ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

ছোটদের জন্য লেখা

প্রকাশিত: ০২:৩৪ এএম, ২৭ মার্চ ২০১৫

মুহম্মদ জাফর ইকবাল

সেদিন একটি মেয়ে খুব দুঃখ করে আমাকে একটা চিঠি পাঠিয়েছে। মেয়েটি লিখেছে, সে যখন ছোট ছিল তখন স্কুলে রীতিমত কাড়াকাড়ি করে বই পড়েছে। তাদের জীবনের সবচেয়ে বড় আনন্দ ছিল গল্পের বই পড়া।

তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে লিখেছে, তার এক ছোট ভাই ক্লাস সেভেনে পড়ে, সে মোটেও কোনো বই পড়তে চায় না। এখন পর্যন্ত কোনো গল্পের বই পড়েনি, সময় কাটায় ফেসবুকে। মেয়েটি আমার কাছে জানতে চেয়েছে কেন এমন হলো?

আমি এমন চিঠি আজকাল মাঝে মাঝেই পাই। শুধু যে চিঠিপত্র পাই তা নয়, নানান রকম ভয়ের গল্পও শুনি। একটা ভয়ের গল্প এ রকম- মা নানান কাজে খুব ব্যস্ত থাকেন, তাই ছোট শিশুটিকে সময় দিতে পারেন না। আবিষ্কার করেছেন শিশুর হাতে একটা স্মার্ট ফোন বা ট্যাবলেট ধরিয়ে দিলে সেটা নিয়ে সে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ব্যস্ত থাকে। তাই শিশুটিকে ব্যস্ত রাখার জন্য তার হাতে স্মার্ট ফোন দিয়ে রাখেন। একদিন কোনো কারণে শিশুটিকে একটু শাসন করার প্রয়োজন হলো। সামনে দাঁড়িয়ে যখন শিশুটিকে শক্ত গলায় কিছু বললেন, তখন হঠাৎ আবিষ্কার করলেন, শিশুটি তার দিকে তাকিয়ে বাতাসের মাঝে হাত বুলিয়ে তাকে সরিয়ে কিংবা অদৃশ্য করে দিতে চেষ্টা করছে। স্মার্ট ফোন বা ট্যাবলেটের স্ক্রিনে হাত দিয়ে স্পর্শ করে ঘষে দিলেই সেটা সরে যায় বা অদৃশ্য হয়ে যায়। শিশুটি মায়ের শসনটুকু পছন্দ করছে না, তাকে সামনে থেকে সরিয়ে অদৃশ্য করার জন্য একই কায়দায় হাত বুলিয়ে মাকে অদৃশ্য করার চেষ্টা করছে। যখন মা অদৃশ্য হয়ে গেল না কিংবা সরে গেল না, তখন শিশুটি অবাক এবং বিরক্ত হয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকল।

এই মা যখন তার সন্তানের এই গল্পটি আরেকজনের সাথে করছিলেন তখন তিনি ভেউ ভেউ করে কাঁদছিলেন। নিজেকে শাপশাপান্ত করছিলেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই দেশে অনেক মা (এবং বাবা) আছেন যারা এই ধরনের ঘটনার মধ্যে সন্তানদের বুদ্ধিমত্তা এবং প্রযুক্তিতে আকর্ষণ আবিষ্কার করে আনন্দে আটখানা হয়ে যান।

আমার ধারণা ছোট শিশুদের নিয়ে আমরা একটা কঠিন সময়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। শুধু আমরা নই, পৃথিবীজুড়েই মোটামুটি একই অবস্থা। তবে অন্য অনেক দেশের মানুষজনের মাত্রাজ্ঞান আছে। বাবা-মায়ের কমন সেন্স আছে। যতই দিন যাচ্ছে আমার মনে হচ্ছে, আমাদের দেশের অভিভাবকদের অনেকেরই মাত্রাজ্ঞান বা কমন সেন্স নেই। গত অল্প কয়েকদিনে আমি যে চিঠি পেয়েছি সেখানে একজন লিখেছেন, তার পরিচিত একটি ছেলে এইচএসসি পরীক্ষা দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। প্রস্তুতিটি বিচিত্র! পড়ালেখা ছেড়ে দিয়ে পুরো পরিবার ফেসবুকে নজর রাখছে। কোনো একটা কারণে তারা নিঃসন্দেহ যে, প্রশ্ন ফাঁস হবে এবং সেটা দিয়েই চমৎকার একটা পরীক্ষা এবং অসাধারণ একটা গ্রেড সে পেয়ে যাবে।

