ডিভোর্স কী আসলেই সামাজিক অবক্ষয়ের লক্ষণ?
আপাত দৃষ্টিতে ডিভোর্স ব্যাপারটি কোন সমাজ, পরিবার, ব্যক্তি কারো জন্যই কোন সুখকর, আকাঙ্ক্ষিত ঘটনা নয়। দুটো মানুষ যখন বিয়ের মত একটি পবিত্র, মধুর বন্ধনে আবদ্ধ হয়, তখন দুজনের মনেই স্বপ্ন থাকে যে এই সম্পর্কটি সাড়া জীবন টিকে থাকবে। এই সম্পর্ক মাঝপথে ভেঙে যেতে পারে এই চিন্তা বা আশঙ্কা কারো কল্পনাতেও আসে না। স্বাভাবিক ক্ষেত্রে উভয় পরিবারের সবাইও আশা করে এই সম্পর্ক টিকে থাকবে আজীবন। যে কোন সমাজের ভিত্তি এই বিয়ে নামের সম্পর্কটি।
প্রকৃতির মূল উদ্দেশ্য যদি হয় পৃথিবীতে মানব জাতির বিস্তার, তাহলে বিয়ের মাধ্যমেই সুষ্ঠুভাবে এই উদ্দেশ্য সফল হয়। এক জোড়া মানব মানবী বিয়ের মাধ্যমে আজীবন সম্পর্কে আবদ্ধ হয়, সন্তান সন্ততির জন্ম দেয়, তাদের লালন পালন করে এক সাথে। তাদের পরস্পরের উপর নির্ভরশীলতা তৈরি হয়, একে অন্যের দায়িত্ব নেয়, দুজনের মধ্যে থাকে ভালোবাসা এবং একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধা । এটাই সুস্থ বিয়ের সম্পর্ক থেকে কাম্য।
পাশ্চাত্যর তুলনায় শিক্ষা, পরিবেশ, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, জ্ঞান, বিজ্ঞান বিভিন্ন জিনিসে পিছিয়ে থাকলেও কিছু কিছু বিষয়ে আমরা এগিয়ে আছি বলে আমরা সব সময় গর্ব করি। যেসব বিষয় নিয়ে আমরা গর্ব করি তার মধ্যে অন্যতম হল আমাদের দেশে ডিভোর্সের হার পাশ্চাত্যের তুলনায় কম। আমাদের ধারণা পাশ্চাত্যে নারী, পুরুষ অনেক বেশি স্বার্থপর, কম সহনশীল। এরা বিয়েটাকে সিরিয়াসলি নেয় না। বিয়েটাকে একটা খেলা মনে করে। এদের যতদিন একজনকে ভালোলাগে ততদিনই একসাথে থাকে। আজকে একে ভালো লাগে তো কালকে ওকে। ইত্যাদি আরও অনেক কিছু। তাই ওদের বিয়ে টিকে না। ডিভোর্সের হার অনেক বেশি। অন্যদিকে আমাদের দেশে আমরা বিয়েটাকে খুব সিরিয়াসলি নেই। আমরা সংসারের জন্য নিজেদের সব দুঃখ কষ্ট ভুলে অনেক স্যাক্রিফাইস, অ্যাডজাস্ট করে হলেও বিয়ে টিকিয়ে রাখি, বিশেষ করে বাচ্চার মুখের দিকে তাকিয়ে সব মেনে নেই। তাই আমাদের দেশে ডিভোর্সের হার পাশ্চাত্যের চেয়ে অনেক কম।
ডিভোর্স বাড়তে থাকলে সমাজে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা বাড়তে থাকে। মানুষের নিঃসঙ্গতা বাড়তে থাকে, ডিপ্রেশন বাড়তে পারে। একা মা বা বাবার পক্ষে সন্তান লালন পালন অনেক কঠিন হতে পারে। তবে সবচেয়ে বড় যে ক্ষতিটা হয় সেটা হয় সন্তানের। সন্তানের পরিপূরণ মানসিক বিকাশের জন্য বাবা এবং মা দুজনের স্নেহ, ভালোবাসা, শাসন, গাইড্যান্স সব কিছুরই দরকার আছে। মায়ের পক্ষে বাবার স্থান নেওয়া বা বাবার পক্ষে মায়ের স্থান নেওয়া খুবই কঠিন এবং প্রায় অসম্ভব কাজ।
