স্কুলে বই রেখে বাসায় ফেরার সুযোগ শিশুশিক্ষার্থীরা কি পাবে?

প্রকাশিত: ০৩:৪৭ এএম, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

তোমার সন্তানেরা তোমার সন্তান নয়।
জীবনের নিজের প্রতি নিজের যে তৃষ্ণা, তারা হলো তারই পুত্রকন্যা।
তারা তোমাদের মাধ্যমে আসে, তোমাদের থেকে নয়।
এবং যদিও তারা থাকে তোমাদের সঙ্গে, কিন্তু তাদের মালিক তোমরা নও।
তুমি তাদের দিতে পারো তোমার ভালোবাসা,
কিন্তু দিতে পারো না তোমার চিন্তা, কারণ তাদের নিজেদের চিন্তা আছে।
তুমি তাদের শরীরকে বাসগৃহ করতে পারো, কিন্তু তাদের আত্মাকে নয়।
কারণ তাদের আত্মা বাস করে ভবিষ্যতের ঘরে। যেখানে তুমি যেতে পারো না,
এমনকি  তোমার স্বপ্নের মধ্যেও নয়।
তুমি তাদের মতো হওয়ার সাধনা করতে পারো, কিন্তু
তাদের তোমাদের মতো বানানোর চেষ্টা করো না।
কারণ জীবন পেছনের দিকে যায় না, গতকালের জন্যে বসেও থাকে না।
-কাহলীল জিবরান

সন্তানদের নিয়ে কাহলীল জিবরানের অসাধারণ কবিতাটি আমাদের প্রতিমুহূর্তে সতর্ক করে দেয়। যে সন্তানেরা ভবিষ্যৎ পৃথিবী বিনির্মাণ করবে আমরা এখন শঙ্কিত তাদের শিক্ষা নিয়ে। শিক্ষার হাত ধরে জ্ঞান আর প্রজ্ঞায় শক্তিশালী একটি প্রজন্ম গড়ে ওঠে জানি, কিন্তু এই শিক্ষাটা আসবে কোথা থেকে! প্রাথমিক পর্যায়ে জাতীয় পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত পাঠ্যপুস্তক শিক্ষার্জনের গুরুত্বপূর্ণ একটি মাধ্যম এবং অবশ্যই যদি সেটা মানসিক বিকারহীন মানুষদের দ্বারা তৈরি করা হয়। এবারের পাঠ্যপুস্তক নিয়ে বিতর্ক সবাইকে মোটামুটি একটা ধারণা দিয়েছে। যে ভাবনা থেকে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড, মহান স্বাধীনতা লাভের ঠিক আগে পাকিস্তানি শাসকগণ ভেবেছিলেন নিজেরা হারলেও তারা বাংলাদেশকে কোমর তুলে দাঁড়াতে দেবেন না, ল্যাংড়া করে রাখবেন। জাতিকে  ঢেলে সাজানোর কারিগরদের তাই নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল।

৪৫ বছর পর বাংলাদেশ এখন এমন একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে যখন উন্নত দেশগুলোও তাদের অনেক কঠিন প্রয়োজন মেটাতে বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে থাকে। ঠিক সেইসময় চক্রান্ত চলছে আগামীর হাল ধরতে যাওয়া প্রজন্মকে টেনে পেছনে নেয়ার। সন্তানদের মাথায় একটা বিশেষ মহল নিজেদের চিন্তধারা ঢুকিয়ে দিতে তৎপর। অবিবেচনাপ্রসূত, দুর্বল, সাম্প্রদায়িক হীনম্মন্যতায় ভরপুর ও ভুলভাল বানানে সমৃদ্ধ পাঠ্যপুস্তকের মাধ্যমে কোটি কোটি মাথাকে নষ্ট করবার ন্যক্কারজনক পরিকল্পনা চলছে।

