পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস
এই লেখাটির শিরোনাম দেখে যে কেউ একটু অবাক হয়ে যাবে। কোনো কিছুকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় হিসেবে দাবি করে ফেলাটা নিঃসন্দেহে বাড়াবাড়ি মনে হতে পারে। সেই দাবিটি যদি প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস নিয়ে করা হয় সেটাকে অবিশ্বাস করা হলে অবাক হবার কিছু নেই। কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি আমি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস নিয়ে আমার অভিজ্ঞতাটুকু লিখতে বসেছি।
কয়েক মাস আগে কুলিয়ারচরের ইউএনও আমাকে ফোন করলেন। তার পরিচয় জেনে আমি যথেষ্ট মুগ্ধ হলাম। নাম ডক্টর উর্মি বিনতে সালাম। আমাদের দেশের ইউএনওরা ডক্টরেট করছেন জেনে মুগ্ধ না হয়ে উপায় কী? ডক্টর উর্মি ফোনে আমাকে যেটা বললেন সেটা শুনে আমি চমৎকৃত হলাম। তিনি বললেন, স্কুলের ছেলেমেয়েদের নিয়ে বিজ্ঞানের সবচেয়ে বড় প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসটি অস্ট্রেলিয়াতে অনুষ্ঠিত হয়েছে, তিনি তার চাইতে বড় একটি ক্লাস করাতে চান। অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশে তাদের সকল সাহায্য-সহযোগিতা সুযোগ-সুবিধা সহায় সম্পদ-নিয়ে যে বিশ্ব রেকর্ডটি তৈরি করা হয়েছে বাংলাদেশের একটি উপজেলাতে সেটি ভাঙার পরিকল্পনা করতে বুকের পাটা লাগে। আমি তাঁর বুকের পাটা দেখে যথেষ্ট অবাক হলাম।
তিনি আমার কাছে একটা সাহায্য চাইলেন, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় যে প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসটির আয়োজন করা হয় আমাকে সেটি নিতে হবে। আমি খুব আনন্দের সাথে রাজি হয়ে গেলাম। স্কুল কলেজের ছেলেমেয়েদের সাথে কিছু একটা করার সুযোগ পাওয়া আমার জন্যে বিশাল বড় একটা ব্যাপার।
আমি ডক্টর উর্মির প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলাম সত্যি, কিন্তু তিনি আদৌ সেটা করতে পারবেন সেটা নিয়ে আমার ভেতরে তখনও যথেষ্ট সন্দেহ ছিল। অস্ট্রেলিয়ার বিশ্ব রেকর্ডটি ভাঙতে হলে একটা ক্লাসরুমে কমপক্ষে তিন হাজার দুইশত ছাত্রছাত্রীকে হাজির করতে হবে। তাদেরকে হাতেকলমে কোনো একটা এক্সপেরিমেন্ট করাতে হবে। এত বড় ক্লাসরুম কোথাও নেই, তাই সেটা তৈরি করতে হবে। ছাত্রছাত্রীদের বসার জন্যে চেয়ার টেবিল যোগাড় করতে হবে। ছেলেমেয়েদের নিজ হাতে করার জন্যে সমান সংখ্যক এক্সপেরিমেন্ট দাঁড় করাতে হবে। এর কোনোটাই খুব সহজ নয়।
সাহস থাকলেই বড় একটা পরিকল্পনা করে ফেলা যায়। কিন্তু শুধু সাহস দিয়ে বড় পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা যায় না। কাজেই আমি খানিকটা দুশ্চিন্তা নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকি। আমার মনে হতে থাকে, কিছুদিনের ভেতরই ডক্টর উর্মির আরও একটা ফোন পাব যখন তিনি লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলবেন যে, তিনি শেষ পর্যন্ত ম্যানেজ করতে পারলেন না, তাই এবারের মতো পরিকল্পনাটি স্থগিত করা হল।
কিন্তু সেই টেলিফোন এল না এবং আমি যখন খোঁজ নিলাম তখন জানতে পারলাম, সত্যি সত্যি তিনি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসটির আয়োজন করার কাজ করে যাচ্ছেন। আমি তখন ছেলেমেয়েদের উপযোগী কয়েকটা এক্সপেরিমেন্ট দাঁড় করালাম। ছোট বাচ্চাদের চুম্বক নিয়ে এক ধরনের কৌতূহল থাকে। তাই আমি চুম্বক তৈরি করা, তাদের বিপরীত মেরুতে আকর্ষণ সমমেরুতে বিকর্ষণ, কম্পাসের উত্তর দক্ষিণ হয়ে থাকা এই বিষয়গুলো নিয়ে কিছু এক্সপেরিমেন্ট দাঁড় করালাম। সেগুলো দাঁড় করানের সময় লক্ষ্য রাখতে হল খুব অল্প খরচে সেগুলো যেন দাঁড় করানো যায়। কুলিয়ারচর অস্ট্রেলিয়ার নয়। এদেশে কিছু একটা করতে হলেই প্রথমেই আমাদের দেখতে হয় কত কম টাকায় সেটা আয়োজন করা যায়।
