দাঙ্গাল এবং আমার স্বপ্ন
কাল সপরিবারে সিনেমা হলে গিয়ে দাঙ্গাল দেখলাম। কাঁদলাম, হাসলাম, আঁখিজলে ভাসলাম। ছবিটা নাকি সত্যি ঘটনার উপর ভিত্তি করে বানানো হয়েছে। ভাল লাগল, কিন্তু আনন্দে উদ্বেলিত হলাম না কারণ একই সাথে একথাও ভাবলাম, এক্সেপশনস ক্যাননট বি একজাম্পলস।
ছবিটা দেখতে দেখতে অনেক কিছু লেখার কথা ভাবলাম, সেসব লেখায় কীসব মন্তব্য আসবে আর তার জবাবে আমার কী বলার থাকবে তাও ভাবলাম। সব ভেবে এতোটাই ক্লান্ত লাগল যে বাসায় এসে কিছুই লিখতে পারলাম না। আমি সবসময় ভাবতাম আমার ছেলেমেয়েকে আমি সমানভাবে বড় করেছি, সবক্ষেত্রে সমান অধিকার দিয়েছি, কোথাও কোন বৈষম্য ঘটতে দেইনি। এখানে যেতে পারবে না, এটা পরতে পারবে না, ওটা করতে পারবে না, এতোটার ভেতরে বাসায় আসতে হবে কারণ তুমি মেয়েমানুষ- এধরনের কোন বিধি নিষেধ আমার মেয়ের জীবনে কখনো ছিল না, এখনো নেই। আমার ছেলে ঘর সংসারের কাজে মেয়ের চেয়ে অনেক বেশি সাহায্য করে আমাকে। মেয়েটাই বরং বেশি বেশি বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়ায়।
কিন্তু কাল দাঙ্গাল দেখে বাসায় ফেরার পথে শুনলাম আমার মেয়ে তার ভাইকে বলছে সে একটি মেয়ে হিসেবে নানান ভাবে বঞ্চিত হয়েছে। ছোটবেলা তার স্কুলে মেয়েদের ফুটবল খেলার বিষয়টা ছিলই না। শুধু তাই নয়, পি ই ক্লাসে যখন ছেলে্রা বাইরে ফুটবল বা ক্রিকেট খেলত, তখন মেয়েদেরকে গেইমস রুমে কিছু একটা দিয়ে বসিয়ে রাখাই ছিল স্বাভাবিক প্র্যাকটিস। ফলে বিলেতে ফিরে এসে স্কুলে ভর্তি হবার পর যখন দেখল সমান গুরুত্বের সাথে মেয়েদের খেলাধুলা হয়, তখন সে সুযোগটা কাজে লাগাতে পারেনি। সে সবসময় খেলাধুলায় পিছিয়ে থাকতো কারণ ছোটবেলা থেকে যথেষ্ট খেলাধুলা না করার কারণে তার ফিটনেস লেভেল ক্লাসের অন্যান্য মেয়েদের চেয়ে অনেক নিচে ছিল।
ফুটবল খেলার প্রতি আমার মেয়ের ভীষণ আগ্রহ, খেলাটা সে ভাল বোঝে। ফ্যান্টাসি ফুটবলে তার স্কোর খুব ভাল, পরিচিত সকল ছেলেদের থেকে অনেক উপরে। কিন্তু জীবনে সে এই খেলাটা নিজে খেলার সুযোগ পেল না। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে আজকাল মেয়েরা ফুটবল খেলছে, ছেলেদের চেয়ে ভাল খেলছে। অথচ আমার মেয়ের জন্য ব্যাপারটা এখন টু লেট আর এজন্য আমি নিজেও দায়ী। আমি কখনো ব্যাপারটা খেয়ালই করিনি, তাকে খেলার সুযোগ করে দেয়ার ব্যাপারে সচেষ্ট হইনি। আমি মা হিসেবে ঘরে যতই সমতা বজায় রাখার চেষ্টা করে থাকি না কেন, এই সমাজের মানুষ হিসেবে পুরষতন্ত্রের বিষ-বাতাস আমাদেরকেও ছাড়েনি। ভীষণ কষ্ট লাগছে এই ভেবে যে ফিরে গিয়ে সবকিছু আবার নতুন করে করার সুযোগ নেই। এজন্যই আমি প্রায়ই বলি জীবন-খেলায় একটা প্র্যাকটিস রান আর একটা আসল খেলা হলে চমৎকার হতো। এমন হলে আমরাও আবার ফিরে গিয়ে নতুন করে জীবন শুরু করতে পারতাম, মা মেয়ে মিলে ফুটবল খেলতে পারতাম। আহা, বিজ্ঞানীরা একটা টাইম মেশিন যদি আবিষ্কার করে ফেলতেন। দয়া করে আমাকে নিয়ে হাসবেন না কেউ । মেয়ের তরফ থেকে স্বপ্নে ঘি খাচ্ছি যেহেতু, একটু বেশি করেই খাই। তারপরও আমাদের পরিবারের তিন প্রজন্মের মেয়েদের অবস্থা বিচার করতে গিয়ে কিছুটা আশার আলো দেখতে পাই আমি, কারণ পুরুষতন্ত্রের বিষের মাত্রা কিছুটা হলেও ডাইলুটেড হয়ে আসছে।
আমার মা স্কুলের চৌকাঠের ভেতরে কখনো পা দেননি, ঘরে বসে ভাইদের কাছ থেকে কোনোমতে পড়তে লিখতে শিখেছিলেন। আমার সময়ে এসে মেয়েদের স্কুলে যাওয়া একটা স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছিল, কিন্তু মেয়েদের সাইকেল চালানো তখনো একটা অস্বাভাবিক ব্যাপার বলে বিবেচিত ছিল বিধায় ভাইকে সাইকেল দেয়া হয়েছিল, আমাকে দেয়া হয়নি। আমার মেয়ের সময়ে মেয়েদের সাইকেল চালাতে শেখা একটা স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হলেও তাদের পথেঘাটে সাইকেল চালানো বা ফুটবল খেলার প্রচলণ হয়নি তখনো।
এসব নিয়ে মেয়ের সাথে আলাপ করছিলাম আজ। সে তার নিজের ভবিষ্যত প্রজন্মকে পরিপূর্ণ ভাবে পুরুষতন্ত্র-প্রুফ পরিবেশে বড় করতে বদ্ধ পরিকর। আমি জানি সে পারবে। বেঁচে থাকলে আমিও সমস্ত শক্তি নিয়ে তার পাশে থাকব। আমার নতুন স্বপ্ন- মেয়ের ঘরে একটা নাতনী হবে, ফুটবল খেলবে, মেডেল জিতবে। ততদিন বেঁচে থাকলে হয়।
লেখক: অভিবাসী শিক্ষক এবং অনুবাদক ।
এইচআর/পিআর