একজন সন্তানের মনে তার মা এবং বাবা দুজনের জন্যই অনেক ভালোবাসা থাকে, তাই তার পক্ষে একজনকে ঘৃণা করা বা একজনকে বাদ দিয়ে অন্য জনের পক্ষ নেওয়া খুব কঠিন কাজ। বাবা, মা মারা গেলেও সন্তানের মনে শূন্য স্থান থাকে, অভাব বোধ থাকে, কষ্ট থাকে, কিন্তু বাবা মায়ের ডিভোর্স হলে থাকে অন্য ধরনের কষ্ট। এসব বিবেচনা করেই হয়তো আমরা গর্ব করি যে ডিভোর্সের হার আমাদের মধ্যে কম মানে এই সামাজিক মান দণ্ডে আমরা এগিয়ে আছি।
কিন্তু আসলেই কী ডিভোর্সের হার বেশি হওয়া মানে সমাজের এক ধরনের অবক্ষয়? ইদানীং আমাদের দেশেও আগের তুলনায় ডিভোর্সের হার অনেক বেড়ে গেছে, সেকারণেই এই চিন্তাটাও বেড়ে গেছে। তবে কী আমাদের সমাজে এক ধরনের অশুভ ছায়া পড়েছে? একটু গভীর ভাবে ভেবে দেখলে দেখা যায়, আমাদের দেশে এই যে মানিয়ে নেওয়া, স্যাক্রিফাইস, অ্যাডজাস্ট করা এগুলো সবই কিন্তু একতরফা করতো মেয়েরা। তারা চোখ বুজে সব মেনে নিত, এর প্রধান কারণ ছিল শিক্ষার অভাব, অর্থনৈতিক পরাধীনতা। একটি সুস্থ বিয়ে থেকে যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা, নির্ভরশীলতা, ভালোবাসা, দায়িত্ববোধ কাম্য সেগুলো কিন্তু আমাদের দেশে বেশিরভাগ বিয়েতেই দেখা যায় না। এক পক্ষ শোষিত, নির্যাতিত হয়ে টিকিয়ে রাখা যে বিয়ে সেখানে তো আসলে মানুষ নিঃসঙ্গ এবং অসুখীই। বাবা মায়ের খারাপ সম্পর্কের মধ্যে বড় হওয়া বাচ্চা তো অসুখী, অসম্পূর্ণ।
মেয়েদের শিক্ষা বাড়ছে, তাদের সচেতনতা, আত্মসম্মানবোধ বাড়ছে। তারা অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভর হচ্ছে। তারা আর মুখ বুজে সব মেনে নিচ্ছে না। চিরকালের অত্যাচারী স্বামীরা কিন্তু একই ভাবে একতরফা আধিপত্য স্থাপন করতে চাইছে। এতে করে যে সংঘাত তার পরিণতিতে বাড়ছে ডিভোর্স। এই ডিভোর্স কিন্তু আপাত দৃষ্টিতে অশুভ হলেও সমাজের এক ধরনের অগ্রগতির নির্দেশক। ধীরে ধীরে যখন পুরুষরা, স্বামী এবং তার পরিবার মেয়েদের এই স্বনির্ভর রূপটির সাথে পুরোপুরি পরিচিত হয়ে যাবে, অ্যাডজাস্ট করে নেবে নিজেদের মানসিকতা, মেয়েদেরকে মানুষ হিসেবে সমান স্বীকৃতি দিতে শিখে নেবে তখন আশা করি সমাজে সুস্থ বিয়ের হার বাড়তে থাকবে, অসুস্থ বিয়েকে টিকিয়ে রেখে আমরা আর ভুল বাহবা নেব না।
লেখক : ক্যালিফোর্নিয়া প্রবাসী প্রকৌশলী, লেখক।
এইচআর/পিআর