বিতর্কের গ্রহণ ঢাকতে পারবে না সূর্যের আলো
অনেকদিন ধরেই সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত অসুস্থ ছিলেন। মাঝে মধ্যেই ল্যাবএইড হাসপাতালে ভর্তি হতেন। অসুস্থতার কারণে একাধিকবার কথা দিয়েও আমাদের টক শোতে আসতে পারেননি। তেমনি একবার যখন সুরঞ্জিতদা নির্ধারিত অনুষ্ঠান বাতিল করলেন অসুস্থতার কথা বলে, মুন্নী বললো, চল দাদাকে দেখে আসি। বিনা নোটিশে গিয়ে হাজির হলাম।
প্রথমে বলা হলো, দাদা অসুস্থ, কারো সাথেই দেখা হবে না। কিন্তু আমাদের আসার খবর পেয়ে কিছুক্ষণ পর দাদা নেমে এলেন। তারপর অসুস্থতা ভুলে চললো দীর্ঘ আড্ডা। ব্যক্তিগত নানা প্রসঙ্গের সাথে উঠে এলো, রাজনীতির নানা প্রসঙ্গও। বৌদি আদর করে আম খাওয়ালেন। সেই শেষ দেখা। আমি আর মুন্নী ঘুরেফিরে দেখলাম দাদার ঝিগাতলার বাড়ি। পেছনের দিকটায় গ্রামীণ আবহ। গাছপালায় সবুজ। ঝিগাতলার এই বাড়িটি বাংলাদেশের রাজনীতির অনেক ইতিহাসের সাক্ষি। দিনভর গমগম করতো। এলাকার মানুষ, দলের নেতাকর্মী, বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ আর মিডিয়া কর্মীদের নিত্য আনাগোনা। সদা সক্রিয় সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মিডিয়ায় অনুপস্থিতি দেখেই টের পাচ্ছিলাম দাদা আসলে ভালো নেই।
শনিবার সন্ধ্যায় খবর পেলাম, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত আবার ল্যাবএইডে ভর্তি হয়েছেন। রাত ১১টার দিকে ফেসবুকে একের পর এক স্ট্যাটাস ‘সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত আর নেই’। চমকে গেলাম। ল্যাবএইডে থাকা আমাদের রিপোর্টার মহসিন কবিরকে ফোন করে জানলাম, দাদা লাইফ সাপোর্টে আছেন। তাকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে বাইরে নেয়ার চেষ্টা চলছে। তবে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে তোলার মত অবস্থা তার ছিল না। কথা ছিল সকাল ৮টায় মেডিকেল বোর্ড তার শারীরিক অবস্থা পর্যালোচনা করবেন। কিন্তু সে সুযোগ আর দিলেন না দাদা। ফেসবুকে মেরে ফেলার পরও অন্তত ৫ ঘণ্টা বেঁচে ছিলেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। ভোর ৪টা ২৪ মিনিটে রাজনীতিতে একটা অপূরণীয় শূন্যতা তৈরি করে পরলোকে গেলেন বাবু সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত।
এলাকার মানুষ তাকে ডাকতো সেনদা, ঢাকায় আমরা ডাকতাম সুরঞ্জিতদা। জীবনের শেষ বেলায় কিছু অনাকাঙ্খিত বিতর্কে জড়ালেও সুরঞ্জিতদা ছিলেন বাংলাদেশের রাজনীতির এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। ষাটের দশকের যে তরুণ প্রজন্ম উদার, ধর্মনিরপেক্ষ, শোষণহীন সমাজ গড়ার আকাঙ্খাকে একটি স্বাধীন দেশ গড়ার বাস্তবতায় নিয়ে গিয়েছিলেন; সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ছিলেন তাদের একজন। ৭০এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রবল জোয়ারেও সুনামগঞ্জের দিরাই থেকে উঠে এসেছিল এক তরুণ। মাত্র ২৫ বছর বয়সে তিনি এমএলএ নির্বাচিত হয়েছিলেন ন্যাপ থেকে। তারপর মুক্তিযুদ্ধ। নয়মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে অর্জিত দেশ গঠনের পালা। যে স্বপ্ন তারা দেখেছিলেন, এবার তা বাস্তবায়নের পালা।
