ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

নতুন নির্বাচন কমিশন : কথা নয় কাজে প্রমাণ চাই

প্রকাশিত: ০৫:৫২ এএম, ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক পরিপক্কতার আরেকটি উদাহরণ হয়ে থাকবে এই নতুন নির্বাচন কমিশন – এরকম একটি বাক্য লিখেছেন ফেসবুকের এক বন্ধু। অনেকক্ষণ এই বাক্যটি নিয়ে ভাবলাম। কেন তিনি এরকমটি বললেন? ভাবনাটা পাঠকের সঙ্গে ভাগাভাগি করতে চাই একটু।

১. আগের একটি লেখায় নির্বাচন কমিশন সম্পর্কে লিখেছিলাম যে, এদেশের সংবিধান ক্ষমতাসীন সরকারকে একচ্ছত্র অধিকার দিয়েছে নির্বাচন কমিশন গঠনের। রাষ্ট্রপতি চাইলেই একজন প্রধান নির্বাচন কমিশনারের নেতৃত্বে আরো চার জন নির্বাচন কমিশনার দিয়ে একটি নির্বাচন কমিশন গঠন করতে পারেন। তাতে কারোরই কিছুই বলার নেই, বলার থাকে না। যেমনটি করেছিলেন বেগম জিয়া ও তার রাষ্ট্রপতি আব্দুর রহমান বিশ্বাস এবং ইয়াজ উদ্দিন আহমদ। কোনো আলোচনা-বৈঠক, মতামতের তোয়াক্কা না করেই একদিন নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রজ্ঞাপন জাতি জানতে পেরেছিল। বলাই বাহুল্য আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো সে নির্বাচন কমিশন মেনে নেয়নি। গড়ে উঠেছিল তুমুল গণআন্দোলন এবং সে আন্দোলনের ফলাফল নিয়ে নতুন করে কিছুই আর বলার নেই।

২. ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে প্রথমে যে নির্বাচন কমিশন গঠনের সুযোগ পায় তখনই রাষ্ট্রপতিকে দিয়ে সকল দলের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে একটি নির্বাচন কমিশন গঠন করেছিল। এবং অত্যন্ত সুখকর বিষয় হলো, আওয়ামী লীগের সেই আমলে গঠিত নির্বাচন কমিশন নিয়ে বিএনপি-সহ তৎকালীন বিরোধী দলগুলোর কোনো রকম আন্দোলন সংগ্রাম করতে দেখা যায়নি। ফলে ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচন শান্তিপূর্ণ ভাবেই অনুষ্ঠিত হয় বলে সর্বত্র প্রশংসিত হয়েছিল।

৩. অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে একথা আমাদের বলতেই হচ্ছে যে, বিএনপি আমলে গঠিত নির্বাচন কমিশন ও তাদের দ্বারা অনুষ্ঠিত নির্বাচন নিয়ে (তা যতোই ভয়াবহ কারচুপির হোক না কেন) কোনো বিদেশি দেশ বা সংস্থা টু-শব্দটি করেনি। এমনকি ২০০১ সালের যে নির্বাচনকে দেশে-বিদেশে সর্বত্র প্রশংসা করা হয়ে থাকে সেই নির্বাচনেও যে সেনাবাহিনীকে কী ভাবে বিএনপি-জামায়াত জোটের বিজয়ের পক্ষে কাজ করানো হয়েছিল, তা সেই নির্বাচনে যারা পর্যবেক্ষক ছিলেন তারা নিশ্চিত ভাবে জেনেও চুপ করে গিয়েছিলেন।

৪. আবারও সেই পুরোনো কথা বলতেই হচ্ছে যে, বিএনপি-জামায়াত আমলে গঠিত নির্বাচন কমিশনগুলোর কোনোটিই আলোচনা-মতামতের ভিত্তিতে গঠিত হয়নি। ফলে তা নিয়ে শুরু থেকেই বিতর্ক তৈরি হয় এবং স্বাভাবিক ভাবেই সে আমলে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলিও বিতর্কিত হয়ে পড়ে।

