অভিনন্দন তাকে, নিজের বাল্যবিয়ে ঠেকালো যে কল্পনা
মিডিয়া কিছু মেয়েকে সাহসী বলে প্রচার দেয়। পর্দায় ঝড় তুললেন ‘সাহসী’ অমুক, ‘সাহসী’ পোজ দিলেন তমুক। মিডিয়া পরিভাষার এ ‘সাহস’ বড্ড রুচিহীন, কদর্য, রীতিমতো, অশ্লীল। কারণ এই ‘সাহসীরা’ বরাবরই স্বল্পবসনা, খোলামেলা, উপনগ্নিকা। প্রায় উদোম হওয়া এই মেয়েদের ‘সাহসী’ বলা এক অর্থে মিডিয়ার নারী বিরোধিতাই।
নারীবিরোধী বাণিজ্যিক মিডিয়া কখনোই সত্যিকার সাহসী, মেধাবী, প্রতিভাবান মেয়েদের পৃষ্ঠপোষকতা করে না, করে মেধাহীন, শরীরসর্বস্বদের। যে মেয়েদের বাজারে এনে বিকোতে পারবে, বাণিজ্যিক স্বার্থ আছে, লাভ আছে- কদর তাদেরই। হাজারো মেধাবী হলেও লাভ নেই যদি লিকলিকে, দাঁত উঁচু, স্তনহীন হয় সেই মেয়ে, তার প্রচার দেবে না মিডিয়া। মিডিয়ার কাছে তাই ‘সাহস’ হলো- গাখোলা, কাপড়খোলা, উদোম হওয়া। সত্যিকারের সাহসী মেয়েরা আড়ালেই থেকে যায়, প্রচার পায় না পাওয়া উচিত যতটা।
কল্পনা শীল, টাঙ্গাইলের মেয়ে। শ্রীভাস চন্দ্রশীলের কন্যা। সত্যিকারের সাহসী মেয়ে, সে নিজের বাল্যবিবাহ ঠেকিয়েছে নিজেই। কল্পনা খবরের কাগজে সংবাদ হয়েছে বড়জোর দু’কলাম। তাও কোথাও কোথাও, সর্বত্র নয়। অথচ ‘ঝড় তুলবেন সাহসী অমুক’ জাতীয়রা সংবাদ হন ছ’কলাম, সাত কলাম। রঙিন ছবি থাকে প্রায়শই তাদের। ক’দিন পরপরই সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। অথচ কল্পনারা অনেক ‘সাহসীদের’ চেয়েও সাহসী। যারা সমাজ বদলে দেয়, চ্যালেঞ্জ নিতে জানে।
কল্পনার বাবা-মা বিয়ে ঠিক করে। বিয়ের দিন-তারিখ ঠিক। বিয়েতে কল্পনার অসম্মতি, কিন্তু পরিবার তা শুনতে নারাজ। অবশেষে আরও দু’বান্ধবীকে নিয়ে কল্পনা যায় উপজেলা সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে। জানায় ঘটনা, তার অসম্মতির কথা, পরিবারের সিদ্ধান্তের কথা। সাহায্য প্রার্থনা করে। সব ঘটনা শুনে, ডেকে পাঠান উপজেলা সহকারী কমিশনার, কল্পনার বাবা-মাকে। জরিমানা করেন আইন অমান্য করে মেয়েকে বাল্যবিয়ে দিতে উদ্যোগী হওয়ায়। বাধ্য হয়ে মেয়ের অমতে বিয়ে থেকে ফিরে আসেন কল্পনার পরিবার।
কল্পনার শহুরে নয়, মফস্বলের মেয়ে। কিন্তু আধুনিকতায়, বিজ্ঞানমনস্কতায়, অগ্রসর চিন্তায় অনেক শহুরে মেয়ের চেয়েও আধুনিক। অনেক তথাকথিত নারীবাদীদের চেয়েও প্রগতিশীল। একটি অনগ্রসর মফস্বল এলাকায় থেকেও কল্পনা বুঝতে শিখেছে বাল্যবিবাহ কতটা ভয়াবহ। সে জানে পরিবারের অমতে বিয়েটা ভেঙে দেয়াতে লোকে তাকে ভালোভাবে নেবে না। ঢি ঢি করবে সমাজ। সমাজে তাকে ‘অবাধ্য, ‘বেপরোয়া’ বলবে সবাই। যেকোনো গ্রামীণ সমাজে যেকোনো বয়সের মেয়ের বিয়ে ভাঙার অপবাদ কতটা ভয়ঙ্কর তা জানে কল্পনা। তবু সে বিয়েটা ভেঙে দিয়েছে। এই সৎ সাহস সবার থাকে না। কল্পনা সাহসী, প্রতিবাদী। সে প্রতিবাদ করেছে পরিবারের বিরুদ্ধে, সমাজের রক্তচক্ষুর বিরুদ্ধে। দাঁড়িয়েছে পুরুষতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে। যে পুরুষতান্ত্রিকতা কিশোরীকে ঘরবন্দি করে, হেঁশেল