ধাক্কাধাক্কির তত্ত্ব আবিষ্কার সুশাসন নয়
রাজধানীর শাহবাগে গত বৃহস্পতিবার হরতালের সংবাদ সংগ্রহের সময় বেসরকারি টিভি চ্যানেল এটিএন নিউজের প্রতিবেদক কাজী এহসান বিন দিদার ও ক্যামেরাপারসন আবদুল আলিমকে মধ্যযুগীয় কায়দায় বর্বর নির্যাতন করেছে পুলিশ। এ ঘটনায় সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) এরশাদকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। কিন্তু সম্মিলিত হামলায় জড়িত ছিল পুলিশের আরো অনেক সদস্য। পুলিশ প্রথমে ক্যামেরাপারসন আবদুল আলিমের ওপরে হামলা চালায়। এ সময় প্রতিবেদক কাজী এহসান তাকে উদ্ধার করতে গেলে পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা দুজনকেই মাটিতে ফেলে লাথি মারে ও লাঠি দিয়ে পেটায়, ক্যামেরাও ভেঙে ফেলে। ভিডিও ফুটেজ ও আলোকচিত্র দেখে সাংবাদিকেরা হামলার সঙ্গে জড়িত ১৫ জন পুলিশকে চিহ্নিত করেছেন।
পুলিশের হামলায় প্রতিবেদক দিদার ও ক্যামেরা পারসন আবদুল আলিম এখন এক ট্রমার ভেতর দিয়ে যাচ্ছেন। রাষ্ট্রীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, জনগণের করের অর্থে যারা জীবন চালায়, তাদের এমন আচরণ আজকের যুগে কল্পনাও করা যায় না। একজন মাত্র সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। বাকি হামলাকারীদের ব্যাপারে পুলিশের কোন বক্তব্য নেই। একথা সাংবাদিক সমাজ জানে যে, এই সাময়িক বরখাস্ত একদম লোক দেখানো। হয়তো আগামীতে এই এরশাদ পদোন্নতি পাবে, তাকে হয়তো পুলিশ পদকও দেয়া হবে।
পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে প্রায়ই নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন সাংবাদিকরা। পুলিশ, রাজনৈতিক নেতা, সরকারি কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী যখন যার অপকর্ম ও দুর্নীতির খবর প্রকাশ পায় তখন তারাই সাংবাদিকদের ওপর হামলা চালায়। বাংলাদেশে যদি একটি জায়গায় বিচারহীনতার সংস্কৃতি পাকাপোক্তভাবে জায়গা করে নিয়ে থাকে তবে তা সাংবাদিক নির্যাতন। সাংবাদিকদের নির্যাতন করে, হত্যা করে কারো কোন শাস্তি হয়েছে, এমন কোন নজির নেই এদেশে। পুলিশ যদি হয়, তবেতো কথাই নেই।
যেসব পুলিশ সদস্য এ কাজ করেছেন, তাদের মনোজগতে শক্ত ধারণা আছে যে, তাদের কিছু হবে না। যদি হয়ও, তবে তা পদোন্নতি কিংবা পুরষ্কার। পুলিশ একটি শৃঙ্খলা বাহিনী। কিন্তু এ কাজের মাধ্যমে প্রমাণিত হলো, এই বাহিনীতে শৃঙ্খলার কতটা অভাব। আর এই নির্যাতন যে কতটা উৎসাহব্যঞ্জক কাজ তার প্রমাণ স্বয়ং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। মন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, `সাংবাদিক নির্যাতন পুলিশে করে না, মাঝে মাঝে ধাক্কাধাক্কি লেগে যায়, এ ধরনের কিছু হয়েছে। শুক্রবার বিকেলে মৌলভীবাজারের শমসেরনগরে ঐতিহাসিক রেজা শাহ পাহলভী তোরণের পুনঃনির্মাণ ও সংস্কারপূর্বক উদ্বোধন শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন। সাংবাদিকদের নির্যাতন করতে পুলিশ সদস্যদের নির্যাতনে উৎসাহ দিতে এর চেয়ে বড় দাওয়াই আর কি হতে পারে?
সাংবাদিকদের ওপর নির্যাতনের ঘটনা একের পর এক ঘটে যাচ্ছে। কখনো অচেনা সন্ত্রাসীরা, কখনো পুলিশ আবার কখনো জনপ্রতিনিধিরাও এ নির্যাতনে অংশ নিচ্ছেন। বাংলাদেশের মিডিয়া এখন ক্রমপ্রসারমাণ, মত প্রকাশের ক্ষেত্রটাও বিস্তৃত হচ্ছে। কিন্তু পেশা হিসেবে সাংবাদিকতা ক্রমশই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। আগের তুলনায় ক্রমেই বাংলাদেশে সাংবাদিকদের জন্য ঝুঁকি বাড়ছে, যা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র তথা দায়িত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠার অন্যতম অন্তরায়।
সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা অধিক পরিমাণে ঘটায় পেশাগত ঝুঁকির বিষয়টি রীতিমতো আতঙ্ক ও উদ্বেগের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই নির্যাতনকারীদের মৃদু শাস্তি দেওয়া হয়। এই শাস্তি খুব বেশি হলে হয় বদলি, এর বেশি কিছু নয়। পুলিশ বাহিনীর মনোজগতে হয়তো এই ধরনের কর্মকাণ্ডের জন্য এক ধরনের প্রণোদনা আছে। নয়তো, একটি বাহিনী এতটা বেপোরোয়া কি করে হয়?
দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে পুলিশি নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বহু সাংবাদিক। পুলিশের দু’একজন কর্মকর্তাকে ফেসবুকে সক্রিয় হতে দেখা গেছে। তারা বলার চেষ্টা করেছেন অ্যাকশনের মাঝে পরে গিয়ে এমনটা ঘটে থাকতে পারে। এ বক্তব্য পুরোটাই মিথ্যা। এর মাধ্যমে সেই কর্মকর্তা (যতই পুলিশ সাংবাদিক সম্পর্কের কথা বলুননা কেন) সেই হামলাকে জায়েজ করছেন। বলতে কোন দ্বিধা হচ্ছেনা যে, তারা যে প্রশিক্ষণের কথা বলেন, এটাই হয়তো সেই প্রশিক্ষণ।
সাংবাদিকদের পেশাগত নিরাপত্তা ও নিশ্চয়তা প্রদানের দায়িত্ব সরকারের। এবং অবশ্যই পুলিশের। সাংবাদিকরা সমাজে পর্যবেক্ষকের ভূমিকা পালন করেন। তার পেশাগত দায়িত্ব পালনে তাকে শুধু বাধাই দেয়া হয়নি, নির্যাতন করে চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে এসব পুলিশ সদস্য। জবাবদিহিমূলক সরকার প্রতিষ্ঠায় এমন পুলিশ সদস্য বড় অন্তরায়। তাই সাংবাদিক নির্যাতনের এই ঘটনার সুষ্ঠু বিচারে সরকারের উদ্যোগী হওয়া দরকার। এই বাহিনীর ভেতর কারা আছে যারা জনগণ কর্তৃক একটি অতি প্রত্যাখ্যাত হরতালকে এমন গুরুত্ব দিয়ে বিশ্ব মিডিয়ায় প্রচারের সুযোগ করে দিল? সংবাদকর্মীদের কাজের নিরাপত্তা ও নিশ্চয়তা দায়িত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠার অন্যতম পথপ্রদর্শক হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। এ ধরনের নির্যাতন প্রতিরোধ করা না গেলে সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথ ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসবে।
পদে বসলেই দায়িত্বশীল হওয়া যায় না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নির্যাতনকে ধাক্কাধাক্কি বলে ঘটনা ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করেছেন, পুলিশ বাহিনীর সেইসব উচ্ছৃঙ্খল সদস্যের পক্ষে সাফাই গাওয়ার চেষ্টা করেছেন। তার কাছে এমনটা প্রত্যাশিত ছিলনা। তিনি এমনটা করেছেন যেমনটা অতীতের সব স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীই করেছেন। অনেকটা পুলিশ বাহিনীর প্রধান জনসংযোগ কর্মকর্তার মতো আচরণ।
শাহবাগের ঘটনার মতোই, আরেক ধরনের চাপ আমরা প্রত্যক্ষ করলাম দু’একজন সংসদ সদস্যের আচরণে। একটি পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টের বিরোধিতা করতে গিয়ে সংসদে দাঁড়িয়ে সেই পত্রিকার সম্পাদককে যা ইচ্ছা তাই বলেছেন একজন সংসদ সদস্য। সংসদে দাঁড়িয়ে তিনি এমনটা করেছেন, যেখানে এই সম্পাদকের নিজের পক্ষে বলার কোন সুযোগ নেই।
সংবিধানে, আইনে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু সেটা যখনই বাস্তবায়নের সময় আসে তখনই ক্ষমতাসীনরা বাধা হয়ে দাঁড়ায়। মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলার পেছনেও গুরুত্বপূর্ণ অনেক সময় ব্যয় করতে হয় সম্পাদক ও সাংবাদিকদের। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে শক্তিশালী ভিত্তির ওপর দাঁড় করানোর জন্য গণমাধ্যমের নিরপেক্ষতা যেমন নিশ্চিত করতে হবে, তেমনি স্বাধীনভাবে কাজ করার যাবতীয় দিক উন্মোচন করতে হবে। সুশাসন প্রতিষ্ঠার গতি ত্বরান্বিত করতে হবে, ধাক্কাধাক্কির তত্ব আবিষ্কারের মধ্যে সমাধান নেই নিশ্চয়ই।
লেখক : বার্তা পরিচালক, একাত্তর টিভি।
এইচআর/এমএস