৫. বিএনপি-জামায়াত দ্বারা গঠিত নির্বাচন কমিশন বাতিল করে যে নতুন নির্বাচন কমিশন ১/১১-র সরকারের আমলে গঠিত হয় তাদের সম্পর্কে আজকে আমরা অনেক ভালো ভালো কথা শুনে থাকি। বিশেষ করে অনেকেই তাদেরকে মনে করেন আদর্শ নির্বাচন কমিশন। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে, ১/১১-সরকারের আমলে গঠিত নির্বাচন কমিশন ক’জন দল-নিরপেক্ষ ব্যক্তি ছিলেন, তা নিয়ে আজ আলোচনা হতে পারে। কারণ আমরা দেখেছি দায়িত্ব পালন শেষে তারা যখন সাধারণ জীবনে ফিরে গেছেন তখন টেলিভিশন-আলোচনায় কিংবা সংবাদপত্রে কলাম লিখে তাদের কেউ কেউ নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থানের প্রমাণ দিয়েছেন আমাদের। দায়িত্ব পালন করার সময়ও তারা কতটুকু নিরপেক্ষ ছিলেন সে বিষয় নিয়েও প্রশ্ন তোলার সুযোগ তৈরি হয়েছে তার ফলে। কিন্তু একথা নির্দ্বিধায় বলতেই হবে যে, ১/১১-র সরকার রাজনৈতিক ভাবে ব্যর্থ হওয়ার পর একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বিদায় না নিলে তাদেরকে আরো ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হতো এবং হয়তো বাংলাদেশেও গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি হতো, ফলে একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে তারা বাধ্য হয়েছিল। সেই বাধ্যতার জন্য অবশ্যই আমরা দেশের সেনাবাহিনীকে ধন্যবাদ দিতে পারি কারণ সেই সময়ের নির্বাচন কমিশন পরিচালিত হয়েছিল সেনাবাহিনীর পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে, কোনো রাজনৈতিক দলীয় সরকারের অধীনে নয়। ফলে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব হয়েছিল। যদিও বিএনপি-জামায়াত ২০০৮ সালের নির্বাচনকে নিয়েও প্রশ্ন তুলতে দ্বিধা করেনি। অর্থাৎ নির্বাচনে পরাজিত হলেই সে নির্বাচন সুষ্ঠু নয়, এরকম একটি প্রবণতা আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতর লক্ষ্য করা যায়। এই প্রবণতা থেকে কোনো রাজনৈতিক দলই মুক্ত নয়।

৬. ২০০৮ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর আওয়ামী লীগ আরেকটি নির্বাচন কমিশন গঠনের সুযোগ লাভ করে। তখনও রাষ্ট্রপতির নির্দেশনায় একটি সার্চ কমিটি গঠন করা হয়। সেখানে নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করেন রাষ্ট্রপতি স্বয়ং। বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া বঙ্গভবনে গিয়ে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করেন (যে দৃশ্য আমরা তার আমলে কখনই দেখিনি যে, শেখ হাসিনা বঙ্গভবনে গিয়ে তার আমলের কোনো রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আলোচনা করার সুযোগ পেয়েছেন) এবং নির্বাচন কমিশন গঠনে তাদের বক্তব্য জানান। যথাসময়ে সার্চ কমিটি তাদের পরামর্শ প্রদান করে এবং একটি নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়।

বিএনপি-জামায়াত জোট সেই নির্বাচন কমিশনকে মেনে না নিলেও তাদের বলার মতো জায়গা খুব সামান্যই থাকে সেখানে, তবু তারা আন্দোলনে নামে নির্বাচন কমিশন বাতিলের দাবিতে। দেশব্যাপী জ্বালাও-পোড়াও শুরু হয়, পেট্রোল বোমায় জীবন যেতে থাকে সাধারণ মানুষের। দেশের ভেতরে এই সন্ত্রাসী তৎপরতা এবং বিদেশিদের নিয়ে দেশের বিরুদ্ধে যে ষড়যন্ত্র ২০১২ সাল থেকে জাতি প্রত্যক্ষ করেছে তার তুলনা বোধকরি এদেশে আর কখনও পাওয়া যাবে না, না অতীতে, না ভবিষ্যতে। কিন্তু তারপরও যে নির্বাচন কমিশন রকিবউদ্দিনের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিল তাদেরকে একটি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে হয় সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য। সে নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত অংশ নেয়নি ঠিকই কিন্তু সে নির্বাচনকে ঠেকাতে বিএনপি-জামায়াত যে সন্ত্রাসী তৎপরতার আশ্রয় নেয় তা কেবল নিন্দনীয়ই ছিল না, ছিল ফৌজদারী অপরাধও।

৭. রকিবউদ্দিনের নেতৃত্বে গঠিত নির্বাচন কমিশন কেমন ছিল? এমন প্রশ্ন নিয়ে প্রায়শঃই বিভিন্ন টক শো’তে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারী সংস্থার প্রধান এবং বিভিন্ন বিদেশি সাহায্যপুষ্ট বেসরকারি সংস্থার প্রধানগণ বলেছেন যে, প্রথম দিকে রকিবউদ্দিন কমিশন বেশ কয়েকটি ভালো নির্বাচন উপহার দিলেও ক্রমশঃ তার নেতৃত্বে নির্বাচন কমিশন নতজানু নির্বাচন কমিশনে পরিণত হয়েছিল। যে ক’টি নির্বাচনকে ‘ভালো’ বলা হচ্ছে, বলাই বাহুল্য সে নির্বাচনগুলিতে বিএনপি-জামায়াত প্রার্থীরা বিজয় লাভ করেছে। কিন্তু যখন উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনের মতো স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে তখন রকিব-কমিশনের নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়। কিন্তু সেজন্য কি নির্বাচন কমিশন একাই দায়ী? রাজনৈতিক দলগুলোর দায় ও দায়িত্ব কি কম? মোটেও তা নয়। সম্প্রতি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের একজন সাবেক উপদেষ্টা বলেছেন যে, নির্বাচন কমিশন কখনও খারাপ হতে পারে না, তাদেরকে খারাপ করা হয়। যদিও এই বক্তব্যটির সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে একমত পোষণ করার কোনো কারণ নেই, কারণ বিচারপতি রউফ, এম এ আজিজের মতো নির্বাচন কমিশন দিয়ে কোনো ভাবেই সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভবপর ছিল না। তবে এটাও সত্যি যে, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের যদি সদিচ্ছা না থাকে তাহলেও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান কঠিন হয়ে পড়ে। রকিব কমিশনের ক্ষেত্রে বিষয়টি কঠিন হলেও দুরূহ হয়নি যার প্রমাণ আমরা পাই নারায়ণগঞ্জ নির্বাচনে, যেখানে সকল পক্ষের অংশগ্রহণে একটি অত্যন্ত সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান করে বিদায়ী রকিব কমিশন প্রমাণ করে যে, সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে তাদের আন্তরিকতার কোনো অভাব ছিল না। এবং আমাদের একথাও স্বীকার করতে হবে যে, এক্ষেত্রে সরকারেরও আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার অভাব ছিল না।