আগামীর হাল যারা ধরবে সেই প্রজন্মের মাথা তৈরির কাজে নিয়োজিত শিক্ষকদের অধিকাংশই শিক্ষাগত যোগ্যতায় নিন্মতর। প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদানে নিয়োজিত একজন নারী শিক্ষিকার ন্যূনতম যোগ্যতা ইন্টারমিডিয়েট পাশ এবং পুরুষ শিক্ষকের জন্য ডিগ্রি পাশ। সম্মানিত শিক্ষকদের হেয় করার জন্য বলছি না, শুধু একটু ভেবে দেখুনতো এই যোগ্যতা নিয়ে একজন শিক্ষকের পক্ষে একটি শিশুর খুব গুরুত্বপূর্ণ সময়কে কীভাবে ঋদ্ধ করা সম্ভব! তিনি শুধু পাঠ্যপুস্তক মুখস্থ করার জন্য গাইড হতে পারেন কিন্তু শিশুর মনন তৈরির কাজে কতটুকু ভূমিকা রাখতে পারবেন! আবার শুধু পাঠ্যপুস্তক পড়েও চূড়ান্ত সাফল্য অর্জন সম্ভব না। পাশাপাশি দরকার মননশীল বই যা শিশুদের মনে নতুন নতুন চিন্তার খোরাক জোগাবে।

পাঠ্যপুস্তকের বাইরে শিশুরা কী ধরনের বই পড়বে! কার বই পড়বে! প্রতিবছর বইমেলায় ঠাকুরমার ঝুলির আদলে শত শত বইয়ের ছড়াছড়ি। কবি জীবনানন্দের ভাষায় বলতে হয়- ‘জীবন গিয়েছে চলে কুড়ি কুড়ি বছরের পার।’ কুড়ি বছর আগের একটি শিশুর খেলনা থেকে শুরু করে নানান ব্যবহার্য সামগ্রী আর কুড়ি বছর পরের শিশুর ব্যবহার্য সামগ্রীর মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য। এখনকার শিশুরা নানা ধরনের ইলেকট্রনিক গ্যাজেট ব্যবহার করে। আপনার আমার থেকেও প্রচুর জানে তারা। তাদের কি ভূত আর রাক্ষস-খোক্ষসের চেহারা নিয়ে ভয় পাওয়ার সময় আছে! কেন যেন আমরা সময়ের আবেদনকে কিছুতেই ধরতে পারছিনা। শিশুদের সমকালীন ভাবনাকে উস্কে দিতে পারছিনা। কীভাবে শিশুদের নির্দিষ্ট চিন্তাধারার মধ্যে আটকে রাখা যায়, সবার মধ্যেই সেই প্রচেষ্টা! একই বিষয়বন্তু নিয়ে একাধিক লেখক লিখছে। লেখা দরকার তাই লিখছে। নিজের নামটি বইয়ের পাতায় দেখার লিপ্সা থেকে লিখছে। শিশুদের মনন তৈরির ব্যাপারে কারো কোন দায়বদ্ধতা নেই। প্রতিবছর বইমেলায় শিশুদের পাঠের উপযোগী হাজার হাজার বই বের হয়, যেগুলোর অধিকাংশের মান গার্বেজে জায়গা পাওয়ার মতো।

অমর একুশে বইমেলায় আমাদের শিশুদের জন্য আলাদা কর্নারও থাকে। সপ্তাহের একদিন আছে শিশুপ্রহর। ভীড় ঠেলে ঠুলে বই কেনার হ্যাঁপা থেকে বাঁচতে একটা বেলা তাদের জন্য নির্দিষ্ট রাখা হয়েছে। সেদিন তারা বাবা-মায়ের সঙ্গে বইমেলায় উড়ে উড়ে ঘুরে ঘুরে বই কেনে। ঝলমলে মলাট দেখে পছন্দ করা বই বাবা-মা কিনে না দিলে অভিমান করে। হয় উল্টো দিকে হাঁটা ধরে নইলে মাটির ওপর শুয়ে পড়ে। লেখকদের অনেকেই শিশুদের এই মানসিকতা জানে। তাই মলাট হয় চিত্র-বৈচিত্র্যে ভরপুর। ভেতরে থাকুক না দুর্বল কনটেন্ট! দিনশেষে বিক্রিবাট্টাই আসল কথা।

