বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের আগে ও পরে
পঁচিশে মার্চ পাক হানাদারদের আক্রমণ শুরু হলে বঙ্গবন্ধু সবাইকে সরে যেতে বলে নিজে ধরা দিয়েছিলেন এ বিষয়ে তাঁর দুটি যুক্তি ছিল-এক. আত্মগোপন করে পালাতে গিয়ে ধরা পড়লে তা হত লজ্জার এবং তাতে মানুষের মনোবলও ক্ষতিগ্রস্ত হত, দুই. তাঁর মত পরিচিত একজন নেতার পক্ষে আদতে আত্মগোপন করাই হত অসম্ভব।
তাঁর অনুপস্থিতি মুক্তিযুদ্ধে দু’ভাবে আমাদের সাহস ও শক্তি দিয়েছে-এক. নেতার অনুপস্থিতি সবার মনে বাড়তি ভাবাবেগ ও দায়িত্ববোধ সৃষ্টি করেছিল, দুই. তাঁর আত্মত্যাগের দৃষ্টান্ত জাতিকে আত্মত্যাগে উদ্বুদ্ধ করেছিল। দেখা গেল অনুপস্থিত মুজিবের শক্তি যেন আরো বেশি।
বঙ্গবন্ধু যদি কোনোভাবে প্রবাসী সরকারের সাথে থাকতে পারতেন তাহলে হয়ত কনফেডারেশনের চাপ ও ষড়যন্ত্র কেবল বাড়তই। বন্দির ও ফাঁসির আসামির ভূমিকায় থেকে কঠোর অবস্থানে থাকাই স্বাভাবিক যখন মুক্ত স্বাভাবিক অবস্থায় সাধারণত নমনীয় হওয়ার ঝোঁক থাকে।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সময়ও আমরা দেখেছি আমাদের নেতা অকুতোভয়, কোনো রকম আপসে রাজি নন এবং সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারের জন্য সদা প্রস্তুত। মুক্তিযুদ্ধের নয়মাসও তিনি এই দৃঢ়তা দেখিয়ে গেছেন। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে তাঁর দক্ষিণ হাত প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ অনুপস্থিত নেতার ভাবমূর্তিকে সঠিকভাবে কাজে লাগিয়েছেন, সরকারের ঐক্য ধরে রেখেছেন এবং স্বাধীনতার লড়াইকে চূড়ান্ত লক্ষ্যে নিয়ে গেছেন। আর সমরাঙ্গণের জন্য সৈনিকরা- লেখক চিত্রকর গায়ক বুদ্ধিজীবী ও অন্যান্য শিল্পীরা বঙ্গবন্ধুর মাহাত্ম্যকে পুঁজি করে প্রচার যুদ্ধে হানাদারদের অনেক পেছনে ফেলেছিল। সেদিন মানুষের মনে এমন ভাবাবেগ তৈরি হয়েছিল যা বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশকে এক সূতোয় গেঁথে দিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু সেদিন প্রত্যেকের অন্তরে জায়গা করে নিয়েছিলেন।
তাই ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সনে চূড়ান্ত বিজয় অর্জন সত্ত্বেও মানুষের মনে অতৃপ্তি ছিল। নানা আশংকাও তৈরি হচ্ছিল। তাদের মনে তীব্র ভাবাবেগ ছিল বঙ্গবন্ধুর জন্যে। সাধারণ মানুষ, একজন মুক্তিযোদ্ধার মনে যেমন ছিল তেমন বা তার চেয়েও জোরালোভাবে ছিল যুদ্ধকালের কাণ্ডারি তাজউদ্দিনের মনে। তাই তো দেখি ১০ই জানুয়ারি বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুকে পেয়ে তাঁর বাঁধভাঙা আবেগের প্রকাশ। ততদিনে বঙ্গবন্ধু একজন রাজনৈতিক নেতা বা দল আওয়ামী লীগের সভাপতির পদ ছাপিয়ে জাতির জনক, সব মানুষের নেতা। যুদ্ধ এ জাতিকে রূপান্তরিত করে ঐক্যবদ্ধ করেছিল, শিখিয়েছিল লড়তে আর প্রকৃত বীরের মত ত্যাগ করতে। সেই ঐক্যবদ্ধ বীর ত্যাগী জাতির নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। পিতা, নেতা এবং প্রশাসক একযোগে হওয়া বেশ কঠিন। বাংলাদেশের বাস্তবতায় তা আরো কঠিন।