দ্বিতীয় চিঠিটি লিখেছে একটি মেয়ে। সে খুব সুন্দর ছবি আঁকতে পারত। তার খুব শখ ছিল ছবি আঁকা শিখবে। মা-বাবা তাকে কোনোভাবেই ছবি আঁকতে দেবে না। তাই সে ছবি আঁকতে পারে না। তার পরিচিত কেউ কেউ ছবি আঁকা শিখে এখন যখন সুন্দর সুন্দর ছবি আঁকে তখন সে তাদের দিকে হিংসাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। আরেকজন লিখেছে, তার খুব শখ ছিল গণিত অলিম্পিয়াডে যাবে। মা-বাবার কাছে ইচ্ছেটা প্রকাশ করার সাথে সাথে তারা বকুনি দিয়ে বলেছে পাঠ্য বইয়ের গণিত করাই যথেষ্ট। গণিত অলিম্পিয়াড নিয়ে আহ্লাদ করার কোনো প্রয়োজন নেই। সবচেয়ে হৃদয় বিদারক ঘটনাটি গল্পের বই নিয়ে। শিশুটি বই পড়তে চায়। মা-বাবা কিছুতেই বই পড়তে দেবে না। শিশুটিকে উচিত একটা শিক্ষা দেওয়ার জন্য তারা বই পুড়িয়ে ফেলেছে!

এই ঘটনাগুলো শোনার পর ঠিক করেছি, এখন থেকে সুযোগ পেলেই সবাইকে বুঝাতে থাকব পৃথিবীতে একজন শিশুকে গড়ে তোলার যতগুলো উপায় আছে তার মাঝে সবচেয়ে সহজ আর সবচেয়ে চমকপ্রদ উপায় হচ্ছে বই পড়া। পৃথিবীতে বই পড়ে এখনো কেউ নষ্ট হয়নি। কিন্তু বই না পড়ে পুরোপুরি অপদার্থ হয়ে গেছে সেরকম অসংখ্য উদাহরণ আছে।

২.
বই পড়ার কারণে মানুষের জীবনে কী অসাধারণ ঘটনা ঘটতে পারে সেটা আমি নিজের চোখে দেখেছি। মনোবিজ্ঞানী বা বিজ্ঞানী গবেষকরা হয়তো এটা আগে থেকেই জানেন, আমরা জানতাম না এবং আমার স্ত্রীর কারণে এটা হঠাৎ করে আমরা আবিষ্কার করেছিলাম। বিষয়টা বুঝানোর জন্য একেবারেই আমাদের ব্যক্তিগত জীবনের ঘটনা বলতে হবে। আগেই সে জন্য সবার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। আমি এবং আমার স্ত্রী দুজনেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মোটামুটি একই সময়ে পিএইচডি শেষ করেছিলাম। যখন পোস্টডক করছি তখন আমাদের প্রথম পুত্র সন্তান জন্ম নেয়। আমার স্ত্রী কোনো চাকরিবাকরি না করে ঘরে বসে আমাদের ছেলেকে দেখে শুনে রাখার সিদ্ধান্ত নিল। কয়েক মাসের একটা বাচ্চাকে নানানভাবে ব্যস্ত রাখার একটা প্রক্রিয়া হিসেবে সে আমাদের ছেলেটিকে বই পড়ে শোনাতে শুরু করল। প্রথম প্রথম সে বই টেনে নিয়ে সেটা দিয়ে কোনো এক ধরনের খেলা আবিষ্কারের চেষ্টা করলেও আট মাস বয়স হওয়ার পর হঠাৎ করে সে বইয়ের দিকে নজর দিতে শুরু করল। আমরা মোটামুটি বিস্ময় নিয়ে আবিষ্কার করলাম দুরন্ত ছটফটে একটা শিশুকে খুব সহজেই বই পড়ে শুনিয়ে শান্ত করে ফেলা যায়। আমাদের ছেলের বয়স যখন আড়াই বছর তখন আমাদের মেয়ের জন্ম হয়। এবং আমার স্ত্রী তার দুই ছেলেমেয়েকে দুই পাশে শুইয়ে বই পড়ে যেতে লাগল। দুইটি শিশু তাদের মায়ের দুই পাশে শুয়ে গম্ভীরভাবে বই পড়া শুনে যাচ্ছে দৃশ্যটি খুব মজার- আমি বেশ অবাক হয়ে সেটি উপভোগ করতাম।

