বাংলা ভাষার বসন্ত
ফেব্রুয়ারি এসেছে, ভাষার মাস চলছে, বইমেলাও চলছে। প্রতিদিন কত যে আলোচনা, কত যে বক্তৃতা, বিবৃতি। এই মাসটাও বসন্তের। তাই বলে কি বাংলা ভাষার গায়ে এখন বসন্তের ফুরফুরে হাওয়া? সেটা বলা যাচ্ছেনা।
স্বাধীনতার আগে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা ও সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেয়ার দাবিতে আন্দোলনের কথা বিষদ বলার প্রয়োজন দেখছি না। শুধু এটুকু বলছি যে, ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে ভাষার জন্য জীবন দেয়ার পর রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও রাষ্ট্রীয় কার্য সম্পাদনে বাংলা ভাষা ব্যবহার বাঙালি দেখেনি পুরোপুরি। যেখানে সেখানে, এমনকি মুদির দোকানের নামও ইংরেজি ভাষায়। প্রধান কারণ শিক্ষাব্যবস্থা। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি ভাষা যতটা মর্যাদার সাথে চর্চা করা হয়, বাংলা ততটাই অবহেলিত।
১৯৭২-এর সংবিধানে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দেয়া হয়েছিল। ১৯৭৩ সালে ফেব্রুয়ারির প্রথম দিন সেসময়ের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি আদেশ দিয়েছিলেন। এ আদেশ অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী সমীপে পেশকৃত সব নথি বাংলায় লিখতে হবে। সিদ্ধান্তটি প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় সব মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে প্রেরণ করে। এ সিদ্ধান্তে অন্য একটি বিষয়ও ছিল। রাষ্ট্রীয় কার্য সম্পাদনে সব ধরনের ফর্ম ও অন্যান্য দলিল বাংলায় ছাপাতে হবে। এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে কিছু বাধাবিপত্তিও ছিল। প্রধান বাধা ছিল বাংলা টাইপরাইটারের স্বল্পতা। ব্যবহৃত ইংরেজি শব্দের বিপরীতে সঠিক বাংলা শব্দ ব্যবহারের বিষয়টিও ছিল অন্য একটি বাধা। আর ছিল ভাষাগত বিভ্রান্তি। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৫ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি প্রশাসনিক পরিভাষা প্রকাশ করা হয়।
১৯৮৭ সালে সব ধরনের সরকারি অফিসে বাংলা ভাষা আইন করে বাধ্যতামূলক প্রচলনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। আইনে এ কথাও বলা হয়েছিল যে এর কোনো ব্যত্যয় ঘটলে তার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে অভিযুক্ত হবেন। আইনের আওতায় প্রয়োজনীয় বিধি প্রণয়নের বিষয়ও উল্লেখ করা হয়েছিল। সংশ্লিষ্ট আইনে এ বিধানও করা হয় যে যদি কোনো ব্যক্তি কোনো বিষয়ে প্রতিকারমূলক সরকারি সিদ্ধান্ত প্রত্যাশা করে, তাহলে আবেদনটি বাংলায় না লেখা হলে তা অগ্রাহ্য করা হবে।
রাষ্ট্রীয় কার্য সম্পাদনে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করার অর্থ এই নয় যে, সরকারি কর্মকর্তাসহ সাধারণ মানুষ ইংরেজি বা অন্য বিদেশি ভাষা শিখবে না বা জানবে না। ইংরেজি বা অন্য ভাষা জানা রাষ্ট্রীয় স্বার্থে দোষের কিছু নয়। কিন্তু সমস্যটা হলো, পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে, তাতে আমাদের প্রজন্ম না শিখছে ইংরেজি, না জানছে বাংলা।
বাংলা ভাষার স্থান পৃথিবীতে সপ্তম এবং বাংলা ভাষায় কথা বলা মানুষের সংখ্যা এখন ২৫ কোটিরও বেশি। প্রতিনিয়ত বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বাড়ছে। আমাদের ভেতর অনেককেই বলতে দেখি যে, ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলোতে বরাবরই বাংলাকে উপেক্ষা করে ইংরেজিকে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। তারা বাংলায় দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু যারা বাংলা মাধ্যমে পড়ছেন তারাও কি বাংলা ঠিকমতো শিখছেন?
