ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

শাওনের গেরুয়া জ্যাকেট আর সেই অমানিশার ছায়া!

প্রকাশিত: ০৪:০৪ এএম, ০৭ ডিসেম্বর ২০১৬

শহীদ আলতাফ মাহমুদ কন্যা শাওন মাহমুদ কলকাতায় গিয়েছিলেন মাকে নিয়ে। কলকাতার রাস্তায় চলার সময় পরনে ছিল তার গেরুয়া রঙের প্রিয় জ্যাকেট, তাতে স্ক্রিন প্রিন্ট করা ছিল  হিন্দু ব্রাহ্মণদের বীজমন্ত্র (গায়ত্রী মন্ত্র) যা বেদ থেকে আহুত।
ওঁ ভূর্ভুবঃ স্বঃ তৎ সবিতুর্বরেণ্যং ভর্গো দেবস্য ধীমহি ধিয়ো য়ো নঃ প্রচোদয়াৎ।

রবীন্দ্রনাথের অনুবাদ- যা হতে বাহিরে ছড়ায়ে পড়িছে পৃথিবী আকাশ তারা/ যা হতে আমার অন্তরে আসে বুদ্ধি চেতনা ধারা।

শাওন মাহমুদের বন্ধু অমিত তার এই জ্যাকেট পরা একটি ছবি তুলে ফেসবুকে দিয়েছিলেন। সাথে তিনি লিখেছিলেন, শাওনের গায়ে এই জ্যাকেট বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সেরা বিজ্ঞাপন হতে পারে। সাথে অবশ্য তিনি এমন আশঙ্কার কথাও লিখেছিলেন যে, এই কারণে মৌলবাদীরা হয়তো শাওনকে গাল দেবে।

ঘটনা এখানেই শেষ হতে পারতো। হয় নাই। অমিতের আশাবাদ নয়, আশঙ্কাটুকুই সত্য প্রমাণিত হলো। শাওনের এই জ্যাকেট পরা ছবি পোস্ট করে, অশ্লীল কদর্য ভাষায় এই শহীদ সন্তানকে দলবলসহ আক্রমণ করে মৌলবাদীরা যে কাণ্ড ঘটালো, আর যাই হোক, তাকে গালি বললে, গালাগালি শব্দটাকেও অপমান করা হয়!
 
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এরকম কিছু মৌলবাদী চক্র সবসময়ই সক্রিয় থাকে। তারা তক্কে তক্কে থাকে কখন কীভাবে মুসলমানের ধর্মীয় অনুভূতি নাড়িয়ে দিয়ে দূরে বসে মজা লোটা যায়। আর বাঙালি মুসলমানের ধর্মীয় অনুভূতিখানা একেবারেই ননী দিয়ে গড়া, ধরলেন কি ছুঁয়ে দিলেন, আঘাত লেগে একেবারে হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে!

SHAWNতো শাওন আপার জ্যাকেট এবার তাদের লক্ষ্যবস্তু। জ্যাকেটটা ভারি সুন্দর। গেরুয়া রঙ। এই দেশেরই একটি বুটিক হাউসের তৈরি করা। এমন জ্যাকেট পেলে আমিও একখানা নিশ্চয়ই কিনতাম আর পরতাম। পৃথিবী জুড়ে শিল্প আর সৌন্দর্য্যের যে অসীম ভাণ্ডার আছে, তার তো কোনো ধর্ম নেই, গোত্র, বর্ণ, সংখ্যা গুরু লঘু তত্ত্ব নেই। তাই পূজার আয়োজনে দেবীমূর্তির সৌন্দর্য্য মুসলমানকেও টানে, বুদ্ধের মূর্তি শোভা পায় আমাদের ড্রইংরুমে। সৌন্দর্য্যপিপাসুর চোখ যেমন টানে শিল্পকে, তেমনি সব ধর্মের মূল সুর- মানবতাবাদ, একজন মানবতাবাদীকে আকৃষ্ট করতে বাধ্য। ধর্ম যদি হয় মঙ্গল, কল্যাণ, শান্তি ও সৌন্দর্যের বিধান, তবে সকল ধর্মেই সেই একই বিধান বাতলে দেয়া হয়েছে। আনুষ্ঠানিকতা, রীতিনীতি আর পালনের পার্থক্য ছাড়া প্রতিটি ধর্মই দাবি করে, তারা মানবতার কথা বলছে।

