টেলিভিশন বাঁচানোর লড়াই : ঘরেই যখন শত্রুর বাস
গত ২১ নভেম্বর ছিল বিশ্ব টেলিভিশন দিবস। আর আসছে ২৫ ডিসেম্বর বাংলাদেশ টেলিভিশনের প্রতিষ্ঠা দিবস। ১৯৬৪ সালে শুরু হওয়া সে সময়ের ঢাকা টেলিভিশন ছিল এ অঞ্চলের প্রথম এবং বাংলা ভাষায় বিশ্বের প্রথম টেলিভিশন। এরপর সময় গড়িয়েছে, আজ বাংলাদেশে টেলিভিশন একটি বিকশিত খাত। সরকারি ও প্রাইভেট সেক্টর মিলিয়ে পরিচালিত হচ্ছে ৩০টির তো চ্যানেল।
পাঁচ দশকেরও বেশি সময় ধরে বিকশিত হওয়া একটি মাধ্যম টেলিভিশন। আজ এতো বছর পর এসে এখন এই শিল্পকে বাঁচাতে উদ্যোক্তা, শিল্পী ও কলাকুশলী, সাংবাদিক ও গণমাধ্যম কর্মীরা একত্রিত হয়েছেন, লড়াইয়ে নেমেছেন। সবাই একবাক্যে বলছেন ধীরে ধীরে মৃত্যুপথে ধাবিত এদেশের সবার ভালোবাসার ধন টেলিভিশন।
অনেকদিন ধরেই একটা অবৈধ কাজ চলছে। দেশে সরকার আছে, এই খাতকে দেখার মন্ত্রণালয় আছে, বিভিন্ন সংস্থা আছে, অবৈধ অর্থ পাচার রোধে বাংলাদেশ ব্যাংক আছে, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড আছে। অথচ সকলের সামনে বছর বছর একটি গোষ্ঠি একের পর এক অপকর্ম করে যাচ্ছে, কেউ কিছু বলছে না। ধুঁকে ধুঁকে মরে যাচ্ছে এই খাত।
এর মধ্যে টেলিভিশনের উদ্যোক্তা, শিল্পী ও কলাকুশলী, সাংবাদিক ও গণমাধ্যম কর্মীরা গঠন করেছে মিডিয়া ইউনিটি। আর ফেডারেশন অব টেলিভিশন প্রফেশনাল’স অরগানাইজেশন্স (এফটিপিও) গত মঙ্গলবার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে দিনভর সমাবেশ করেছে। যেসব দাবি উঠেছে, তার একটি হলো দেশের বেসরকারি চ্যানেলে বাংলায় ডাবকৃত বিদেশি সিরিয়াল ও অনুষ্ঠান বন্ধ করতে হবে। প্রশ্ন উঠতে পারে, এক সময়তো বাংলাদেশ টেলিভিশনও ইংরেজি সিরিয়াল চালাতো, তাহলে এখন সমস্যা কোথায়? হ্যা চলেছে, তবে সেগুলো ‘ডাব’ করা ছিল না, ইংরেজি ভাষাতেই প্রদর্শিত হতো। আর সেসব সিরিয়ালের বেশিরভাগই ছিল শিক্ষণীয়, পরিবারের সবাই মিলে বসে দেখতে পারতো।
কিন্তু একটি নতুন চ্যানেল হঠাৎ করে অত্যন্ত অশ্লীল কাহিনীর একটি বিদেশি সিরিয়াল বাংলায় ‘ডাব’ করে প্রচার করতে থাকে। হারেমের অশ্লীল গল্প এখন ঘরে ঘরে। শিক্ষণীয় কিছু নেই। আছে অবাধ যৌনতা আর পারিবারিক কূটচালের রমরমা গল্প। ফলে দ্রুতই এটি জনপ্রিয়তা পায় এবং এর পথ ধরে অন্যরাও তা শুরু করে। বাংলাদেশের নাট্যকার বা পরিচালকের নাটক কমতে থাকে। হুমকির মুখে পড়েছে আমাদের দেশের টিভি অনুষ্ঠান নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত লক্ষাধিক কর্মী। প্রায় ৭০ শতাংশ প্রডাকশন হাউজ এখন বন্ধের পথে।
দেশের সংস্কৃতি বিকাশের দায়িত্ব টেলিভিশনের। তারা যদি বাইরের অশ্লীলতা দেখাতে থাকে, তাহলে সরকারের কিছু করণীয় নেই? এই প্রশ্ন আজ এ খাতের সাথে সংশ্লিষ্ট সকলের। আরেকটি দাবি উচ্চারিত হয়েছে যে, টেলিভিশন অনুষ্ঠান নির্মাণ, ক্রয় ও প্রচারের ক্ষেত্রে ক্লায়েন্ট ও এজেন্সির হস্তক্ষেপ ব্যতীত চ্যানেলের অনুষ্ঠান সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে হবে। এটি এমন এক দাবি যেখানে সরকারের করণীয় খুব একটা নেই। টেলিভিশন কর্তৃপক্ষই এখানে উদ্যোগী ভূমিকা নিতে পারেন এজেন্সিগুলোর নগ্ন হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে।
চ্যানেলগুলোতে যে অনুষ্ঠান বিভাগ থাকে, সেগুলোর কর্তৃত্ব খর্ব করে স্থানটি দখল করেছে মার্কেটিং বিভাগ। এজেন্সিগুলো নিজেরাই এখন অনুষ্ঠান তৈরি করে থাকে বা বিদেশ থেকে এনে সেগুলো টিভি চ্যানেলে কর্মরত বিপণন কর্মকর্তাদের মাধ্যমে চ্যানেলে বিক্রি করে। বিজ্ঞাপন প্রচার বাবদ চ্যানেলের পাওনা টাকার প্রায় অর্ধেক বা তারও বেশি তাদের সরবরাহকৃত অনুষ্ঠানের মূল্যবাবদ সমন্বয় করে থাকে। এ ধরনের ব্যবসার ফলে টিভি চ্যানেলগুলো আজ দিশেহারা। এর সমাধান জরুরি।
