আমাকে বলতে দাও
ফেব্রুয়ারি মাসের অমর একুশে বইমেলার জন্য লেখক-প্রকাশক-পাঠকদের অপেক্ষা থাকে বছরজুড়ে। লেখকরা নিয়মিত কাজ থেকে ছুটি নিয়ে লিখছেন, ঘুম হারাম প্রকাশকদেরও। পাঠকের হাতে টাটকা বই তুলে দিতে ব্যস্ত সবাই। কিন্তু এবার একমাস আগেই আলোচনায় বইমেলা। দুঃখজনক হলো আলোচনাটা নেতিবাচক। অন্তত পাঁচটি প্রকাশনী সংস্থাকে বিভিন্ন মেয়াদে বইমেলায় নিষিদ্ধ করা হয়েছে। পাইরেটেড বই বিক্রির দায়ে পাঁচ বছরের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছে ঐক্য প্রকাশনী, নীলপরী প্রকাশনী, রঙিনফুল প্রকাশনী ও ব-দ্বীপ প্রকাশনীকে।
তবে এই চারটি প্রকাশনীর নিষিদ্ধ হওয়া নিয়ে কোনো আলোচনা নেই। একই সাথে দুই বছরের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছে শ্রাবণ প্রকাশনীকে। শ্রাবণ প্রকাশনীর নিষেধাজ্ঞা নিয়েই তোলপাড় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে, যার ঢেউ লেগেছে গণমাধ্যমেও।
শ্রাবণ প্রকাশনীর অপরাধ নিয়েই যত আলোচনা। গতবছর বাংলা একাডেমি বইমেলায় ‘ইসলামী বিতর্ক’ নামে একটি বই প্রকাশের মাধ্যমে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার অভিযোগে বন্ধ করে দেয়া হয় ব-দ্বীপ প্রকাশনীর স্টল।
গ্রেপ্তার করা হয় প্রকাশক শামসুজ্জামান মানিকসহ তিনজনকে। তখন বাংলা একাডেমির সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন শ্রাবণ প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী রবীন আহসান। একাধিক টক শো’তে অংশ নিয়ে রবীন আহসান বাংলা একাডেমির সিদ্ধান্তের তীব্র সমালোচনা করেছিলেন। এটাই তার অপরাধ। বইমেলা কমিটির সচিব জালাল আহমেদ জানিয়েছেন,‘একাডেমির সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করায় বৃহত্তর স্বার্থে শ্রাবণ প্রকাশনীকে দুই বছরের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছে।’
কী হাস্যকর অভিযোগ। বাংলা একাডেমির সমালোচনা করা যাবে না, এমন কথা কোন বাইবেলে লেখা আছে? বাংলা একাডেমি কি সমালোচনার উর্ধ্বে কোনো প্রতিষ্ঠান?
বাংলা একাডেমি ভুল করলে তার সমালোচনা করা যাবে না? রবীন আহসানকে আমি দীর্ঘদিন ধরেই চিনি। শুরুতে ঢাকায় তিনি বাম ঘরানার ছাত্র রাজনীতির পাশাপাশি ছড়া লিখতেন। লেখালেখি থেকেই তিনি পেশা হিসেবে বেছে নেন প্রকাশনাকে। রবীন আহসান সকল গণতান্ত্রিক, প্রথাবিরোধী আন্দোলনেই সামনের কাতারে থাকেন। সক্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও। একটু ঠোট কাটা হিসেবে তার পরিচিতি আছে। তার এই আন্দোলন, বক্তব্য, নানামুখী তৎপরতা অনেককেই বিব্রত করে থাকতে পারে। রবীন আহসানের সব বক্তব্য-অবস্থানের সাথে আমিও একমত নই। কিন্তু তিনি একটি প্রতিষ্ঠানের সমালোচনা করতে পারবেন না, করলে তাকে বইমেলায় নিষিদ্ধ করা হবে; এমন ফ্যাসিবাদী ধারণার সাথে আমি একমত নই। আমি সবধরনের নিষেধাজ্ঞার বিপক্ষে। মতপ্রকাশের সর্বোচ্চ স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি আমি। সবার বলার অধিকার আছে। বাংলাদেশের সংবিধানেও শর্তসাপেক্ষে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে।
সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে ‘১. চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল। ২. রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশি রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা বা নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিগঙ্গত বিধিনিষেধ সাপেক্ষে ক. প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাবপ্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের এবং খ. সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল।’ রবীন আহসান একজন ব্যক্তি। তার চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা সংবিধানে নিশ্চিত করা হয়েছে। তার কথা, তার বক্তব্য আমার পছন্দ নাই হতে পারে। অনেক সময় হয়ও না। না হলে আমি তার বক্তব্য খন্ডন করবো যুক্তি দিয়ে, পাল্টা বক্তব্য দিয়ে। গলা টিপে তার মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ করার অধিকার তো আমার নেই। মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সাথেই আছে দ্বিমতপ্রকাশের অধিকারও।
তোমার দ্বিমতপ্রকাশের অধিকার রক্ষায় প্রয়োজনে আমি জীবন দেবো, এটাই মতপ্রকাশের অধিকারের ধারণা। রবীন আহসান বা কারো বক্তব্যে যদি সংবিধানে দেয়া কোনো শর্ত লঙ্ঘিত হয়, সরকার তার বিরুদ্ধে মামলা করতে পারে, আইনানুগ ব্যবস্থাও নিতে পারে। কিন্তু একবছর আগের টক শো’র বক্তব্যের অপরাধে তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে নিষিদ্ধ করার অধিকার বাংলা একাডেমিকে কে দিয়েছে?