পাকিস্তান বাঙালিকে নানাভাবে কেবল অপদস্থ করেনি, বঞ্চিত ও নিঃস্ব করেছিল। ফলে দেশটির অর্থাৎ পাকিস্তানের পশ্চিমা শাসকদের বিরুদ্ধে বাঙালির মনে ছিল ক্ষোভ। তাদের পরাজয়ে সে ক্ষোভ মিটেছে বটে, কিন্তু তাতেই তো মানুষের মনোবাসনা শেষ হয় না। এবার বরং এতদিনের বঞ্চনা, অপমানের শোধ তুলতে চায় সবাই। পেতে চায় নিজের হিস্যা। এ পরিণতি অনভিপ্রেত, কিন্তু একদম অবাস্তবও নয়। বঙ্গবন্ধু দ্রুতই হাল ধরেছিলেন। এর আগে নয়মাস ধরেই প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনের নেতৃত্বকে নানা উপদল উপেক্ষা করতে চেয়েছে। ইন্দিরা গান্ধীর সরকার অবশ্য সে সর্বনাশ ঠেকাতে সাহায্য করেছে বরাবর। তাতে উৎরে গেছে প্রবাসী সরকার। বঙ্গবন্ধু সাংবিধানিক ও আইনের হাত ধরে নিয়মতান্ত্রিকভাবে এগুতে চাইলেন। নিয়মতান্ত্রিক সে প্রয়াস নানান অনভিপ্রেত চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হল জাসদ, চরমপন্থী বিভিন্ন দল, ছদ্মবেশী জামায়াত, মুসলিম লীগ মিলে সরকারের জন্য সমস্যা পাকিয়ে তুলেছিল। তার উপর খোদ আওয়ামী লীগের ভিতর থেকে খোন্দকার মোশতাকসহ অনেকেই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। আবার আরেক দল-তারাও সংখ্যায় কম নয়-বিজয়কে দখলে রূপান্তরিত করেও সরকারের জন্য সমস্যা বাড়াল।
১০ই জানুয়ারি দেশের মাটিতে পা রাখার আগে বঙ্গবন্ধু যখন লন্ডনের বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের বলছিলেন- এ আমার অন্ধকার থেকে আলোর পথে যাত্রা তখন মানুষের মনে আনন্দ ও আশাবাদ বাঁধ মানেনি। এক বুক আশা নিয়ে সাড়ে সাতকোটি মানুষ এ দিন তাদের প্রাণপ্রিয় নেতাকে বরণ করেছিল। কিন্তু কিছু মানুষের অবিমৃষ্যকারিতা আর কিছু মানুষের ষড়যন্ত্রের ফলে মানুষের আনন্দ ও আশা খুব দ্রুত, অন্তত তখনকার মতো, নিভে গিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর অমরত্বের প্রদীপের সলতেই উজ্জ্বল হয়ে জ্বলে উঠেছিল সাতই মার্চ আর ষোলই ডিসেম্বর তার জয়ভেরী বেজে ওঠেছিল হানাদার পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণের মাধ্যমে। কিন্তু দশই জানুয়ারির আনন্দময় আবেগের যেন সমাপ্তি ঘটেছিল পনের আগস্টের ত্রাস ও বিপদের মধ্যদিয়ে।
প্রায় চার দশক পরে সেই বিষাদের পেছনে যে অপরাধ ঘটেছিল তার বিচার করলেন বঙ্গবন্ধুর কন্যা। সাতই মার্চের প্রদীপ্ত শিখা আবারও চেতনার সলতে জ্বালিয়ে তুলল সবার মনে। সেই আলোয় পনের আগস্টের কলঙ্ক যেমন দূর হয়েছে তেমনি ফিরে আসছে আবার দশই জানুয়ারির আনন্দ ও আশাবাদ। এটা যেন হয় বাংলাদেশের স্বখাতে প্রত্যাবর্তন এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার জোয়ারে সার্থকতার সমুদ্রসঙ্গমে পৌঁছানোর কাল। তাহলেই দশই জানুয়ারি যথার্থ মহিমা ও তাৎপর্য ফিরে পাবে।
লেখক : কবি, সাংবাদিক, সমাজচিন্তক।
এইচআর/এমএস