ক্রিকেটারদের আগে ভালোমানুষ হতে হবে
নিউজিল্যান্ড থেকে যখন একের পর এক পরাজয়ের খবর আসছিল, তখন আরেক কেলেঙ্কারিতে তোলপাড় বাংলাদেশ ক্রিকেট। নিউজিল্যান্ড সফরে ওয়ানডে, টি-২০, টেস্ট- সব ম্যাচেই হেরেছে বাংলাদেশ। দুই টেস্টের কয়েকটা সেশনে দারুণ ঝলক দেখিয়েছে বাংলাদেশ। একটা ওয়ানডেতেও হয়তো জেতা সম্ভব ছিল। তবে মাঠের জয়-পরাজয় নিয়ে আমি অত ভাবিত নই। নিউজিল্যান্ডের বৈরী আবহাওয়ায় সিরিজের ফলাফল অনুমেয়ই ছিল। সাকিব, মুশফিক, সৌম্যদের ঝলকটুকুই প্রাপ্তি।
গত বছর দেড়েক বাংলাদেশ ক্রিকেট যেমন সাফল্যের রাজপথে দৌড়াচ্ছে, তাতে বিভ্রান্ত হয়ে অনেকে প্রত্যাশার অনেক উঁচুতে বেঁধেছিলেন, হতাশ হয়েছেন তারাই। বাংলাদেশ ক্রিকেট এখন যে পর্যায়ে পৌঁছেছে, তাতে জয়-পরাজয় অত ভাবার দরকার নেই। ক্রিকেট জীবনের মত। এতে সাফল্যের চূড়া যেমন ছোঁয়া যায়, পরক্ষণেই দেখা মেলে ব্যর্থতার অতলান্ত খাদ। একসময়ের অজেয় ওয়েস্ট ইন্ডিজ এখন যে কোনো সাধারণ দল। অস্ট্রেলিয়ার জয়রথও থেমেছে। তাই বাংলাদেশ কথায় কথায় সবাইকে বাংলাওয়াশ করবে, এমন আশা করা ভুল। প্রত্যেক ডুবে শালুক মেলে না। আমাদের ক্রিকেটাররা দেশের জন্য জান দিয়ে লড়ছে, সেটাই আমার কাছে আসল। তাদের নিবেদনে যদি ঘাটতি না থাকে, আমি হারলেও আছি, জিতলেও আছি। এক ম্যাচ হারলেই গালাগালি করে চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করে ফেলাদের দলে আমি নেই।
তবে নিউজিল্যান্ডে একের পর এক পরাজয়ের চেয়েও বড় যে ঘটনা বাংলাদেশের ক্রিকেটে তোলপাড় তুলেছে; তা আমাদের মাথা হেট করে দিয়েছে, আমাদের লজ্জিত করেছে, শঙ্কিত করেছে। এক নারীর করা আইসিটি অ্যাক্টের মামলায় জাতীয় দলের ক্রিকেটার আরাফাত সানিকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। শুধু গ্রেফতার নয়, পুলিশ তাকে রিমান্ডে নিয়েছে। প্রতিদিন কত গ্রেফতার-রিমান্ডের খবর পাই, কিন্তু যাদের আমরা মাথার তাজ করে রাখি, তাদের যে কোনো বিচ্যুতি আমাদের কষ্ট দেয়। আরাফাত সানির বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি এক নারীর সাথে প্রেম করে গোপনে বিয়ে করে ফেলেন। তাকে নিয়ে ব্যাংকক থেকে ঘুরেও এসেছেন। কিন্তু সেই নারীকে স্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে ঘরে তো তোলেনইনি, উল্টো ফেসবুকের ইনবক্সে তাদের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি পাঠিয়ে হুমকি দিচ্ছেন, হেনস্থা করছেন। প্রাথমিক তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পেয়ে পুলিশ আরাফাত সানিকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নিয়েছে।
