ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

শীতের শেষ রাত

প্রকাশিত: ০৪:০০ এএম, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

ধরিত্রী দেবী দিমিতিরের কন্যা পার্সিফোনে। সুন্দরী হাসিখুশি এক কুমারী। সাথীদের সঙ্গে সে ফুল তুলছিল উন্মুক্ত প্রান্তরে। হঠাৎ পাতালের গভীর থেকে উঠে আসে পাতালপুরীর রাজা হেডিস। পার্সিফোনেকে এক ঝটকায় তুলে নেয় তার রথে। তারপর টেনে নিয়ে যায় অন্ধকার রাজ্যে। মেয়ের শোকে স্তব্ধ হয়ে যান দিমিতির। তাকে খুঁজে বেড়ান মর্ত্যের সব জায়গায়। শোকার্ত মা ফসল ফলানো বন্ধ করে দেন। পৃথিবীতে নেমে আসে শীতকাল। মরে যায় ফসল।

শস্যের ফলন বন্ধ হয়ে গেছে দেখে দেবরাজ জিউস তার দূত পাঠান হেডিসের কাছে। ফেরত দিতে হবে পার্সিফোনেকে। কিন্তু এর আগেই চারটি ফলের বীজ খেয়ে ফেলেছিলেন পার্সিফোনে। পাতালপুরীর খাদ্য খেয়ে ফেলায় আর পুরোপুরি ফিরে আসার সুযোগ পান না তিনি। বছরের চার মাস তাকে থাকতে হয় মৃত্যুরাজ হেডিসের রানী হিসেবে অন্ধকার জগতে। এই সময় মর্ত্যে চলে শীতকাল। আর যখন মায়ের কাছে রোদ ঝলমল পৃথিবীর বুকে ফিরে আাসেন তিনি তখন শুরু হয় বসন্ত। গ্রিক মিথোলজির এই গল্পটি বসন্তের সঙ্গে সঙ্গে নতুন জীবন, নতুন ফসলের কথা বলে।

বিশ্বের বিভিন্ন পুরাণে রয়েছে বসন্ত নিয়ে গল্প। হিন্দু মিথোলজিতে বসন্তের প্রতীক হলেন কামদেব বা কন্দর্প। শিব তাকে ভস্ম করে দিয়েছিলেন বলে তার অন্য নাম অনঙ্গ বা অতনু। তিনি সুদর্শন যুবক। তার গায়ে বকুলের ঘ্রাণ। তিনি পুষ্পবাণ বহন করেন। তাঁর তণীতে থাকা পাঁচ প্রকার ফুলের শর হলো, অশোক, শ্বেত পদ্ম, নীল পদ্ম, মল্লিকা ও আমের মঞ্জরী। অর্থাৎ যে ফুলগুলো মূলত বসন্তে ফোটে।  তার স্ত্রী হলেন রতি যার জন্ম আকাক্ষা থেকে। দেবী বসন্ত হলেন কামদেবের সঙ্গী। দেবী বসন্তের জন্ম হয় হতাশার দীর্ঘশ্বাস থেকে।

চীনের বসন্ত উৎসব বিশ্বে বিখ্যাত। চান্দ্র ক্যালেন্ডার অনুযায়ী উদযাপিত হয় এই বসন্ত উৎসব। এই উৎসবের মধ্য দিয়েই শুরু হয় তাদের নতুন বছর। সুমেরীয়, মিশরীয় এবং ব্যাবিলনীয় পুরাণেও রয়েছে শীত ও বসন্ত নিয়ে নানা রকম কাহিনী। ব্যাবিলনীয়, আসিরীয় ও ফিনিশীয় পুরাণে সকল জীবের মাতা এবং প্রধান দেবী হলেন ইশতার। তার প্রেমিক হলেন ফসলের দেবতা তামুজ। প্রতি হেমন্তে তামুজের মৃত্যু হয়। সারা শীত ইশতার শোক করেন তার জন্য। আবার বসন্তে জীবিত হয়ে ওঠেন তামুজ।

