কোয়ালিটি না কোয়ানটিটি?
গত কয়েক বছরে দেশে মেধার বিস্ফোরণ ঘটেছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে পাসের হার কখনো কখনো ৯০ শতাংশ ছুঁয়ে যায়। জিপিএ-৫ পাওয়া হাজার হাজার মেধাবীর উজ্জ্বল মুখ দেখে আমরা আশার বেলুন ফুলাই। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে গেলেই সেই আশার বেলুন ফুটো হয়ে যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় পাসের হার নেমে আসে ১০ শতাংশের নিচে। এই শুভঙ্করের ফাঁকিটাই ধরতে পারি না আমি। এটা ঠিক, পাসের হার বাড়িয়ে দেখানোর জন্য পিইসি, জেএসসি, এসএসসি, এইচএসসি পর্যায়ে পরীক্ষার খাতা মূল্যায়ন করা হয় সহজ করে। আর বিশ্ববিদ্যালয়ে যেহেতু আসন সংখ্যা সীমিত, তাই তাদের ভর্তি পরীক্ষায় বাছাই প্রক্রিয়াটা হয় অনেক কঠিন। কিন্তু তাই বলে ৯০ শতাংশ আর ১০ শতাংশ! এখানেই মেলে না হিসাবটা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় পাসের হার ১০ শতাংশের কম হওয়ায় প্রশ্ন উঠেছে শিক্ষার মান নিয়ে। তাতেই আঁতে ঘা লেগেছিল শিক্ষামন্ত্রীর। তিনি পাল্টা প্রশ্ন তোলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি প্রক্রিয়া নিয়েই। তিনি অভিযোগ করেন, নীলক্ষেত থেকে বই কিনে নাকি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন করা হয়। যদিও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি আসনের বিপরীতে ৪০ জন শিক্ষার্থী পরীক্ষা দেয়। শিক্ষামন্ত্রী ঠিকই বলেছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের লক্ষ্য থাকে কীভাবে ৩৯ জনকে বাদ দেয়া হবে। সাদা চোখে হয়তো এটা ঠিক মনে হবে। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় পাস করলেই ভর্তি হওয়ার সুযোগ মিলবে এমন কোনো কথা নেই। যে ১০ শতাংশ পাস করেছে, তাদের সবাইও ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায়নি। ভর্তি পরীক্ষায় পাস করা মানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি ন্যূনতম মান অর্জন করা। তাই নিছক বাদ দেয়ার জন্যই কঠিন প্রশ্ন করে পাসের হার কম রাখা হয় এটা ঠিক নয়। সত্যিই আমাদের শিক্ষার মান নিয়ে ভাবার সময় এসেছে।
এটা ঠিক বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর নুরুল ইসলাম নাহিদের নেতৃত্বে শিক্ষা ব্যবস্থায় নানামুখী সংস্কার হয়েছে। তার সবগুলোই যে ক্লিক করেছে, তা নয়। অনেক সিদ্ধান্ত হিতে বিপরীত হয়েছে। তবে সরকার নিশ্চয়ই ভালো চেয়েই সংস্কার করেছে। শিক্ষাবিদরা অনেকদিন ধরেই প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী ও জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা, অন্তত পিইসি পরীক্ষা তুলে দেয়ার দাবি করে আসছেন। পিইসি পরীক্ষা তুলে দেয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত একবার হয়েও ছিল। কিন্তু এখনও বহাল আছে পরীক্ষার নামে শিশুদের ওপর এই অত্যাচার।
সৃজনশীল পদ্ধতিতে প্রশ্নপত্র প্রণয়নের সিদ্ধান্ত অবশ্যই ইতিবাচক। কিন্তু শিক্ষকদের সৃজনশীল প্রশ্ন প্রণয়নে যোগ্য না করেই এই সিদ্ধান্ত বুমেরাং হয়েছে। শিক্ষার্থীরা আবারও গাইড বই নির্ভর হয়ে গেছে। গাইড বই থেকেই সৃজনশীল প্রশ্ন হচ্ছে। কদিন আগে শেষ হওয়া জেএসসি পরীক্ষায়ও গাইড বই থেকে প্রশ্ন করার অভিযোগ এসেছে।
গত কয়েক বছর প্রশ্নপত্র ফাঁসের ভয়ঙ্কর প্রবণতা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকেই ধ্বংস করে দিচ্ছিল। শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে ধন্যবাদ, কদিন আগে শেষ হওয়া জেএসসি এবং এখন চলমান পিইসি পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের কোনো অভিযোগ আসেনি। শিক্ষার সংখ্যাগত মান উন্নত হয়েছে, এখন সময় এসেছে গুণগত মান উন্নয়নের কথা ভাবার।
চলমান পিইসি পরীক্ষায় ইংরেজি বিষয়ে একটি প্রশ্ন ছিল, সৈকত মুসলমান, হিন্দু, খ্রিস্টান না বৌদ্ধ? কী ভয়ঙ্কর প্রশ্ন। ক্লাশ ফাইভের একজন শিক্ষার্থীর মনে আমরা যদি এভাবে কৌশলে সাম্প্রদায়িকতার বীজ ঢুকিয়ে দেই, তাহলে ভবিষ্যতে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইটা আরো অনেক কঠিন হবে। একজন মানুষের নাম তার পরিচয়ের সূত্র মাত্র। নাম দিয়ে কখনো মানুষের ধর্ম নির্ণয় করা যায় না, করা উচিত নয়। সৈকত একটি বাংলা শব্দ। এই নামের মানুষ যে কোনো ধর্মের হতে পারে। মুসলমানদের নাম আরবি শব্দ দিয়েই রাখতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। বলুন তো, চর্যা, রঙ্গন, আনিশা, প্রসূন, আবেশ, আদর, প্রয়াস, কাব্য, পদ্য, অনসূয়া, অথই, মুগ্ধ, দিব্য, দিপ্র, নীল, কুহু, স্বচ্ছ, সুবোধ, বৃষ্টি, বর্ষা, একা- এই নামের শিশুগুলো কোন ধর্মের? এই শিশুদের সবাইকেই আমি চিনি। সবাই জন্মসূত্রে মুসলমান। নামে কি বা যায় আসে?
২৪ নভেম্বর, ২০১৬
এইচআর/পিআর