আরাফাত সানিই এ ধরনের অভিযোগে জেলখাটা প্রথম ক্রিকেটার নন। এর আগে একই ধরনের অভিযোগে জেল খেটে এসেছেন রুবেল। পরে বিসিবির উদ্যোগে জামিন করিয়ে রুবেলকে বিশ্বকাপে খেলতে পাঠানো হয়। অস্বীকার করার উপায় নেই, প্রথমবারের বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠার পেছনে রুবেলের দারুণ অবদান ছিল। কিন্তু দুর্দান্ত পারফরম্যান্স হলেই কি আমরা ক্রিকেটারদের সব অপরাধ ভুলে যাবো? মাফ করে দেবো? এই প্রশ্নের উত্তরে পরে দেবো। আগে একটু আরাফাত সানির বিষয়টা বুঝে নেই। আপনারা কেউ ভাববেন না, আমি অভিযোগকারী নারীদের কথা শুনে আরাফাত সানি বা রুবেলকে শুলে চড়াতে বলবো। তারা যে অপরাধ করেছেন, বাংলাদেশে তা আকসার ঘটে। যে নারী সানির বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছেন, তিনি কেন আরেকজনের স্বামীর সঙ্গে প্রেম করতে গেলেন, পারস্পরিক সম্পর্কের আস্থা-বিশ্বাস সম্পর্কে নিশ্চিত না হয়ে গোপনে বিয়ে করে ফেললেন কেন? একই প্রশ্ন রুবেলের বিরুদ্ধে আরেক নারীর আনা অভিযোগ প্রসঙ্গেও। বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণ করা যায় কীভাবে?
গত সপ্তাহে ভারতের এক আদালত রায় দিয়েছে, দুজন প্রাপ্তবয়স্ক ও শিক্ষিত নারী-পুরুষ পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে শারীরিক সম্পর্কে জড়ালে পরে তা নিয়ে ধর্ষণের মামলা করা যাবে না। খুব ন্যায্য কথা। রুবেল সেই নারীকে বিয়ে করার আশ্বাস হয়তো দিয়েছিলেন, কিন্তু ধর্ষণ তো করেননি, যা করেছেন পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতেই করেছেন। আমি জানি আমার এই প্রশ্নগুলো ঠিক নয়, বাংলাদেশের সামাজিক বাস্তবতায় এই প্রশ্ন কখনো কখনো অপরাধীকে সুবিধা দিতে পারে। বাংলাদেশ এখনও প্রবলভাবে পুরুষশাসিত। এখানে পুরুষরা জোর করে, ভুলিয়ে ভালিয়ে, প্রলোভন দেখিয়ে নারীদের নির্যাতন করে। বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে শুধু নয়, বিয়ের পরেও বাংলাদেশের অনেক নারী এমনকি স্বামীর মাধ্যমেও ধর্ষিত হয়। বিয়ের আগে হোক বা পরে দুজন নারী-পুরুষের মধ্যে যে কোনো সম্পর্কের ক্ষেত্রে পারস্পরিক সম্মতি, আস্থা, বিশ্বাস, ভালোবাসাটা খুব জরুরি। দুজন মানুষের সম্পর্কে নানা টানাপড়েন থাকতেই পারে। আজ যাকে ভালো লাগে, কাল তা নাও লাগতে পারে। ভালো না লাগলে সম্পর্ক চুকে বুকে যাবে, আপত্তি নেই। কিন্তু সম্পর্ক ভেঙে গেলে সেই সম্পর্কের অন্তরঙ্গতা পাবলিক করে দেয়া বা পাবলিক করার ভয় দেখানো অন্যায়, মারাত্মক অনৈতিক। সেই অপরাধটা আরাফাত সানি করেছেন বলেই অভিযোগ। যদি অভিযোগ প্রমাণিত হয়, আরাফাত সানি যে যোগ্য শাস্তি পান, সেই নারী যেন ন্যায়বিচার পান; সে দাবি জানাচ্ছি।
আগামী ২৮ জানুয়ারি জাতীয় লীগের ম্যাচ। যখন অনুশীলন মাঠে থাকার কথা, তখন তিনি রিমান্ডে, ম্যাচের দিন হয়তো থাকবেন কারাগারে। রুবেলের মত আরাফাত সানিকেও যেন আইনের ফাঁক গলিয়ে অন্যায় সুবিধা দেয়া না হয়। আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান। কে ভালো খেলে, কে ভালো অভিনয় করে; সেটা মোটেই বিবেচ্য হওয়া উচিত নয়।
