ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

পিতার মুক্তি, আলোয় আলোয়

প্রকাশিত: ০৬:০২ এএম, ১০ জানুয়ারি ২০১৭

বাংলাদেশ আর বঙ্গবন্ধু এক সমার্থক শব্দের নাম। বাংলাদেশের ইতিহাস আর বঙ্গবন্ধুর জীবনের ইতিহাস তাই পাশাপাশি হাত ধরে হেঁটে চলে। ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানি সেনা কর্তৃক গ্রেফতার হওয়ার আগে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ঘোষণাটি পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী ঢাকার ইপিআর (বর্তমান বিজিবি) হেড কোয়ার্টার থেকে ওয়ারলেসের মাধ্যমে চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের কাছে প্রেরণ করা হয়। চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে সেই ঘোষণা প্রচারিত হতে থাকে এছাড়া টেলিগ্রাম, টেলিপ্রিন্টারে সমগ্র বাংলাদেশে এই ঘোষণা পৌঁছে দেয়া হয়। এ অপরাধে ২৬শে মার্চের ওই রাতেই পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাদের নির্ধারিত পরিকল্পনা অনুযায়ী ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়ি থেকে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে এবং পুরো পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখে বাঙালির স্বাধীনতার স্বপ্নকে বাক্সবন্দি করার ব্যর্থ চেষ্টায় মেতে ওঠে। দূরদর্শী বঙ্গবন্ধু আগে থেকেই দেশবাসীকে জনযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করে রেখেছিলেন। ৭ই মার্চের ভাষণে জানিয়ে রাখেন যুদ্ধকালীন দিকনির্দেশনা। গ্রেফতার করেই বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীনতার সে দাবি থেকে সরে আসতে বলে  মৃত্যুর হুমকি দেয়া হয় কিন্তু মৃত্যুঞ্জয়ী মুজিব সাফ জানিয়ে দেন বাঙালির অধিকার ছাড়া তিনি কোনো কিছু মানবেন না।

কূটকৌশলে সর্বদা ব্যস্ত পাকিস্তানি সেনা শাসক প্রথমে গ্রেফতার করে তাকে করাচি নিয়ে যায়। পরে পাকিস্তানের লায়ালপুর কারাগারে বন্দি করে রাখে। ১৯৭১ সালের ৩ আগস্ট পাকিস্তান টেলিভিশন জানায় ১১ আগস্ট থেকে সামরিক আদালতে শুরু হবে বঙ্গবন্ধুর বিচার। এ ঘটনায় উদ্বিগ্ন বাঙালি জাতির পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদ ও উদ্বেগের ঝড় বয়ে যায়। বিচারপতি আবু সাঈদের নেতৃত্বে প্রবাসী বাঙালিরা আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবী সন ম্যাক ব্রাইডকে ইসলামাবাদ পাঠান। কিন্তু পাকিস্তানি জান্তা সরকার তাদের ষড়যন্ত্রকে সফল করতে বিদেশি আইনজীবীর ব্যাপারে আপত্তি করেন। ১৯৭১ এর ১০ আগস্ট পাকিস্তানি জান্তা সরকার আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য বঙ্গবন্ধুর জন্য একে ব্রহীকে নিয়োগ দেন। কিন্তু ইয়াহিয়ার ২৬শে মার্চের ভাষণ শোনার পর অকুতোভয় বঙ্গবন্ধু আত্মপক্ষ সমর্থন করতে অস্বীকার করেন। কারাগারে পাঠিয়ে ইয়াহিয়া বিচারের নামে এক ধরনের প্রহসন শুরু করে। ১৯৭১ এর ৪ ডিসেম্বর মিলিটারি ট্রাইব্যুনালে বঙ্গবন্ধুর ফাঁসির আদেশ হয়। লায়ালপুর থেকে তখন তাঁকে মিয়ানয়ালি কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হয়। বঙ্গবন্ধুকে মানসিকভাবে দুর্বল করার জন্য তাঁর সেলের পাশেই তাঁর কবর খোঁড়া হয়। বঙ্গবন্ধু  মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি নিয়ে নির্বিকার চিত্তে কেবল তাঁর লাশটি বাংলার মানুষের কাছে পাঠানোর আবেদন জানান, তবুও বাংলার জনগণের সম্মান এতোটুকু ভূলুণ্ঠিত হতে দেন না।