জানুয়ারির ২ তারিখ কুলিয়ারচরে একটা সাংবাদিক সম্মেলনের আয়োজন করা হল। সাংবাদিক সম্মেলন নিয়ে আমার অভিজ্ঞতা খুব ভালো না। হোটেল সোনারগাঁও বা শেরাটনে সাংবাদিক সম্মেলনের আয়োজন করা হলে আমি সাংবাদিকদের উৎসাহ নিয়ে যেতে দেখেছি। ছোটখাটো জায়গায় সে রকম উৎসাহ দেখিনি। আমি ডক্টর উর্মিকে বলে রাখলাম, কুলিয়ারচরের সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি যেন খুব বেশি সাংবাদিকদের আশা না করেন এবং সেই সংবাদ পত্রপত্রিকায় ছাপা হবে সেটিও যেন আশা না করেন। এটি একটি অনুষ্ঠানিকতা এবং তিনি যে তার পরিকল্পনামতো এগিয়ে যাবেন আর শেষ মুহূর্তে পিছিয়ে আসতে পারবেন না তার একটা ঘোষণা ছাড়া কিছু নয়।
কাজেই সাংবাদিক সম্মেলন হয়ে গেল এবং আমি আমার সহকর্মী আর ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসের ছেলেমেয়েদের জন্যে এক্সপেরিমেন্টর একটা কিট তৈরি করার কাজ শুরু করে দিলাম। এসব ব্যাপারে আমি আসম্ভব ভাগ্যবান। কিছু একটা করতে চাইলেই আমি আমার সহকর্মী এবং ছাত্রছাত্রীদের পেয়ে যাই। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা ধরনের সংগঠনের মাঝে ‘বিজ্ঞানের জন্যে ভালোবাসা’ নামেও একটা সংগঠন আছে। তাদের সব সদস্য মিলে দিনরাত খেটেখুটে বিজ্ঞানের এক্সপেরিমেন্ট করার জন্যে কিটগুলো তৈরি করে ফেলল।
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসের জন্যে নির্দিষ্ট দিনটি হচ্ছে জানুয়ারি মাসের ১১ তারিখ। আমরা বাস-বোঝাই ভলান্টিয়ার নিয়ে একদিন আগেই সেখানে পৌছে গেলাম। আমরা গিয়ে দেখি বিশাল আয়োজন, এত বড় প্যান্ডেল আমি জীবনে দেখিনি, এক কোনায় দাঁড়ালে অন্য কোনা প্রায় দেখা যায় না। চারজন করে বসতে পারে সেরকম বেঞ্চ এবং টেবিল বসানো হয়েছে। একেক সারিতে ২৫টি করে বেঞ্চ এবং টেবিল, সারির সংখ্যা ৩২। আগামীকাল এখানে তিন হাজার দুইশত ছেলেমেয়ে এসে বসে আমার কাছে প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস করবে। চিন্তা করেই আমার মাথা ঘুরে যাবার অবস্থা!
আমাদের জন্যে ডাকবাংলোয় রাত কাটানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। পরদিন ভোরে হঠাৎ শুনতে পেলাম পাশের রাস্তায় ছোট শিশুদের কলবর। বারান্দায় এসে দেখতে পেলাম রীতিমতো উৎসবে যোগ দেওয়ার আনন্দ নিয়ে কোনো একটা স্কুলের ছেলেমেয়েরা প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস করতে যাচ্ছে। ছেলেমেয়েগুলো দেখে আমি একটু হকচকিয়ে গেলাম। আমি জানি পঞ্চম থেকে সপ্তম শ্রেণির ছেলেমেয়েরা আসবে। কিন্তু ওরা যে এত ছোট সেটা আমি মোটেও অনুমান করিনি। এই ছোট ছোট বাচ্চারা কি প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসে বাস চুম্বক তৈরি করে সেটা দিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করতে পারবে?
যাই হোক নির্দিষ্ট সময়ে আমি মাঠে হাজির হয়েছি। প্যান্ডেলের চারপাশে দশটি গেট। এই দশটি গেট দিয়ে সারি বেঁধে ছেলেমেয়েরা ভেতর ঢুকছে। তাদেরকে নিশ্চয়ই এই বিশাল দক্ষযজ্ঞ নিয়ে প্রস্তুত করা হয়েছে। তার কারণ এত কমবয়সী ছেলেমেয়েদের এত কঠিন শৃঙ্খলা দিয়ে আমি এর আগে কোথাও ঢুকতে দেখিনি।
অনুষ্ঠান উদ্বোধন করার জন্যে ঢাকা থেকে আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক এবং এমপি নাজমুল হাসান পাপন হেলিকপ্টারে করে আসবেন। হেলিকপ্টারে তারা সময়মতো পৌছাতে পারবেন না বলে আমাদের নির্দিষ্ট সময়ে ক্লাস শুরু করে দিতে বললেন। অনেক ভোরেই ছেলেমেয়েরা চলে এসেছে। এটা পৌষ মাস। কিন্তু পৌষের শীতের কোনো লক্ষণ নেই। প্যান্ডেলেরন ভেতর গরমে সবাই ঘামছে। দুপুর বারোটা থেকে শুরু করে দেড় ঘণ্টার প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস হবার কথা। কাজেই আমরা যদি দেরি করি তাহলে বাচ্চাদের কষ্ট দেবার একটা বিশ্ব রেকর্ড হয়ে যেতে পারে। তাই আমরা ক্লাস শুরু করে দিলাম।
এটা যদি সত্যি সত্যি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস হিসেবে প্রমাণ করা যায় তাহলে আমিও নিঃসন্দেহে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসের শিক্ষক হিসেবে নিজেকে দাবি করতে পারি! পৃথিবীর কতজন মানুষের এরকম সৌভাগ্য হবে পারে?