আমার ছেলের বয়স যখন ঠিক চার বছরের কাছাকাছি তখন আমাদের একজন আমেরিকান প্রতিবেশী তার ছেলের জন্মদিনে আমাদের ছেলেকে দাওয়াত দিল। বিকেলবেলা গাড়ি করে বাসা থেকে তুলে নিয়ে কয়েক ঘণ্টা পর ভদ্রমহিলা আমাদের ছেলেকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে যাওয়ার সময় আমার স্ত্রীকে বলল, তুমি তো আমাকে কখনও বলোনি যে, তোমার ছেলে সবকিছু পড়তে পারে। আমার স্ত্রী আকাশ থেকে পড়ল! বলল, না।

আমেরিকান ভদ্রমহিলা বলল, আমার কথা বিশ্বাস না হলে তুমি পরীক্ষা করে দেখ। জন্মদিনে আমার ছেলে অনেক গিফট পেয়েছে। গিফটগুলো জুড়ে দেওয়ার জন্য সাথে যে ইনস্ট্রাকশন শিট ছিল তোমার ছেলে সেটা পড়ে পড়ে শুনিয়েছে, অন্য সব বাচ্চা মিলে তখন সেগুলো জুড়ে দিয়েছে।

আমেরিকান ভদ্রমিহিলা চলে যাবার সাথে সাথে আমার হতবাক স্ত্রী একটা সিরিয়ালের বাক্স নামিয়ে আমার ছেলের হাতে দিয়ে বলল, এখানে কী আছে পড় দেখি। আমার ছেলে গড়গড় করে সেটা পড়ে শোনাল।আমার স্ত্রী একটা শব্দ দেখিয়ে বলল, এটা বানান করো দেখি।

আমার ছেলে ফ্যাল ফ্যাল করে আমার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে রইল। বানান? সেটা আবার কী? আমার স্ত্রী একটু পরেই আবিষ্কার করল সে একটা অক্ষরও চেনে না। কোনটা কোন অক্ষর জানে না কিন্তু সবকিছু পড়তে পারে। আমি নিজের চোখে না দেখলে এ কথা বিশ্বাস করতাম না যে, একজন মানুষ কোনো অক্ষর না জেনে পুরোপুরি পড়ে ফেলতে পারে। অনেক পরে সে যখন স্কুলে গিয়েছে তখন সে এ বি সি ডি শিখেছে!

অনেকের ধারণা হতে পারে আমি খুব সুক্ষ্মভাবে আমার ছেলেকে অসাধারণ একজন মেধাবী শিশু হিসেবে ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করছি। এটা মোটেই সে রকম কিছু নয় এবং আমার মেয়ের বেলাতেও হুবহু সেই একই ব্যাপার ঘটেছে। এটা হওয়া সম্ভব জানার পর আমি সবাইকে এটা বলেছি এবং যারা আমাদের কথা বিশ্বাস করে তাদের ছোট শিশুদের বই পড়ে শুনিয়েছেন তাদের সবার বাচ্চা চার বছর বয়সে কিংবা তার আগেই বই পড়তে শিখে গিয়েছে। আমার কম বয়সী সহকর্মীরা যখন বিয়ে করে এবং যখন তাদের ঘর আলো করে শিশুর জন্ম হয় তখন আমরা সবার আগে এই তথ্যটি দেই : একেবারে ছেলেবেলা থেকে তোমাদের বাচ্চাদের বই পড়ে শোনাও। দেখবে কত তাড়াতাড়ি তারা বই পড়তে শিখে যাবে!