সংবিধান প্রণয়নে গঠিত কমিটিতে ছিলেন তরুণ সুরঞ্জিত। সংবিধানের মূলনীতিতে সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার অন্তর্ভুক্তিতে তার অবদান ছিল অনেক। সমাজতন্ত্রের স্বপ্নে বিভোর সুরঞ্জিত সংবিধানকে আরো অনেক বেশি সমাজতান্ত্রিক করতে চেয়েছিলেন। যার সবগুলোর ঠাঁই হয়নি। তাই প্রণয়ন কমিটিতে থাকলেও চূড়ান্ত সংবিধানে সই করেননি প্রতিবাদী সুরঞ্জিত। ৭৩ সালের সংসদও ছিল আওয়ামী অধ্যুষিত। তখনও সুরঞ্জিত একতা পার্টির সাংসদ। সংসদে সোচ্চার কণ্ঠ। একাই যেন একশো। বিরোধী দলে থাকলেও বঙ্গবন্ধু চিনতে ভুল করেননি প্রতিভাবান এই তরুণকে।
আওয়ামী লীগে যোগ দেয়ার আগ পর্যন্ত তিনি ছিলেন ছোট দলের বড় নেতা। কখনো ন্যাপ, কখনো একতা পার্টি, কখনো গণতন্ত্রী পার্টির হয়ে সংসদে প্রতিনিধিত্ব করেছেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। যে দলেই থাকুন, দল নয়, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত একাই একশো, নিজেই হয়ে উঠেছিলেন একটি প্রতিষ্ঠান। বড় দল আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েও তিনি ছিলেন বড় নেতা। তবে জীবনের একমাত্র পরাজয়ের তেতো স্বাদ তিনি পেয়েছিলেন বড় দলে যোগ দেয়ার পর। ৯৬ সালের সপ্তম সংসদে প্রথমে তিনি হেরে গিয়েছিলেন। পরে অবশ্য হবিগঞ্জের একটি আসন থেকে উপ-নির্বাচনে জিতে সংসদে এসেছিলেন। দায়িত্ব পেয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রীর সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টার।
আমি তখন ভোরের কাগজের ছোট রিপোর্টার। বিট সংসদ। তাই সারাদিন কাটতো সংসদে। সংবিধান, কার্যপ্রণালী বিধি বা সংসদীয় কোনো রীতি না বুঝলে চলে যেতাম দাদার রুমে। দাদা স্নেহে, প্রশ্রয়ে কঠিন সব বিষয় বুঝিয়ে দিতেন জলের মত তরল করে। আমিও ছাত্রের নিষ্ঠায় বুঝে নেয়ার চেষ্টা করতাম। সংবিধান প্রণেতার কাছ থেকে সংবিধান বোঝা ভাগ্যের ব্যাপার। আমি অবশ্যই ভাগ্যবান। ধন্যবাদ সুরঞ্জিতদা।
বহুল আলোচিত, সমালোচিত ওয়ান-ইলাভেন বাংলাদেশের রাজনীতিতে অনেক ওলটপালট করে দিয়েছে। সেই ঝড়ের ঝাপটা লেগেছে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারেও। সংস্কারপন্থীর তকমা রাজনীতির কেন্দ্র থেকে অনেকটাই দূরে সরে যান। আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলী থেকে ঠাঁই হয় উপদেষ্টামণ্ডলীতে। দল ক্ষমতায় গেলেও সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মত অভিজ্ঞ লোক থেকে গেলেন বাইরে। ক্ষমতার বাইরে থাকলেও বিবেকের বাইরে থাকেননি কখনো। এমনকি ভুল করলে নিজ দলের তীব্র সমালোচনা করতেও পিছপা হননি।
আওয়ামী লীগের গত মেয়াদের শেষ দিকে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। কিন্তু এই দায়িত্বেই তার দীর্ঘ ক্যারিয়ারে সবচেয়ে বড় কলঙ্কের দাগ লাগে। তার এপিএস এর গাড়ি থেকে ৭০ লাখ টাকা উদ্ধারের ঘটনায় সমালোচনার ঝড় ওঠে দেশজুড়ে। সেই ঝড় এলোমেলো করে দেয় সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের অনেক অর্জন। সমালোচনার মুখে মন্ত্রণালয় হারান তিনি। গত মেয়াদের শেষ সময়টা ছিলেন দপ্তরবিহীন মন্ত্রী। এই মেয়াদে ঠাঁই হয়নি মন্ত্রিসভায়। এই অবহেলা আর অসুস্থতায় সবকিছু থেকে কিছুটা বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। তবে শেষ সময়ের এই অপ্রমাণিত বিতর্কের গ্রহণ ঢাকতে পারবে না সূর্যের মত উজ্জ্বল সুরঞ্জিতদার দীর্ঘ ক্যারিয়ার।