আমি মনে মনে যে বয়সী ছেলেমেয়ে আশা করছিলাম এই প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসের ছেলেমেয়েরা তার থেকে অনেক ছোট। আমি খুব দুশ্চিন্তার মাঝে ছিলাম, তারা সত্যি সত্যি আমার সাথে তাল মিলিয়ে এক্সপেরিমেন্টগুলো করতে পারবে কি না। কিন্তু শুরু করার পর আমি মুগ্ধ বিস্ময় নিয়ে আবিস্কার করলাম, তাদের জন্যে সেগুলো ডালভাত! লোহার পেরেকে তার প্যাঁচাতে গিয়ে আমি আধাআধি আসার আগেই তারা পুরোটুকু শেষ করে চুম্বক তৈরি করে এক্সপেরিমেন্ট করতে শুরু করেছে!
আমার বলতে দ্বিধা নেই, তিন হাজার দুইশ কমবয়সী ছেলেমেয়ের এই প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস নেওয়াটি ছিল আমার জীবনের একটি সর্বশ্রেষ্ঠ আনন্দের মুহূর্ত। শিশুরা সেই কাকভোরে হাজির হয়েছে। গরমে সেদ্ধ হতে হতে তারা বসে বসে গভীর মনোযোগ দিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করছে। আমি যখন যেটি বলছি তারা সেটি করছে। এর চাইতে আনন্দময় দৃশ্য আর কী হতে পারে?
এই বয়সী ছেলেমেয়েদের চুপচাপ বসে থাকার কথা নয়। কিন্তু মজার ব্যাপার হল, আমি যতবার তাদের চুপ করে যেতে বলেছি তারা ম্যাজিকের মতো নিশ্চুপ হয়ে গেছে। তিন হাজার দুশ ছেলেমেয়ে এতটুকু শব্দ না করে প্রয়োজনে পুরোপুরি নিঃশব্দে বসে আছে। মনে হচ্ছে নিঃশ্বাসের শব্দটুকুও আলাদাভাবে শোনা যাবে। আমার মনে হয়েছে সেটাও নিশ্চয়ই একটা বিশ্ব রেকর্ড হতে পারে!
যথাসময়ে ঢাকা থেকে অতিথিরা হেলিকপ্টারে কুলিয়ারচরের এই বিশাল দক্ষযজ্ঞে উপস্থিত হলেন। ছোট একটুখানি আলোচনাপর্ব হল। সবাই ছোট স্টেজে দাঁড়িয়ে কথা বলেছেন। শ্রোতারা যেহেতু ছোট ছেলেমেয়ে, কাজেই তাদের উদ্দেশ্য করেই কথাবার্তা বলা হল এবং আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমদ পলকের একটা কথা আমার কানে মধু ঢেলে দিল। তিনি ছেলেমেয়েদের বললেন, তারা কুলিয়ারচরের যে ২৮টি ভিন্ন ভিন্ন স্কুল থেকে এসেছে, সেই ২৮টি স্কুলের প্রত্যেকটিতে একটি করে কম্পিউটার ল্যাবরেটরি তৈরি করে দেবেন।
গিনিজ বুক অব রেকর্ড তৈরি করার জন্যে অনেক চুলচেরা নিয়ম মানতে হয়। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসের আয়োজন করার সময় প্রাণপণ চেষ্টা করা হয়েছে সেই নিয়মগুলো মানার। এখন তাদের কাছে আবেদন করা হবে এবং আগামী কয়েক সপ্তাহ পর আমরা জানতে পারব সত্যি সত্যি আমরা বিশ্ব রেকর্ড তৈরি করতে পেরেছি কি না।
তবে আমার মনে হয় কুলিয়ারচরের ছেলেমেয়েরা বিশ্ব রেকর্ড তৈরি করার থেকেও বড় একটি রেকর্ড তৈরি করে ফেলেছে। পঞ্চম থেকে সপ্তম শ্রেণির ছোট ছোট শিশুরা সবাই তাদের নিজেদের স্কুলের জন্যে একটা করে কম্পিউটার ল্যাবরেটরি উপহার দিয়েছে। পৃথিবীর কতজন শিশু এত বড় একটা অর্জন করতে পারে?
সব কিছু দেখে আমার মাঝে মাঝেই মনে হয়, আহা, বেচেঁ থাকাটা কী আনন্দের!
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।
এআরএস/এমএস