তবে আমার শঙ্কাটা অন্যখানে। বাংলাদেশে ক্রিকেট আর নিছক ব্যাট বলের খেলা নয়। ক্রিকেট আমাদের জাতীয় ঐক্যের প্রতীক। ক্রিকেটাররাও এখানে রক্তমাংসের সাধারণ মানুষ নন। একেকজন জাতীয় বীর। কিন্তু তারা যে বীর সেটা তারা ভুলে যান। আচরণ করেন সাধারণ মানুষের মত। তাদের বুঝতে হবে, তারা সাধারণ মানুষ নন। কোটি কোটি মানুষ তাদের ভালোবাসে, লাখ লাখ শিশু-কিশোর-তরুণ তাদের অনুসরণ করে। তাই তাদের প্রত্যেকটা পা ফেলতে হবে চিন্তা করে। কিন্তু সাকিবের মত তারকা গ্যালারিতে গিয়ে মারামারি করে, ক্যামেরায় অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করে; গৃহকর্মীকে মারার দায়ে শাহাদাত দম্পতি জেল খাটে, ম্যাচ পাতানোর দায়ে আশরাফুল নিষিদ্ধ হয়, হোটেল রুমে নারী নিয়ে যাওয়ায় জরিমানা গুণতে হয় সাব্বির ও আল-আমিনকে। তাহলে আমাদের সন্তানরা কাদের আইডল মানবে। আরাফাত সানির ঘটনার পর এক ক্রীড়া সাংবাদিক ফেসবুকে লিখেছিলেন, ‘আগে মানে রকিবুল, লিপু, বুলবুল, নান্নু, আকরাম, সুমনদের সময় তো এসব হতো না। এখন কেন হচ্ছে?’ এই প্রশ্নের উত্তর খুব সোজা। আগে ক্রিকেটাররা যতটা ভালোবেসে খেলতেন, এখন ক্রিকেটাররা ততটা বাসেন না। এখন ত্রিকেটে অনেক বেশি বাণিজ্য, অনেক বেশি চাকচিক্য, অনেক বেশি গ্ল্যামার। আলো ঝলমলে গ্ল্যামারের জগৎ তাদের চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। হঠাৎ পাওয়া জনপ্রিয়তায় তারা ধরাকে সরা জ্ঞান করে। সিনেমার মতই ক্রিকেটেও স্ক্যান্ডাল।
তবে ক্রিকেটারদের মনে রাখতে হবে স্ক্যান্ডালের অংশ বা মামলার আসামি হওয়া নয়, তাদের মূল কাজ খেলা। সেটা ভালো করে করতে হবে। উদাহরণ হাতের কাছেই। শচীন টেন্ডুলকার আর বিনোদ কাম্বলি স্কুল ক্রিকেটে রেকর্ড পার্টনারশিপ করেছিলেন। বলা হচ্ছিল, কাম্বলি অনেক বেশি প্রতিভাবান। কিন্তু আজ কোথায় শচীন আর কোথায় কাম্বলি? পার্টি বয় কাম্বলি হারিয়ে গেছে অনেক আগেই। আর একদম বিতর্কহীন দুই যুগের ক্যারিয়ার শেষে শচীন এখন গোটা বিশ্বের আইকন। এখন আমাদের ক্রিকেটারদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তারা কী হতে চায়, কাম্বলি না শচীন?
তবে এখানে বোর্ডকেও কঠোর ভূমিকা নিতে হবে। ব্যক্তির অপরাধের দায় যেন বোর্ড না নেয়। শাহাদাতরা অপরাধ করেও যেন পার পেয়ে না যায়। রুবেল যত ভালোই খেলুক, অপরাধ করলে সাজা তাকে পেতেই হবে। শুধু ভালো খেললেই হবে না, তাকে ভালোমানুষ হতে হবে। নারীদের সাথে প্রতারণা করে, গৃহকর্মীকে পিটিয়ে মাঠে গিয়ে সেঞ্চুরি করলে বা ৫ উইকেট নিলেই আমরা তাদের মাথায় তুলে নাচবো না। ক্রিকেটাররা অন্যায় করলে, অনৈতিক কাজ করলে হেট হয় বাংলাদেশের মাথা।
এইচআর/পিআর