এদিকে হৃদয়ে বঙ্গবন্ধুকে ধারণ করে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত মুক্তির পথেই তখন মুক্তিকামী বাঙালি। ১৬ ডিসেম্বরে ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সৈন্যের আত্মসমর্পণের ভেতর দিয়ে চূড়ান্ত বিজয়ের পর পরাজিত কুখ্যাত ইয়াহিয়া জুলফিকার আলী ভুট্টোর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের আগেও বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে তার ভুলের মাশুল দিতে চান। David Wolplert, New York এর Oxford University Press থেকে প্রকাশিত তার “Zulfi Butto of Pakistan” বইয়ের ১৭৩ থেকে ১৭৬ পৃষ্ঠায় ইয়াহিয়ার উদ্ধৃতিতে বলেন, “Mr. Bhutto, I’ve made the greatest blunder (of my life)of not killing Sheikh Mujibur Rahman .Now kindly allow us before handing over power ,to kill Sheikh Mujibur Rahman giving antedate, beack-date hanging and then hand over power” । কিন্তু আন্তর্জাতিক চাপ ও পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দিদের প্রত্যার্পণের কথা ভেবে তখন নেতাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় যুদ্ধে পরাভূত, বিপর্যস্ত এবং বিশ্ব জনমত থেকে বিচ্ছিন্ন রাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো।

ল্যাপটপের কিবোর্ড চেপে ধারাবাহিকটির বর্ণনা যতোটা সহজে করা হলো বাস্তবতা যে ঠিক ততটাই কঠিন ছিল, সময়ের সিঁড়ি যে ঠিক ততটাই দুর্গম আর অন্ধকারাচ্ছন্ন ছিল ইতিহাস ঘেঁটে সে বাস্তবতাটুকু সহজেই অনুমেয়। রবি ঠাকুরের সাড়ে সাত কোটি বাঙালি যে তাঁর সোনার কাঁঠি রুপোর কাঁঠির জাদুর ছোঁয়ায় ইতোমধ্যেই বীর বাঙালি হয়ে উঠেছে তা নেকড়েসদৃশ পাকিস্তানি হানাদাররা না বুঝলেও বঙ্গবন্ধু ঠিকই বুঝেছিলেন। মৃত্যুর কোলে শুইয়ে রেখে নানা ধরনের প্রলোভনের ফাঁদে আটকে ফেলার চেষ্টায় ব্যর্থ শাসকরা পরাজয়ের গ্লানি থেকে বাঁচতে শেষ মুহূর্তে শুরু করে করুণ আকুতি। বঙ্গবন্ধু কেবল অকুতোভয়, দেশপ্রেমিক রাজনীতিকই ছিলেন না, ছিলেন দূরদর্শী ও বিচক্ষণ।

এদিকে দীর্ঘ নয় মাস নানা ত্যাগ তিতিক্ষার পর ১৬ ডিসেম্বর মুক্তির দুয়ার খুললেও বাঙালির জীবন সবটুকু মুক্তির স্বাদ তখনো গ্রহণ করতে পারেনি, বরং অজানা অমঙ্গল আশঙ্কায় ক্ষণে ক্ষণে হৃদয় কেবল অশুভ বার্তা বয়ে আনছিল, পিতার জীবন তখনো অনিশ্চিত আর সংশয়ে ঘেরা। ৮ ই জানুয়ারি পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্তির খবর বাঙালির হৃদয়ে তাই আনন্দের বান ডেকেছিল, সে বানে খড়কুটোর মতো ভেসে গিয়েছিল দীর্ঘ ৯ মাসের অবর্ণনীয় সব কষ্ট। পিতা ফিরে আসছে, আলোয় আলোয় উদ্ভাসিত চারিধার, নব উল্লাসে জাগে প্রাণ, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এখন কেবল দেশ গড়ার সময়। বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী বিমান ঢাকা এসে পৌঁছায় ১০ জানুয়ারি।

অবশেষে সেই স্বর্গীয় দৃশ্য, নেতা নেমে এলেন ব্রিটিশ রাজকীয় বিমান বাহিনীর কমেট জেট থেকে। ২১ বার তোপধ্বনি আর হৃদয়ের সবটুকু ভালোবাসা ডালায় সাজিয়ে বাঙালি বরণ করে নিল তার পিতাকে। আনন্দে আত্মহারা লক্ষ লক্ষ মানুষ ঢাকা বিমানবন্দর থেকে রেসকোর্স ময়দান পর্যন্ত তাঁকে ঘিরে আবেগের বৃত্ত এঁকে যান। পিতার চোখে আনন্দাশ্রু, মুখে স্মিত হাসি, তাঁর বাঙালি আজ সত্যিই বীর হয়েছে, তাঁর সোনার বাংলা আজ স্বাধীন হয়েছে। বিকেল ৫টায় প্রায় ১০ লক্ষ লোকের সমাবেশে তিনি সুখী সমৃদ্ধ বাংলাদেশের কাঙ্ক্ষিত ছবি এঁকে যান, রাষ্ট্রে হবে সমাজতন্ত্র ব্যবস্থা, থাকবে গণতন্ত্র, হবে ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র। স্বপ্নদ্রষ্টাই জানে তাঁর সপ্নের গতিপথ, কেবল স্বপ্নদ্রষ্টাই জানে তাঁর স্বপ্নের শেষ সীমা, বাঙালির কেবল পিতার দেখানো পথে হেঁটে যাবার পালা ।   

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]

এইচআর/জেআইএম

আরও পড়ুন