চলো যাই বইমেলায়
ছোটবেলা থেকেই মেলা শব্দটা আমার খুব প্রিয়। ছোটবেলায় যেতাম ঈদের মেলায়। মহরমের মেলাতেও গিয়েছি অনেক বার। রথের মেলা, পূজার মেলাতেও দারুণ মজা। বৈশাখী মেলাতে সবসময়ই যাওয়া হয়। তবে যে যাই বলুক আমার কাছে চিরদিনই মেলার সেরা হলো বইমেলা। বিশেষ করে বাংলা একাডেমির অমর একুশে গ্রন্থমেলা চিরদিনই আমাদের বড় আপন।
সেই কোন ছোটবেলায় বাবার হাত ধরে বাংলা একাডেমির বইমেলায় যেতাম। তখন তা এত বিশাল ছিল না। তখন মুক্তধারা এবং আরও কয়েকটি প্রকাশনীর স্টল বসতো। তারপর ধীরে ধীরে মেলার পরিসর বাড়লো। নব্বই দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তো ফেব্রুয়ারি মাসের প্রতিদিনই বইমেলায় এক চক্কর ঘুরতাম। বাংলা একাডেমির তরুণ লেখক প্রকল্পে কাজ করার সময় মনে হতো বইমেলাই আমাদের ঘরবাড়ি।
বইমেলায় আমিও একসময় নিজস্ব স্টল থেকে নিজের কবিতার আবৃত্তির ক্যাসেট বিক্রি করেছি। সেসময় বইমেলা টিএসসি থেকে শুরু হয়ে দোয়েল চত্বর পর্যন্ত চলে যেত। দেদারসে আবৃত্তির ক্যাসেট বিক্রি হতো মেলায়। সেটা কবিতা চর্চা এবং আবৃত্তি চর্চার জন্য বেশ ইতিবাচক একটা বিষয় ছিল। অবশ্য সে সময় মেলাটা অন্য অনেক কিছুর স্টল নিয়ে প্রায় বারোয়ারি মেলার চেহারা ধরেছিল। সেটা বইয়ের বিক্রিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছিল। তারচেয়েও আপত্তিজনক একটা বিষয় ছিল মেলার খাবারের স্টলের নাম। ‘খাবি না ক্যান খা’, ‘আয় মন প্যাঁচ খাই’ ইত্যাদি নামের স্টলগুলো ঠিক একুশের মেলার ভাব গাম্ভীর্যের সঙ্গে মানানসই ছিল না। এগুলো বাদ দেয়ার জন্য একাডেমির সিদ্ধান্তকে আমি সঠিক বলেই মনে করি। তবে আবৃত্তির ক্যাসেট বিক্রির স্টলগুলো আবার ফিরিয়ে আনা যায় কি না সে বিষয়টি কর্তৃপক্ষ বিবেচনা করতে পারে। তাহলে বাংলাদেশে আবৃত্তি চর্চা এবং কবিতার জনপ্রিয়তা অনেক বেশি বাড়তো।
বইমেলা এখন বাংলা একাডেমির প্রাঙ্গণ ছাড়িয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ছড়িয়ে পড়েছে। এত বড় মেলা, প্রচুর স্টল। লোক সমাগমও কম নয়। তবে সেই তুলনায় বিক্রি বড় কম। যত লোক বইমেলায় আসে তাদের সবাই যদি একটি করে বই কিনতো তাহলে মেলায় একটি বইও অবিক্রিত থাকার কথা নয়। কিন্তু অধিকাংশই আসে ঘুরতে, সময় কাটাতে, ফুচকা চটপটি, ঝালমুড়ি খেতে। যারা বইমেলায় প্রতিদিন বা অন্তত একদিনও আসেন তাদের প্রতি আহ্বান বই কিনুন। প্লিজ অন্তত একটা বই হলেও কিনুন।
ঢাকা শহরে যত স্কুলপড়ুয়া শিশুকিশোর আছে তাদের সবাইকে কি বাবামায়েরা বইমেলায় নিয়ে গেছেন? যেসব গৃহবধূরা টিভি সিরিয়ালে মগ্ন হয়ে থাকেন তারা সবাই কি বইমেলায় গিয়ে বই কিনেছেন? বা কেনার পরিকল্পনা করেছেন?