আমি খুব ছোট বাচ্চাদের জন্য রংচঙের ছবিসহ কয়েকটা বই লেখারও চেষ্টা করেছিলাম। কোনো সহকর্মীর সন্তান জন্ম হয়েছে খবর পেলে সেই বইগুলোর এক দুইটি তাদের হাতে ধরিয়ে দেই। মজার ব্যাপার হচ্ছে, অবধারিতভাবে কিছুদিন পর তারা আমার কাছে আরেক কপি বই নিতে আসে। এ ক্ষেত্রে সব সময়ই দেখা যায় শিশুটিকে অসংখ্যবার একটি বই পড়িয়ে শোনাতে শোনাতে বইটা টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। পড়তে পড়তে একটা বই ছিঁড়ে টুকরো টুকরো হওয়ার মতো সুন্দর ঘটনা আর কী হতে পারে?

একটি ছোট শিশু যখন নিজে নিজেই পড়তে শিখে যায় তখন আরেকটি চমকপ্রদ ঘটনা ঘটে। এই শিশুটির সময় কাটানো নিয়ে কোনো সমস্যা হয় না। আমরা সবাই নিশ্চয়ই দেখেছি চার-পাঁচ বছরের একটা বাচ্চাকে নিয়ে মা-বাবাদের খুব ব্যস্ত থাকতে হয়। বাচ্চা ঘ্যান ঘ্যান করে কাঁদছে, প্রথমে আদর করে শান্ত করার চেষ্টা করছেন। তারপর যখন পরিবেশটুকু অসহ্য হয়ে গেছে তখন বাচ্চাকে বকুনি দিচ্ছেন। বাচ্চা তখন আরো জোরে গলা ফাটিয়ে কাঁদতে শুরু করেছে- এ রকম দৃশ্য কে দেখেনি? একটা শিশু যখন পড়তে শিখে যায় তখন আর এই সমস্যা হয় না, শিশুটির হাতে একটা মোটা বই ধরিয়ে দিতে হয়। শিশুটি গভীর মনোযোগে সেই বই পড়তে থাকে। একটি ছোট শিশু গভীর মনোযোগ দিয়ে আকারে তার থেকে বড় একটা বই পড়ছে এর চেয়ে সুন্দর দৃশ্য পৃথিবীতে নেই। আমাদের সবার ঘরে ঘরে এই দৃশ্য হওয়া সম্ভব। আমি বাজী ধরে বলছি, নতুন বাবা-মায়েরা পরীক্ষা করে দেখুন। বিফলে মূল্য ফেরত!

৩.
আমাকে মাঝে মাঝেই টেলিভিশনে ইন্টারভিউ দিতে হয়। বিষয়টি আমি একেবারেই উপভোগ করি না। কিন্তু আমার কিছু করার নেই। আগে শুধু ঢাকা শহরে সাংবাদিকেরা টেলিভিশন ক্যামেরা নিয়ে ঘোরাঘুরি করতেন। আজকাল ছোট-বড় সব শহরেই সব চ্যানেলে তাদের পাওয়া যায়। মাঝে মাঝেই সাংবাদিকেরা আমাকে বলেন, ছোটদের জন্য কিছু একটা বলেন!