প্রতিদিন বিভিন্ন টিভির টক শো’তে অনেকেই সরকারের বিরুদ্ধে নানা সমালোচনা করেন। তার কিছু যৌক্তিক, কিছু অযৌক্তিকও আছে। কই সরকার তো তার সমালোচকদের দেশ থেকে বের করে দিচ্ছে না, তাদের গলা টিপে ধরছে না। তাহলে বাংলা একাডেমি কি সরকারের চেয়েও বেশি স্পর্শকাতর প্রতিষ্ঠান? রবীন আহসান বা অন্য কোনো ব্যক্তি কোথায় কী বলবেন, তা কি বাংলা একাডেমি ঠিক করে দেবে?
আমি বাংলা একাডেমির এই ফ্যাসিবাদী সিদ্ধান্তের তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি এবং অবিলম্বে এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের দাবি জানাচ্ছি। আমরা আগামী বইমেলায় শ্রাবণ প্রকাশনীর স্টল দেখতে চাই। তবে এই নিষেধাজ্ঞার সূত্র ধরে বাংলা একাডেমিকে যেভাবে তুলাধুনা করা হচ্ছে, বাংলা একাডেমিকে জামায়াতিদের আখড়া হিসেবে অভিহিত করা হচ্ছে, ‘পাকিস্তান একাডেমি’ বলে হেয় করা হচ্ছে, একাডেমির সম্মানিত মহাপরিচালক লোক গবেষক ড. শামসুজ্জামান খানকে যেভাবে অপমান করা হচ্ছে; তাও অনাকাঙ্খিত। অবশ্যই সবার মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আছে, তবে তা যেন শালীনতার মাত্রা ছাড়িয়ে না যায়। বাংলা একাডেমি আমাদের অহঙ্কার, আমাদের প্রাণের প্রতিষ্ঠান। ৫২ এর ভাষা আন্দোলনের চেতনার পথ ধরে ঐতিহাসিক বর্ধমান হাউসে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলা একাডেমি। ৫৫ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে বাংলা একাডেমি বাংলা ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতির বিকাশে দারুণ ভূমিকা রেখেছে। বইমেলার ধারণাটি মুক্তধারার চিত্তরঞ্জন সাহার ফুটপাতে চট বিছিয়ে বই বিক্রির উদ্যোগ থেকে এলেও, বাংলা একাডেমির বছরের পর বছর দারুণ
দক্ষতায় বইমেলার আয়োজন করে আসছে। একুশের বইমেলা এখন বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির কেন্দ্রে। বাংলা একাডেমির দায়িত্ব সুশৃঙ্খলভাবে বইমেলার আয়োজন করা; বইমেলাকে, ব্যক্তির মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে শৃঙ্খলিত করা নয়। বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠার চেতনাই হলো, মানুষের বলার অধিকার রক্ষা করা।
সামগ্রিকভাবে মতপ্রকাশের অধিকার রক্ষা করার জন্যও বাংলা একাডেমির মর্যাদা সমুন্নত রাখা জরুরি। একটি হঠকারী সিদ্ধান্ত দিয়ে বাংলা একাডেমির ৬০ বছরের অর্জন ধুলায় লুটিয়ে দিলে ক্ষতি তো আমাদেরই।
আমরা কোনো শৃঙ্খল, কোনো নিষেধাজ্ঞা চাই না। আমরা বলতে চাই স্বাধীনভাবে, দায়িত্বশীলতার সাথে।
২৭ ডিসেম্বর, ২০১৬
[email protected]
এইচআর/আরআইপি