যাদের বয়স কম তারা ভবিষ্যতে কোন ভাষা বেশি ব্যবহার করবে তার উপরেই ভিত্তি করে গড়ে ওঠে ভাষার ভবিষ্যৎ। বাংলাদেশে বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ তাই নির্ভর করছে তরুণ বাঙালিরা ভাষা নিয়ে কী ভাবছেন তার উপর। যে অর্থনৈতিক শ্রেণিরই অন্তর্গত হন না কেন, সকলেই কমবেশি স্বপ্ন দেখেন, নিজেদের ছেলেমেয়েকে ভাল করে পড়াশোনা শিখিয়ে মানুষ করবেন। এই স্বপ্নে ভাষার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।
আমরা যারা বাজার অর্থনীতির যুগ আসার আগে স্কুল কলেজ অতিক্রম করেছি তাদের স্মৃতিতে মুক্তিযুদ্ধ বড় বিষয়। তারা ভাষা আন্দোলেনের ইতিহাস যেভাবে জেনেছে, যে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের ভেতর দিয়ে গেছি আমরা, তার ছিটেফোটাও নেই এখন। পুরো সমাজ প্রতিক্রিয়াশীল সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক আদর্শে ডুবে আছে। আমরা এক রকম বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয় দেখে অভ্যস্ত ছিলাম যেখানে ইংরেজি-অঙ্কের ভিত পোক্ত হত। বাংলার পাশাপাশি পড়া আর লেখার ইংরেজি ভালই শেখানো হত বেশিরভাগ স্কুলে।
কোন এক সময় এক শ্রেণির বামপন্থি ইংরেজিকে বিদায় করতে চাইলো, বলতে চাইলো যে ইংরেজি বেনিয়াদের ভাষা। আর সেই থেকে ‘বড়লোক’ বাড়ির ছেলে-মেয়েদের জন্য ইংরেজিটাই হয়ে গেলো মাধ্যম। কিন্তু ইংরেজিতো বিদায় নিলোইনা, উল্টো হতভাগ্য গরিবেরা ইংরেজির চাপ সইতে থাকলো সব ক্লাশে। আর মধ্যবিত্ত উচ্চবিত্তকে ছুঁতে গিয়ে বেশি করে ছুটলো ইংরেজির পেছনে। ফলে এই ফাঁকে অজস্র নানা কিসিমের ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলে ভরে গেলো কেন্দ্র আর প্রান্তের সব জনপদ।
ইংরেজি যে শিখতে হবে, এ কথা খুব সাধারণ মানুষও বুঝে ফেলেছে। কিন্তু বাংলা জানতে হবে, সেটা আর অন্তরে ঢুকলো না। ইংরেজি আছে বাংলা মাধ্যমে, কিন্তু তা শুধু পরীক্ষা দেয়ার জন্য, শেখার জন্য নয়। আর বাংলা, সেতো শ্রেণি চরিত্রই হারিয়েছে। ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল রমরমা হচ্ছে, বাংলা ভাষার ব্যবহারযোগ্যতা কমছে অফিসে, আদালতে বিশেষ করে দ্রুত বর্ধমান কর্পোরেট চাকুরিতে। অভিভাবকরা ইচ্ছে থাকলেও এখন ছেলেমেয়েদের বাংলা মাধ্যমে পাঠাতে পারেন না। আর ভাল বাংলা মাধ্যম স্কুলই বা কোথায়? যে কয়েকটি নামকরা আছে সেখানে ভর্তি হওয়া কঠিন, হলেও আছে তথাকথিত ইংরেজি ভার্সনের হাতছানি। এমন এক বাস্তবতায় ইংরেজি মাধ্যমই অনিবার্য ভবিতব্য আমাদের।
বাংলা ভাষার সঙ্গে আমাদের ছেলেমেয়েদের যোগ কমছে। সবার চেষ্টা সন্তানকে বাইরে পাঠানোর। আর বাইরে যেতে গেলে যে ইরেজিটাই শিখতে হবে। তাই নজরটা সেদিকেই। আমাদের মাঝে অনেকেই বাংলায় ব্লগ লেখেন, ফেসবুক আর হোয়াট্সআপ চালান, বাংলা বই ভালবেসে পড়েন, বাংলা সংস্কৃতির দিনগুলোতে সেজে বের হন। তারা পড়েন, কিন্তু তাদের ছেলেমেয়েরা বাংলা পড়েনা। কেন পড়েনা সেই প্রশ্নের সদুত্তর দেয়া মুশকিল। শুধু আবেগে কাজ হবে না। বারবার বাংলায় বসন্ত আসে, কিন্তু ভাষার বসন্ত আসেনা। সেই বসন্ত আনার কথা সবাই মিলে ভাবি একটু।
লেখক : বার্তা পরিচালক, একাত্তর টিভি।
এইচআর/এমএস