রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ : মানবিকতা ও শঙ্কা
আবারো আলোচনায় রোহিঙ্গা ইস্যু। মিয়ানমার সেনাবাহিনী দেশটির রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর নিষ্ঠুর নির্যাতন ও নিপীড়ন করছে, বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিচ্ছে, এমনকি গুলি করে হত্যার ঘটনাও ঘটছে বেশুমার। এসব ঘটনা এমন এক সময় সংঘটিত হচ্ছে, যখন মিয়ানমারে সামরিক জান্তা নয়, ক্ষমতায় আছেন শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অং সাং সুচি।
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সেনাবাহিনীর দমনপীড়নে সৃষ্টি হওয়া মানবিক বিপর্যয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে বাংলাদেশ। বুধবার ঢাকায় মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত মিউ মিন সানকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করে এ উদ্বেগ জানানো হয়। পরে সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক জানান, রাখাইন রাজ্য থেকে বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করা লোকজনের দেশে ফিরে যাওয়ার জন্য সেখানকার পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে বলা হয়েছে। তিনি এও বলেছেন, সমস্যার গভীরতা বিবেচনায় যেটুকু করার, যেমন করে করার সেভাবেই কাজ করছে বাংলাদেশ।
জীবন বাঁচাতে রোহিঙ্গারা দলে দলে বাংলাদেশে আসছে। নানা চোরাই পথে স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় ঢুকে পড়ছে লোকালয়ে। গত কয়েক দিনে হাজার হাজার রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ ও শিশু বাংলাদেশের পাহাড়, জঙ্গল ও অনিবন্ধিত ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছে।
বাংলাদেশের জন্য এক অনাকাঙ্খিত সমস্যা। বড় সমস্যা এই যে, এ ঘটনাকে পুঁজি করে জঙ্গিরা সেখানে সক্রিয় হতে পারে এবং এর ফলে আমাদের পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে পারে। ব্যাপক হারে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ ঘটলে তা সামাল দেয়ার তাৎক্ষণিক কোনো প্রস্তুতি আমাদের নেই। এর বাইরে সেখানে সক্রিয় থাকা জঙ্গি গোষ্ঠি এই রোহিঙ্গাদের নিয়ে কি ধরনের অপতৎপরতায় মেতে উঠে তাও এক শঙ্কার বিষয়।
এর আগে ১৯৭৮ ও ১৯৯২ সালে জাতিগত দাঙ্গার ঘটনায় দু’দফায় কয়েক লাখ রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু হয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছিল। আলোচনার মাধ্যমে তখন অনেককে ফেরত পাঠানো হলেও অসংখ্য রোহিঙ্গা বাংলাদেশে রয়ে গেছে। জাতিসংঘ ও বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক পরিচালিত ক্যাম্প-এ আছে মাত্র ৩০,০০০ রোহিঙ্গা। কিন্তু ক্যাম্পের বাইরে আছে প্রায় পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা। অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের কারণে দেশের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোয় আর্থসামাজিক ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি ঘটছে। ২০১২ সালে আরেকদফা দাঙ্গা হলে বেশ কিছু রোহিঙ্গা ঢুকে বাংলাদেশে।
বাংলাদেশে কী পরিমাণ মিয়ানমার নাগরিক অনিবন্ধিত আছে তার একটা শুমারি হওয়ার কথা ছিল ২০১৫ সালে। ২০১৬ সালের মার্চের মধ্যে এই শুমারি শেষ করার কথা ছিল। কিন্তু তা হয়নি। বাংলাদেশে অবস্থানরত মিয়ানমার নাগরিকদের একটা হিসাব এখন জরুরি হয়ে পড়েছে।