না, আমি তাদের ইতিহাস ও সমাজতত্বের গুরুগম্ভীর বই কেনার আহ্বান জানাচ্ছি না। যার যেমন অভিরুচি তেমন বইই নাহয় তিনি কিনুন। খুব হালকা টিনএজ প্রেমের বই, রান্নার রেসিপি, রূপচর্চা, জোকসের বই যাই হোক না কেন, যে টিভি সিরিয়ালগুলো তারা দেখেন তার চেয়ে অন্তত মন্দ হবে না। আর শিশু কিশোরদের বই কিনে দিতে বাবা-মাকে আহ্বান জানাচ্ছি এই লেখার মাধ্যমে।
আমি যখন ছোট তখন মুনতাসীর মামুনের ‘অ্যান্ডারসনের গল্প’, ‘দ্বীপ দ্বীপান্তর’, শাহরিয়ার কবিরের ‘নুলিয়াছড়ির সোনার পাহাড়’, মুহম্মদ জাফর ইকবালের ‘হাতকাটা রবিন’, ‘কপোট্রনিক সুখদুঃখ’, ‘মহাকাশে মহাত্রাশ’ হায়াৎ মামুদের রবীন্দ্রনাথের কিশোর জীবনী, হালিমা খাতুনের ‘কাঁঠাল খাবো’, ‘হরিণের চশমা’ ইত্যাদি বই, মেলায় ছোটদের মন কেড়ে নিত। মোহাম্মদ নাসির আলী, সাজেদুল করিমের মতো শিশুসাহিত্যিককে একালের শিশুরা কতটা চেনে আমি জানি না। তবে আমরা চিনতাম। এখলাস উদদীন আহমেদের বইও খুব জনপ্রিয় ছিল।
মুক্তধারা থেকেও বের হতো অনেক বই। আর সেবা প্রকাশনীর বই ২০ শতাংশ ছাড়ে কেনার আকর্ষণ তো থাকতই। দু’হাত বোঝাই করে বই কিনতাম আমরা দু’ভাইবোন। বাবা যে খুব ধনী মানুষ ছিলেন তা নয়। সাধারণ মধ্যবিত্ত। কিন্তু বই কেনার বেলায় কখনও আঁটসাঁট করতেন না। শুধু বইমেলা নয়, অন্য সময়েও প্রচুর বই কিনতাম আমরা। স্টেডিয়ামে আইডিয়াস ম্যারিয়েটা, স্ট্যান্ডার্ড পাবলিশার্স আর নিউমার্কেটের বইয়ের দোকানগুলো ছিল লোভনীয় বেড়ানোর জায়গা। সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে প্রকাশিত ছোটদের বইগুলো কিনতাম দেদার। একালের শিশুকিশোরদের মতো ফাস্টফুডের পিছনে আমাদের টাকা ব্যয় হতো না। ব্যয় হতো বই কিনে, বই সংগ্রহ করে। জন্মদিনেও আমরা বই উপহার পেয়ে খুশি হতাম।
বাবা মায়েরা যদি শিশুকে সঙ্গে নিয়ে বইমেলায় যান, তাদেরকে বই কিনে দেন তাহলে বইপড়ার সুঅভ্যাস গড়ে উঠবে। যা পরবর্তীকালে অনেক কঠিন সামাজিক ও পারিবারিক সমস্যার সৃষ্টি হওয়াকে রোধ করবে। আর একালের অভিভাবকরা নিজেরাও যদি বই কেনেন, বই পড়েন তাহলেও ছোটরা দেখে শিখবে। এখন তো মেলায় শিশুদের জন্য আলাদা কর্নার থাকে। শিশুদের জন্য বিশেষ দিনও থাকে। বইমেলায় গেলে প্রিয় লেখকের সঙ্গে দেখা হওয়ার সম্ভাবনাও থাকে। সেটাও কম লোভনীয় নয়।
বইয়ের চেয়ে বড় বন্ধু আর কেউ নেই। আমার বেলায় অন্তত একথা ষোলআনা সত্যি। খুব ছোটবেলাতেই বইকে ভালোবাসতে শিখেছিলাম, বই পড়ে আনন্দ পেতে শিখেছিলাম বলেই জীবনে কোনোদিন একাকীত্ব গ্রাস করতে পারেনি। বইয়ের সঙ্গে শিশুর এই বন্ধুত্বটা গড়ে দেয়ার কাজটা বাবা-মা সবচেয়ে ভালোভাবে করতে পারেন। তাই চলুন বইমেলায় শিশুকে সঙ্গে নিয়ে। বইয়ের ভুবনে ওকে বন্ধু খুঁজে নিতে দিন। ফেব্রুয়ারি আমাদের ভাষার মাস। বাংলাভাষাকে, মাতৃভাষাকে ভালোবাসতে শিখুক আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম। তবেই একুশের চেতনা অমর হবে।
লেখক : কবি, সাংবাদিক।
[email protected]
এইচআর/এমএস