৮. ফিরে আসি শুরুর বক্তব্যে। কেন রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ পরিপক্কতার পরিচয় দিয়েছে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনে? আর এর ভবিষ্যৎ প্রভাবই বা কী হতে যাচ্ছে? প্রথমতঃ এবারও নির্বাচন কমিশন গঠনে রাষ্ট্রপতি নির্দেশিত সার্চ কমিটি সকল দলের মতামতের ভিত্তিতে একটি নির্বাচন কমিশন প্রস্তাব করে এবং রাষ্ট্রপতি তার থেকে বাছাই করে সাবেক সচিব নুরুল হুদার নেতৃত্বে একটি নির্বাচন কমিশন গঠনের নির্দেশনা দিয়েছেন। তার আগে রাষ্ট্রপতি আবারও বেগম জিয়াসহ সকল রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। পরামর্শ নিয়েছেন সার্চ কমিটি ও নির্বাচন কমিশন গঠনে। ফলে প্রাথমিক ভাবে এই নির্বাচন কমিশন গঠন প্রক্রিয়া নিয়ে কারোরই কোনো দ্বিমত থাকার কথা নয়। সংবিধানে না থাকলেও আওয়ামী লীগ এই উদারতা একেবারে নিয়মে পরিণত করেছে এবং এবার সেটি আরো প্রতিষ্ঠিত হলো। দ্বিতীয়তঃ সার্চ কমিটির কাছে রাজনৈতিক দলগুলোর দেয়া নামের তালিকা থেকেই নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, ফলে রাজনৈতিক দলগুলো চাইলেই তা অস্বীকার করতে পারবে না। প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের তালিকায় ছিলেন না। ফলে একথাও কেউ বলতে পারবেন না যে, তিনি আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন। মজার ব্যাপার হলো, এমন সব ব্যক্তিবর্গকে এই কমিশনে স্থান দেওয়া হয়েছে যারা আসলে তেমন পরিচিত মুখ নন এবং তাদের সম্পর্কে কোনো ধরনের বিতর্কও এ পর্যন্ত শোনা যায়নি। ফলে তাদের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ খুব একটা নেই বললেই চলে।

৯. বিএনপি-জামায়াত এখনও আনুষ্ঠানিক কোনো প্রতিক্রিয়া দেয়নি, তবে বিভিন্ন গণমাধ্যম তাদের নেতিবাচক চিন্তার বিষয়টি উল্লেখ করেছে। জনগণ দেখেছে যে, এই নির্বাচন কমিশন গঠন প্রক্রিয়াটি কোনো ভাবেই অস্বচ্ছ ছিল না এবং এতে কোনো রাজনৈতিক  দলের মতামতকেই অগ্রাহ্য করা হয়নি। ফলে বিএনপি’র নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া (যদি আসে) ধোপে টিকবে বলে মনে হয় না। তবে বিএনপি যদি এই নির্বাচন কমিশনকে মেনে নিয়ে তাদেরকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয় তাহলে ইতিবাচক রাজনৈতিক ধারায় ফেরার জন্য দলটি জনগণের নেকনজরে ফিরবে তাতে কোনোই সন্দেহ নেই।

১০. নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটেছে। এখন অপেক্ষা একটি সাধারণ নির্বাচনের। আশাকরি দেশের স্বার্থে, জাতির স্বার্থে, গণতন্ত্রের স্বার্থে একটি সুষ্ঠু ও অবাধ জাতীয় নির্বাচন এই কমিশন আমাদের উপহার দিতে সক্ষম হবে। তবে তা করতে হলে, কথা নয়, কাজ দিয়েই সেটা জাতিকে উপহার দিতে হবে। অভিনন্দন নতুন নির্বাচন কমিশন।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।
[email protected]

এইচআর/এমএস

আরও পড়ুন