ঠেলায়, গার্হস্থ্য বাঁদীগিরি করায়, যৌনদাসী বানায়। কিশোরী মেয়েরা জগৎ বোঝার আগেই অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ করে। স্বামীকর্তৃক শিকার হয়, বৈবাহিক ধর্ষণের। স্বামী, সন্তান, সংসার, হাজারো চাপে পিষ্ট হতে থাকে সে। থেকে থেকে, সয়ে সয়ে, ক্ষয়ে ক্ষয়ে অকাল বার্ধক্য আসে ধেয়ে। একটা করে দিন যায়, বাড়ে শত দিনের বয়স। আমাদের অনেক মেয়েরা এভাবেই অপরিণত বয়সে মা হয় অনিচ্ছায়, নিজের জীবনকে শেষ করে দিয়ে।
কল্পনা শেষ হতে চায়নি। সবে তো জীবনের শুরু কল্পনার। সে আরও লেখাপড়া করতে চায়, নিজের পায়ে দাঁড়াতে চায়। চায় নিজের মতো করে নিজের একটি পরিচয়। যে পরিচয়ে সবাই তাকে চিনবে, জানবে, সম্মান করবে। শিক্ষকের কাছে অমন প্রত্যাশাই ব্যক্ত করেছে সে। অথচ এতো প্রত্যয়ী যে কিশোরী, অমন সাহসিনী যে, বাণিজ্যিক মিডিয়া তাদের প্রচার দেয় না। কারণ এই সাহসী মেয়েদের গল্প পুরুষ পাঠকদের আগ্রহ তৈরি করে না, উৎসুক করে তোলে না, কাটতি বাড়ে না, যতটা বাড়ে উদোম হওয়া মেয়েদের খবরে।
মনে আছে ফারজানার কথা? ফারজান ইয়াসমিন। বরগুনার মেয়ে। ছাত্রী ছিলেন ইডেনের। বাবা বিআরডিবিতে চাকরি করতেন, সাধারণ চাকরি। চার বোন, এক ভাই। বিয়ে ঠিক হয়েছিল ফারজানার, তবে তা যৌতুকের বিনিময়ে। ফারজানার পরিবার তা মেনেও নিয়েছিল। কিন্তু তা মানেনি ফারজানা। বিয়ের দিন, বিয়ের অনুষ্ঠান থেকেই ফারজানা উঠে যায়। প্রতিবাদ করে- এই অন্যায়ের, অসমতার, যৌতুকের।
ঘটনা ২০১১, নভেম্বরের। অনেকে ভুলে গেলেও আজও ভুলিনি আমি। এমন দুর্দান্ত, প্রতিবাদী, সাহসী মেয়ে ক’জন আছে, ক’জন হয়, যে যৌতুকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে নিজের বিয়ে ভেঙে দিতে পারে। মনে আছে তখনও ফারজানাকে নিয়ে লিখেছিলাম। তার সাহসিকতার প্রশংসা করেছিলাম তুমুল। মুহম্মদ জাফর ইকবাল যৌতুকের বিরুদ্ধে ফারজানার এই প্রতিবাদকে উৎসাহ দিয়ে, সম্মান জানিয়ে উৎসর্গ করেছিলেন একটি বই- রাতুলের দিনরাত্রি।
কিন্তু মিডিয়া কি কোনোদিন আর মনে করেছে ফারজানাকে? ফারজানার মতো আরও আরও আরও সাহসী মেয়েদের নিয়ে প্রচার করেছে কোনো প্রতিবেদন? উৎসাহ দিয়েছে যাতে আরও মেয়েরা সাহসী হয়, প্রতিবাদ করতে শেখে যৌতুকের বিরুদ্ধে, বাল্যবিয়ের বিরুদ্ধে, ধর্ষণের বিরুদ্ধে? না তা করেনি। বাণিজ্যিক মিডিয়ার চরিত্রও তা নয়। এই মেয়েরা সাহসী, প্রতিবাদী, প্রত্যয়ী। সমাজকে বদলাতে চাইলে, নিজেকে বদলাতে হয় আগে। এরা প্রত্যেকেই নিজেকে বদলেছে, সমাজের ইতিবাচক বাঁক-বদলের ঝুঁকি নিয়েছে, নিজেরা উদাহরণ হয়ে। এই মেয়েরা হয়তো মিডিয়ার ‘তথাকথিত সাহসী’ মেয়েদের মতো কাপড় খুলবে না, তবে সমাজকে তুলবে অনেক উপরে- অন্য এক উচ্চতায়।
লেখক: সম্পাদক, আজ সারাবেলা। ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, মিডিয়াওয়াচ। পরিচালক, বাংলাদেশ সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট জার্নালিজম অ্যান্ড কমিউনিকেশন। সদস্য, ফেমিনিস্ট ডটকম, যুক্তরাষ্ট্র।
এইচআর/এনএইচ/পিআর