জঙ্গি সমস্যা নিয়ে যারা কাজ করেন, তারা বলছেন সম্প্রতি মিয়ানমারের পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপর রোহিঙ্গাদের আক্রমণের পরই সেনাবাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে মুসলিম এই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর। জঙ্গি গ্রুপ দমন করতে গিয়ে অনেক নিরীহ মুসলিম নাগরিকদের উপর নির্যাতন করছে মিয়ানমার সরকার। অথচ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় অনেকটাই নীরব ভূমিকা পালন করছে। তারা শুধু চাপ অব্যাহত রেখেছে বাংলাদেশের উপর, যেন জনবহুল এই দেশ সীমান্ত খুলে দেয়। যেন এটাই একমাত্র সমাধান। মিয়ানমার সেনারা নিপীড়ন করবে, বাংলাদেশ সীমান্ত খুলে দেবে, এটাই যেন সমস্যা সমাধানের একমাত্র ফরমুলা। যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও ফ্রান্সের সঙ্গে মিয়ানমার সরকারের হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক। মিয়ানমারের সঙ্গে সীমান্ত রয়েছে বাংলাদেশ, ভারত, চীন, লাওস ও থাইল্যান্ডের। কিন্তু জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপ কেবল বাংলাদেশের উপর।
বাংলাদেশে যারা জঙ্গি ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করে, তাদের সাথে এক গভীর সম্পর্ক রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র গ্রুপের। সবসময়ই দেখা গেছে রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশে একটি মহল সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগানোর চেষ্টা করে। ফেসবুকে, অনলাইনে ফটোশপ করে, ভুয়া ছবি ছড়িয়ে মুসলিম সম্প্রদায়ের ভেতর হিংসার মনোভাব জাগিয়ে দেয়ার অপচেষ্টা দৃশ্যমান। কয়েক বছর আগে রামুর বৌদ্ধ বিহারে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় বাংলাদেশে থাকা অনিবন্ধিত রোহিঙ্গাদের জড়িত থাকার কথা বিভিন্ন মহলে উচ্চারিত হয়েছিল।
তাই গুলশানের হলি আর্টিজান হামলার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জঙ্গি দমনে যে সাফল্য দেখিয়ে আসছে, তার জন্য এক নতুন চ্যালেঞ্জ এই রোহিঙ্গা ইস্যু। আর এ কারণেই শুধু মানবিকতা দেখিয়ে বাংলাদেশের পক্ষে নতুন করে সীমান্ত খুলে দিয়ে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ করানোর কোনো সুযোগ নেই। বাংলাদেশ সবসময় রোহিঙ্গাদের মানবিক সহযোগিতা করেছে। ২০১২ সালে মিয়ানমারে জাতিগত দাঙ্গার সময়েও বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তা দিয়েছে।
অনেক রোহিঙ্গা বাংলাদেশি পাসপোর্ট ব্যবহার করে বিদেশ গিয়ে নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছে এবং এর দায় নিতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মিয়ানমার সফরের সময় সমস্যাটি যথেষ্ট গুরুত্ব পেলেও এ ব্যাপারে খুব একটা অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয়নি। গত তিন দশকে জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক কমিশনও রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের কোনো উদ্যোগ নেয়নি। জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্রসহ উন্নত দেশগুলো মিয়ানমারকে চাপ দিলে এ সমস্যার গ্রহণযোগ্য একটি সমাধানে পৌঁছানো অবশ্যই সম্ভব।
আরাকান তথা রাখাইন অঞ্চলে বসবাসকারী রোহিঙ্গা মুসলমানরা ঐতিহাসিকভাবেই বার্মিজ। এ সত্য মেনে নিয়ে মিয়ানমার সরকারের উচিত, রোহিঙ্গা হত্যা, নির্যাতন ও বিতাড়ন বন্ধ করে তাদের নাগরিক অধিকার ও মর্যাদা সুপ্রতিষ্ঠিত রাখার বিষয়ে যত্নবান হওয়া।
পররাষ্ট্র সচিব যেমনটা বলেছেন, বাংলাদেশের শান্তিকামী মানুষও সেটাই চায়। বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গা ইস্যুর সমাধান চায়। চায় বাংলাদেশে থাকা লাখ লাখ রোহিঙ্গা মিয়ানমারে ফিরে যাক, মিয়ানমার সরকার তাদের সাথে মানবিক আচরণ করুক।
লেখক : বার্তা পরিচালক, একাত্তর টিভি।
এইচআর/এমএস