বাঙালির বসন্ত উৎসব উদযাপনের রীতিও বেশ প্রাচীন। দোল উৎসব ও রাস পূর্ণিমা উদযাপন সুপ্রাচীন বসন্ত উৎসবের সঙ্গে জড়িত।  পহেলা ফাল্গুনে বসন্ত উদযাপনের রীতিও ঐতিহ্যবাহী।  ইংরেজ শাসনামলে শহরে বাঙালির ঐতিহ্যবাহী রীতিনীতি পাশ্চাত্যের অনুকরণের স্রোতে হারিয়ে যেতে বসেছিল। শান্তিনিকেতনে গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নতুন করে আমাদের দেশজ ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার প্রয়াস থেকে বসন্ত উৎসব উদযাপনের রীতি প্রবর্তন করেন। দোল পূর্ণিমাকে সামনে রেখেই এটা করা হয়। তবে দোলের সঙ্গে বিশেষ ধর্মের সম্পৃক্ততার কারণে রবীন্দ্রনাথ ধর্মনিরপেক্ষ বসন্ত উৎসব উদযাপনের কথা চিন্তা করেন। সেই চিন্তা থেকেই শান্তি নিকেতনে এখনও প্রতিবছর বসন্ত বরণ উৎসব হয় যাতে সব সম্প্রদায়ের মানুষই অংশ নেন।

পাকিস্তান আমলে পূর্ববাংলার ভাষা ও সংস্কৃতির উপর একের পর এক আঘাত হানতে থাকে পাকিস্তানি শাসকরা। অন্যদিকে প্রতিবাদস্বরূপ  বাঙালি আপন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারে আগ্রহী হয়। ষাট দশক থেকেই পহেলা ফাল্গুনে হলুদ শাড়ি পরা নতুনভাবে শুরু হয়। ছোটবেলায় (স্বাধীনতার পর) আমার নানীকে দেখেছি পহেলা ফাল্গুনের আগে শাড়িতে ফুল দিয়ে রং ছাপ করতে। তখন বাজারে  ফাল্গুনের এত রকম শাড়ি বা পোশাকের বাহার ছিল না। তবে হলুদ শাড়ি বা বাসন্তী রঙের শাড়ি, গাঁদা ফুলের মালা পরার রীতি সীমিত পর্যায়ে হলেও ছিল।

১৯৯৪ সাল থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বসন্ত উৎসব উদযাপন শুরু হয় ঢাকার চারুকলায়।  জাতীয় বসন্ত উৎসব উদযাপন কমিটি তখন থেকেই নিয়মিত বকুলতলায় বসন্ত বরণের জন্য উৎসবের আয়োজন করছে। তবে বসন্ত বরণের এসব উৎসব নগরকেন্দ্রিক। গ্রামে কিন্তু বসন্ত বরণের জন্য লোক সংস্কৃতির ঐতিহ্যবাহী সেই দোল, রাস উৎসব টিকে আছে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে। গ্রামে গ্রামে একসময় বসন্তে বসন্তদেবী বা শীতলাদেবীর পূজা প্রচলিত ছিল। প্রাণঘাতী বসন্ত রোগ থেকে বাঁচবার জন্য দেওয়া হতো এই পূজা।

ফাল্গুন চৈত্রমাসে গ্রামে গঞ্জে বিভিন্ন উপলক্ষে মেলা বসারও রেওয়াজ আছে।

ফাল্গুনে বসন্ত বরণ আমাদের লোকজ ঐতিহ্যবাহী উৎসব। বসন্তের সঙ্গে সারা বিশ্বেরই লোক সংস্কৃতির যোগ রয়েছে।  পহেলা ফাল্গুনের বসন্তবরণ উৎসব ধর্ম সম্প্রদায় নির্বিশেষে উৎযাপিত আনন্দ উৎসব। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার জন্য আমাদের এই ধরনের সম্প্রদায় নির্বিশেষে পালন করা যায় এমন উৎসবের সংখ্যা বাড়াতে হবে। এতে একদিকে যেমন লোকজ সংস্কৃতির পুনর্জাগরণ হবে তেমনি জাতিগত ঐক্যও বৃদ্ধি পাবে। মাঘের শেষে নতুন প্রভাতে বসন্তের ফুল ফুটবে। নতুন বসন্তের সঙ্গে আমাদের জাতীয় জীবনেও ফুটুক শুভ পুষ্প। গত শীতের নাসিরনগর, গোবিন্দগঞ্জের তিক্ত স্মৃতিকে পেছনে ফেলে নতুন মাদলের ধ্বনি বাজুক । বসন্ত পূর্ণিমা উদ্ভাসিত হোক সম্প্রীতিময় সংস্কৃতির স্নিগ্ধতায়। শুভ বসন্ত।

লেখক : কবি, সাংবাদিক।
[email protected]

এইচআর/এমএস

আরও পড়ুন