তবে সংস্কারপন্থী, মন্ত্রিসভায় থাকা না থাকা, সভাপতিমণ্ডলী থেকে উপদেষ্টামণ্ডলীতে ডিমোশন, বিতর্ক- এসব দিয়ে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে মাপা যাবে না। তিনি বাংলাদেশের সেরা পার্লামেন্টারিয়ান, উপমহাদেশেরই অন্যতম সেরা। সংসদীয় বিতর্কে তার বক্তব্য শোনা ছিল দারুণ আনন্দময় অভিজ্ঞতা। এখন সাংসদরা সংসদকে অশ্লীল গালাগালির আখড়া বানিয়ে ফেলেছেন। কিন্তু সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত দেখিয়ে দিয়ে গেছেন- একটিও গালি না দিয়ে কিভাবে যুক্তি দিয়ে, তথ্য দিয়ে, রেফারেন্স দিয়ে, হাস্যরস দিয়ে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা যায়।
শুনতাম আর ভাবতাম, কিভাবে সম্ভব, এত অল্প সময়ে তাৎক্ষণিকভাবে এমন অসাধারণ বক্তব্য দেয়া। কখনো কখনো প্রতিপক্ষও মুগ্ধ হয়ে শুনতো তার কথার জাদু। দুঃখ একটাই তার কাছ থেকে আমাদের সাংসদরা শেখেননি তেমন কিছু।
প্রচুর পড়াশোনা, দীর্ঘ অভিজ্ঞতা, প্রজ্ঞা, কথা বলার অনন্য স্টাইলের সাথে প্রখর সেন্স অব হিউমারের মিশেল তাকে আসলে অননুকরণীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছে। বাংলাদেশে আর একজনও সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত নেই। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তরা আসলে ক্ষণজন্মা, তাদের বানানো যায় না। ৭ বার এমপি হয়েছেন, প্রজ্ঞায়-পড়াশোনায় হিমালয়সম হলেও সংসদ লাইব্রেরি থেকে সবচেয়ে বেশি বই ইস্যু করাদের তালিকায় শুরুর দিকেই থাকতো তার নাম। ভাবা যায়?
সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের ৭২ বছরের জীবনে অনেক অনেক অর্জন যেমন আছে, নিশ্চয়ই কিছু গ্লানিও আছে। তিনিও একজন মানুষ। মানবিক ভুল-শুদ্ধ মানুষেরাই করে; ফেরেশতা বা রোবট করে না। তবে আমি তার সবচেয়ে বড় অর্জন বলে মানি, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের চেতনাকে হৃদয়ে ধারণ করাকে। সংবিধান প্রণয়নের সময় যেমন ছিলেন, ৭২এর সংবিধানে ফিরে যাওয়ার গুরুদায়িত্বটা পড়ে তার কাঁধেই। বাংলাদেশের সংবিধান বিশ্বের অন্যতম সেরা। কিন্তু ৭৫এর পর ক্যান্টনমেন্ট থেকে আসা শাসকরা সংবিধানকে বুটদলিত করেছে, বারবার কাটাছেঁড়া করেছে। সেই ক্ষত পোষানোর দায়িত্ব সুচারুভাবেই পালন করেছেন সুরঞ্জিতদা। ধর্ম নিরপেক্ষতা আবার ফিরে এসেছে সংবিধানে। যদিও রষ্ট্র ধর্ম ইসলাম এখনও রয়ে গেছে। ভোটের হিসাব-নিকাশে এভাবেই সুরঞ্জিত সেনগুপ্তদের শুভ ইচ্ছা মার খেয়ে যায়।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সারাজীবন মানুষের জন্য রাজনীতি করেছেন; চেয়েছেন একটি উন্নত, সমৃদ্ধশালী, বৈষম্যহীন, শোষণহীন অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ। তেমন বাংলাদেশ গড়তে পারলেই সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের স্মৃতির প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা জানানো হবে।
৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭
[email protected]
এইচআর/এমএস