দেশের টেলিভিশন শিল্পে বিপুল সংখ্যক বিদেশি শিল্পী ও কলাকুশলী অবৈধভাবে কাজ করছে। এরা ট্যুরিস্ট ভিসায় এসে অর্থ কামিয়ে, কোন প্রকার কর না দিয়ে বিপুল পরিমাণ টাকা নিয়ে চলে যাচ্ছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কর্তৃপক্ষ বিষয়টির দিকে গভীর নজর দিবে বলে আশা সবার।
এসবের বাইরে যে বিষয়টি এই শিল্পকে একেবারে ধ্বংস করে দিচ্ছে সেটি হলো ডাউনলিংক চ্যানেলের মাধ্যমে বিদেশি চ্যানেলে দেশীয় বিজ্ঞাপন প্রচার। বিজ্ঞাপনের নামে বাংলাদেশ থেকে এর মধ্যেই সাড়ে চারশ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। আর দুঃখজনকভাবে এর সাথে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে ওঠে এসেছে একটি মিশ্র চ্যানেলের মালিকের নাম। বাণিজ্য ও তথ্যমন্ত্রীর উপস্থিতিতে বৃহস্পতিবার মিডিয়া ইউনিটির সংহতি সমাবশে এই চ্যানেলের মালিকের বিজ্ঞাপনের নামে অর্থ পাচারের সাথে জড়িত থাকার প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়।
এমন ঘটনা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না বলে মন্তব্য করেছেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ। আর তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেছেন, প্রয়োজনে নতুন আইন করে এবিষয়ে প্রশাসনিক পদক্ষেপ নেয়া হবে। মন্ত্রীরা যা বলেন তা করে দেখাবেন বলেই আশা করছে সবাই।
বাংলাদেশে যখন ভারতীয় টিভি সিরিয়ালের ফাঁকে বাংলাদেশের পণ্যের নানান বিজ্ঞাপন দেখানো হয়, তখন ভারতীয় অংশে সেই বিজ্ঞাপন চালানো হয় না। বরং সেখানে তার পরিবর্তনে দেখানো হয় ভারতীয় বিজ্ঞাপন। বিদেশি বাজারে বাংলাদেশের পণ্যের প্রসারের নামে বিজ্ঞাপন দেয়া হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু তা আসলে সেখানকার দর্শক দেখতে পারছে না। পুরোটাই একটি ভয়ংকর প্রতারণা এবং একই সাথে মানি লন্ডারিং অপরাধ।
বাংলাদেশে কোনো ভারতীয় চ্যানেল দেখাতে ডাউনলিংক ফি নেয়া হয় মাত্র দেড় লাখ টাকা। অথচ বাংলাদেশের একটি চ্যানেল সেখানে চালাতে গেলে চাওয়া হয় সাড়ে সাত কোটি ভারতীয় রুপি। এতে বাংলাদেশ শুধু দর্শকই হারাচ্ছে না, হারাচ্ছে প্রতি বছর হাজার কোটি টাকা। এই টাকা অনেকটা তাদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে টেলিভিশন অনুষ্ঠান দেখার নামে, পে-চ্যানেলের ফি বাবদ।
আমরা টাকা দিয়ে ভারতীয় চ্যানেল দেখছি, অথচ বাংলাদেশের কোনো টিভি চ্যানেল যখন ভারতে দেখানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়, তখন বলা হয় ভারতীয় ক্যাবেল অপারেটরদের মোটা অংকের টাকা দিতে হবে। যে টাকা দেওয়ার সাধ্য আমাদের চ্যানেল মালিকদের আসলে্ নেই।
একদিকে ভারতীয় চ্যানেল দেখার জন্য আমরা টাকা দিচ্ছি আমাদের ক্যাবেল অপারেটরদের মাধ্যমে, আবার আমাদের বিজ্ঞাপন পাঠিয়ে দিচ্ছি তাদের চ্যানেলে। এভাবে বাংলাদেশের বিকাশমান টেলিভিশন শিল্পকে কতদিন বাঁচানো যাবে এ প্রশ্ন আজ সরবে উচ্চারিত।
টেলিভিশন অনুষ্ঠানের মান আর অনুষ্ঠানের বিরতিতে অতিরিক্ত বিজ্ঞাপন প্রচার নিয়ে অভিযোগ অনেক। তবে যেসব সমস্যার কথা উঠেছে সেসব সমাধানের উদ্যোগ নিলে আশা করা যায় একটা সুস্থতা ফিরবে এ শিল্পে। বাংলাদেশে এখনও অনেক ভালো ভালো নাট্যকার, নির্মাতা এবং অভিনেতা-অভিনেত্রী আছেন। কিন্তু যদি ঘরের শত্রু বিভীষণ হয়, যদি এমন উদ্যোক্তা থাকেন যিনি নিজেই দেশের বিজ্ঞাপন অবৈধভাবে পাচার করে দেন, তাহলে কে রুখবে এ শিল্পের করুণ পরিণতি?
লেখক : বার্তা পরিচালক, একাত্তর টিভি।
এইচআর/এমএস