বইতো কিনলো কিন্তু শিশু সেসব পড়বেটা কখন! আমাদের শিশুদের জন্য জাতীয় শিক্ষাবোর্ড যে পাঠ্যক্রম তৈরি করে রেখেছে, তাতে করে খাওয়া দাওয়া আর খেলাধুলা চাঙ্গে তুলে সারা বছর তারা কুলকুল করে আর ঘ্যানঘ্যান করে পড়েও পাঠ্যসূচির সঙ্গে কুলিয়ে ওঠে না। স্কুলগুলো ক্লাসে কেবল গাইডলাইনের কাজ করে- এই এই পড়া দিলাম,পড়ে এসো। বাসায় ফেরার পর শিশুকে নিয়ে শুরু হয় মায়ের যুদ্ধ। ক্লাস টুতে পড়া বাচ্চার ১২টা বই। এক মাস পরপর ক্লাস টেস্ট। ক্লাস টেস্টের নম্বর বার্ষিক পরীক্ষায় যোগ হয়। প্রতিদিনের পড়া না পড়লে ক্লাস টেস্টের রেজাল্ট খারাপ করবে। বার্ষিক পরীক্ষায় গোল্ডেন এ- প্লাসের দৌড়ে পিছিয়ে পড়বে। সুতরাং শিশুর ওপর চলতে থাকে ল্যান্ড ক্রাশার। শিশুর পড়ায় মনোযোগ নেই, শিশু মার খায়। পড়া মুখস্থ হয় না, শিশু মার খায়। এক নাগাড়ে বসে থাকার অধৈর্য্য নিয়ে একটু খেলে আসি বলামাত্র শিশু মার খায়। শিশুকে মায়ের হাতে-শিক্ষকের হাতে মার খাওয়ানোর পরিকল্পনা নিয়ে তৈরি করা এই শিক্ষা কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত জনাব মান্যবরগণ! আপনারা জাতিকে কী শিক্ষা দান করার পরিকল্পনা করেছেন জানিনা কিন্তু রাতে ঘুমিয়ে যাওয়া আমার শিশুর মুখের দিকে তাকিয়ে আমি কাঁদি। ঘুমিয়ে পড়া শিশুর মুখের দিকে তাকালে তখন তাকে প্রকৃতপক্ষেই শিশু মনে হয়। এতটুকু বাচ্চার এতো সইবে কেন! এতো বই আর শক্ত শক্ত পড়া কোনভাবেই ওর পারার কথা না।  কিন্তু ঘুম থেকে জাগলেই আবার পুনরাবৃত্তি ঘটে পুরোনো নিয়মের। এই শিশুদের মেধাবিকাশ ও মননশীল করে গড়ে তুলতে পাঠ্যক্রমের বাইরে খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের বিভিন্ন শাখায় অংশগ্রহণ দরকার। সময় কোথায়!

নতুন বছরে নতুন ক্লাস নতুন উদ্যম। উদ্যমকে ইতিবাচক ফলাফলে রুপান্তরিত করতে বাচ্চাদের জন্য ‘ঘুষ’ হিসেবে দিলাম নতুন ইউনিফর্ম আর নতুন ব্যাগ। যথারীতি স্কুল শুরু হওয়ার কয়েকদিন পরে এসে বাচ্চারা নতুন বায়না ধরলো। তাদের নাকি ব্যাগপ্যাকে সমস্যা হচ্ছে, তাদের দরকার ট্রলি ব্যাগ। কেন? কারণ ব্যাগ অনেক ভারী, পিঠ ব্যথা করে। যাচাই করতে একজনের ব্যাগ উত্তোলন করে আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম! আমার ক্লাস থ্রিতে পড়ুয়া বাচ্চার বোর্ডের বইয়ের বাইরে অনেকগুলো সাপ্লিমেন্টারি বই কিনতে হয়েছে। প্রতিদিন একাধিক ক্লাসের বই সঙ্গে আলাদা আলাদা খাতা, টিফিন বক্স, পানি সব মিলিয়ে পাঁচ থেকে সাত কেজির ওপরে ব্যাগের ওজন! উন্নত দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় আছে শিশুরা স্কুল শেষে স্কুলেই বইগুলোকে রেখে আসবে। যা পড়ানো সবকিছু স্কুলেই পড়ানো হয়। বাসায় ফিরে তারা নিজের জন্য পায় অনন্ত সময়। স্কুলে বই রেখে বাসায় ফেরার এমন সুযোগ আমার সন্তানেরা কি কখনো পাবে জনাব মাননীয়গণ!

লেখক: ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক।

এইচআর/পিআর

আরও পড়ুন