আমি অবধারিতভাবে ছোটদের উদ্দেশ্যে বলি, তোমরা অনেক বেশি বেশি বই পড়বে এবং অনেক কম কম টেলিভিশন দেখবে। আমি জানি না, টেলিভিশন চ্যানেলগুলো আমার এই বক্তব্য প্রচার করে কিনা। কিন্তু কেউ যেন মনে না করেন আমি কৌতুক করে বা হালকাভাবে কথাগুলো বলি। আমি যথেষ্ট গুরুত্ব নিয়েই কথাগুলো বলি। বই পড়ে একজন বইয়ের কাহিনি, বইয়ের চরিত্র, ঘটনা সবকিছু কল্পনা করতে পারে। যার কল্পনা শক্তি যত ভালো সে তত সুন্দর করে কল্পনা করতে পারে, তত ভালোভাবে বইটা উপভোগ করতে পারে। টেলিভিশনে সবকিছু দেখিয়ে দেওয়া হয়। শুধু তাই নয়, দুঃখের দৃশ্য কিংবা ভয়ের দৃশ্যগুলোর সাথে সেরকম মিউজিক বাজতে থাকে। কাজেই যে টেলিভিশন দেখছে তার কল্পনা করার কিছু থাকে না! ফলে কেউ যদি শুধু টেলিভিশন দেখে বড় হয় তার মানসিক বিকাশের সাথে একজন বই পড়ে বড় হওয়া শিশুর খুব বড় একটা পার্থক্য থাকলে অবাক হওয়ার কিছু নেই।

আমেরিকার কর্নেল ইউনিভার্সিটির একজন অধ্যাপকের একবার ধারণা হলো খুব শিশু বয়সে বেশি টেলিভিশন দেখলে শিশুর অটিজম শুরু হতে পারে। তিনি নানান জনকে বিষয়টি গবেষণা করে দেখার অনুরোধ করলেন। কিন্তু অধ্যাপক ভদ্রলোক মনোবিজ্ঞানী নন, ব্যবসা প্রশাসন বিভাগের তাই কেউ তার কথার গুরুত্ব দিল না। কর্নেল ইউনিভার্সিটির সেই অধ্যাপক তখন নিজেই নিজের মতো করে গবেষণা শুরু করলেন। সেটা মোটেও চিকিৎসা বিজ্ঞানের গবেষণা নয়- অর্থনীতি বা ব্যবসা প্রশাসন ধরনের গবেষণা। তিনি চিন্তা করে বের করলেন বৃষ্টি বেশি হলে বাচ্চারা বেশি ঘরে থাকে। বাচ্চা বেশি ঘরে থাকলে বেশি টেলিভিশন দেখে। তাই যেসব এলাকায় বেশি বৃষ্টি হয় সেখানে বাচ্চারা বেশি টেলিভিশন দেখতে বাধ্য হয়। যদি টেলিভিশন বেশি দেখার সাথে অটিজম বেশি হওয়ার একটা সম্পর্ক থাকে তাহলে যেসব এলাকায় বেশি বৃষ্টি হয় সেখানে নিশ্চয়ই বেশি বাচ্চা অটিজম আক্রান্ত হয়। কর্নেলের অধ্যাপক দেখতে পেলেন সত্যি সত্যি যে সব এলাকায় বৃষ্টি বেশি হয় সেসব এলাকায় অটিজম আক্রান্ত শিশু বেশি। তিনি এখানেই থামলেন না। গবেষণা করে দেখলেন, আমেরিকায় যেসব স্টেটে কেবল টেলিভিশন দ্রুত বেড়ে উঠেছে সেখানে অটিজমও দ্রুত বেড়ে উঠেছে। মজার ব্যাপার হলো, তার গবেষণাটি বৈজ্ঞানিক মহল মোটেই গ্রহণ করল না। শুধু তাই নয়, উল্টো গবেষণা করে এ রকম একটা তথ্য আবিষ্কার করে সবাইকে বিভ্রান্ত করার জন্য সবাই তাকে অনেক গালমন্দ করতে শুরু করল।