আমি খুব বিস্ময় নিয়ে দেখলাম, শাওন মাহমুদকে নিয়ে দেয়া সেই পোস্টটিতে কিছু মানুষ পঙ্গপালের মত ধেয়ে এসে অশ্লীল মন্তব্য করে তাদের বিকৃত মনের ক্ষুধা মেটালো। তাদের আপত্তির জায়গাটা কোথায়? শাওন হিন্দুর গায়ত্রী মন্ত্র অঙ্গে জড়িয়েছেন। শাওন হিন্দুয়ানি করেছেন। তাদের পোস্টের ভাষা প্রকাশ্যে এবং খোলাখুলিভাবে হিন্দুধর্ম এবং ব্রাক্ষণদের আক্রমণ করে করা। তারপর অবধারিতভাবে যা হয় আর কি, ঘটনা যেহেতু নারীর, তাই নোংরা কিছু মন্তব্য তো আসতেই হবে। তারপর দেখলাম, শাওন মাহমুদের বাবা শহীদ আলতাফ মাহমুদের নামও উচ্চারিত হলো, চলে আসলো শহীদ শহীদুল্লাহ কায়সারের মেয়ে শমী কায়সারের নামও।

কোন যুক্তিতে কোন বিবেচনায় কোন অনুভূতিতে কোন আবেগে পাগলপ্রায় হয়ে এইসব পোস্টদাতা ও কমেন্টকারীরা শাওন মাহমুদের গুষ্টি উদ্ধারে এভাবে ঝাঁপিযে পড়লেন, সেই ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করলাম। ঘটনা কি শুধুই গায়ত্রী মন্ত্রওয়ালা জ্যাকেট পরা শাওন মাহমুদ, নাকি জ্যাকেট পরা শাওনের ছবিতে একজন ভারতীয় হিন্দু বন্ধুর করা সুন্দর মন্তব্য? কোনটা? শাওনের ছবিটিকে তিনি বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির একটা সুন্দর চিত্র বলে মন্তব্য করেছিলেন। আমাদের ধর্মপ্রাণ ভাইদের আঘাতটা ঠিক কোনখানে লাগলো, আমি বোঝার চেষ্টা করছি।

বিকেল থেকে এইসব দেখে শুনে ক্ষোভ আর হতাশাভরা মন নিয়ে বাড়ি ফিরছি যখন, নজর গেল একটি খবরে। নর্থ সাউথের ২ শিক্ষার্থীসহ একদিনে চার তরুণ নিখোঁজ! এর আগে জঙ্গি ছেলেগুলো নিখোঁজ হবার আগে যেসব লক্ষণ দেখা যেত, তার প্রায় সবই মিলে যাচ্ছে বলে পুলিশের ধারণা, ২২ থেকে ২৫ বছর বয়সী এই তরুণরা সকলেই জঙ্গি কোনো সংগঠনের যোগ দিতে গিয়েছে। এরা সকলেই ধর্ম নিয়ে খুব বেশি মাত্রায় আগ্রহী ছিল, চারজনই ধনী ঘরের সন্তান এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধু।

জানি না কেন, কী এক বিষাদ আর আশঙ্কা ভর করছে মনের মধ্যে। সামনে আবারো হয়তো ঘোর অমানিশা, হয়তো আবারো দেখতে হবে তাই, যা দুঃস্বপ্নেও ভাবি নাই। হয়তো আবারো নিঃস্ফল চিৎকার আর আর্তনাদ করে দ্বারে দ্বারে ফিরতে হবে আমাদের। অথচ আমরা আশায় বাঁচতে চেয়েছিলাম। স্বপ্ন দেখবো বলে নিশ্চিতে ঘুমোতে চেয়েছিলাম। একটা আলোময় রোদ্দুরভরা দিন পেতে চেয়েছিলাম। জানি না। হয়তো আবারো ছায়া ঘনাচ্ছে ধীরে, হয়তো আবারো অন্ধকারে ওঁৎ পেতে থাকা ওরা ঘিরে ফেলতে চাইছে আমাদের। মন খারাপ করা এইসব দিন কখনও কেন শেষ হয় না আমাদের জীবনে?

কেন শাওন আপার বিষন্ন মুখের মত মেঘ জমে বার বার আমাদের আকাশে? কেন আমরা ধর্মের নামে ঘৃণার চর্চা করি? কেন আমরা অনুভূতির নামে বিভ্রান্তি আর বিদ্বেষ ছড়াই? কেন আমরা চিনতে পারি না দেশের আসল শত্রুদের? কেন আমরা নিরুপায় দর্শক হয়ে চেয়ে চেয়ে দেখি? কেন আমরা রুখে ওঠার ভয়ে কোঁচো হয়ে থাকি? কেন আমরা এইভাবে প্রতিবাদহীন বেঁচে থাকার চেয়ে একবারে মরে যাই না?

লেখক : প্রামাণ্য চলচ্চিত্র নির্মাতা ।

এইচআর/পিআর

আরও পড়ুন