আমি আঠারো বছর আমেরিকা ছিলাম। আমি এর সঙ্গে আরেকটি তথ্য যোগ করতে পারি। আমেরিকাতে টেলিভিশনের ব্যবসা এতটাই শক্তিশালী যে, সেই দেশে সত্যি সত্যি যদি গবেষণা করে দেখা যায় টেলিভিশনের সাথে অটিজমের একটা সম্পর্ক আছে সেই তথ্যটিও কেউ কোনোদিন প্রকাশ করার সাহস পাবে না! আমেরিকার যে কোনো মানুষ যখন খুশি দোকান থেকে বন্দুক, রাইফেল কিংবা রিভলবার কিনে আনতে পারে! আমরা সবাই জানি সেই দেশে কিছু খ্যাপা মানুষ মাঝে মাঝেই এরকম অস্ত্র কিনে এনে স্কুলের বাচ্চাদের হত্যা করে। সেই দেশে ন্যাশনাল রাইফেল এসোসিয়েশন এতোই শক্তিশালী যে তারপরও কেউ যদি এতো সহজে এতো মারাত্মক অস্ত্র কিনে আনতে পারার বিরুদ্ধে কথা বলে তার কপালে অনেক দুঃখ আছে।)

‘অটিজম’ এক সময় অপরিচিত শব্দ ছিল। এখন আমাদের দেশেও মোটামুটিভাবে সবাই অটিজম কিংবা অটিস্টিক শব্দটা শুনেছে। পৃথিবীতে অটিজম বাচ্চার সংখ্যা বছরে ৬ থেকে ১৫ শতাংশ হারে বাড়ছে। পৃথিবীতে এখন শতকরা এক ভাগ মানুষ অটিস্টিক (আমেরিকাতে এই সংখ্যা আরো বিশি)। কেন এতো দ্রুত এই সংখ্যাটা বেড়ে যাচ্ছে এখনো কেউ জানে না। কোনোরকম বড় গবেষণা না করেই আমরা বলতে পারি, এখন বাচ্চাদের যে পরিবেশে বড় করা হয় সেটি আগের থেকে ভিন্ন। কিন্তু যেটি নিশ্চিতভাবে আগের থেকে ভিন্ন সেটি হচ্ছে, টেলিভিশন, ভিডিও গেম, স্মার্ট ফোনের ব্যবহার।

বৈজ্ঞানিকভাবে এটা প্রমাণিত হয়নি কিন্তু আশঙ্কাটা কি কেউ উড়িয়ে দিতে পারবেন? কেউ কী কখনও ভিডিও গেমের কাগজটি খুটিয়ে খুটিয়ে পড়েছেন? সেখানে ছোট ছোট অক্ষরে লেখা থাকে ভিডিও গেম খেলার সময় কোনো কোনো শিশুর মৃগী রোগ শুরু হতে পারে! এতো সব জানার পর ছোট একটা শিশুকে টেলিভিশন বা ভিডিও গেমের সামনে বসিয়ে দিতে কী আমাদের জান ধুকপুক ধুকপুক করবে না?

তার চেয়ে চমৎকার হচ্ছে বই পড়ে শোনানো! একটা বাঘের গল্প পড়তে পড়তে হঠাৎ করে বাঘের গলায় হালুম শব্দ শুনে একটা শিশুর মুখে যে আনন্দের ছাপ পড়ে তার সাথে তুলনা করার মতো আনন্দময় বিষয় কী আছে? একটা ভূতের গল্প পড়ে শোনানোর সময় নাকি সুরে ভূতের গলা অনুকরণ করলে একটা শিশু যেভাবে খিলখিল করে হেসে ওঠে সেটা কী আমরা সবাই দেখিনি?

তাহলে কেন আমরা ছোট একটা শিশুকে বই পড়ে শোনাব না? কেন একজন কিশোর-কিশোরীকে বই পড়তে উৎসাহ দেব না? কেন একজন তরুণ-তরুণীকে কবিতা লিখতে দেব না?

ছোট একটা জীবন, সেই জীবনকে আনন্দময় করে তোলার এতো সহজ উপায় থাকতেও কেন জীবনকে আনন্দময় করে তুলব না?

লেখক: শিক্ষক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট  

এআরএস/এমএস