রাষ্ট্রদূতের ব্যাগ চুরি ও নজরদারি
সকালে উঠেই যখন অনলাইন পত্রিকায় দেখি নেদারল্যান্ডসের রাষ্ট্রদূতের হাতব্যাগ চুরি হয়, তাও আবার আমাদেরই চিরচেনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে তখন লজ্জায় আর ক্ষোভে মনটা বিষিয়ে ওঠে। লজ্জায় পড়েছি কারণ তিনি চারুকলায় একটি অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে গিয়ে এ বিপদে পড়েছেন। কাউকে ডেকে এনে আমরা ঠিকমতো তার দেখভাল করতে পারিনি, এটা অবশ্যই লজ্জার। এখানে আয়োজকদের ত্রুটির কথা মানতে হবে অবশ্যই।
একটি অনুষ্ঠান আয়োজন করতে গেলে অবশ্যই অতিথি ও আগত দর্শকদের জানমালের নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রাখা উচিত। তাও ভালো যে অল্প বিপদের মধ্য দিয়েই অনুষ্ঠান শেষ করতে পেরেছেন আয়োজকেরা। আমরা হয়তো জুলাইয়ে ঢাকার হলি আর্টিজেনে ঘটে যাওয়া ঘটনাটি ভুলে গেছি। আর এ কারণেই হয়তো আয়োজকদের মাথায় নিরাপত্তার বিষয়টি প্রাধান্য পায়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এমন একটি জায়গায় অবস্থিত যেখানে আশপাশে অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাও আছে। বারডেম হাসপাতাল যেটির দূরত্ব বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে সর্বোচ্চ দুই মিনিটের। যেখানে পুরো দেশ থেকে মানুষজন আসে স্বাস্থ্যসেবা নিতে। অন্যদিকে জাতীয় জাদুঘর আর শিশুপার্ক তো বিনোদনের অন্যতম স্থান। শুধু তাই নয়, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, টিএসসি- এ জায়গাগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের চেয়ে বহিরাগতদেরই চোখে পড়বে বেশি। আর তার ওপর শহীদ মিনার আর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সাধারণ জনগণের আনাগোনা সবচেয়ে বেশি।
মানুষজনের স্বাস্থ্যসেবা থেকে শুরু করে বিনোদনের অন্যতম স্থান ঐতিহাসিক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা হওয়ায় সেখানে সবসময় ভিড় লেগেই থাকে। প্রেম, রাজনীতি, সংস্কৃতি- সবকিছু চর্চারই একমাত্র আদি জায়গা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ। এখন আমার প্রশ্ন হলো- এমন একটি এলাকায় কি যথেষ্ট নিরাপত্তার ব্যবস্থা রয়েছে? নিরাপত্তা ব্যবস্থা যদি পর্যাপ্ত হতো তবে ২০১৫ সালে পহেলা বৈশাখের বিকেলে নারীরা লাঞ্ছনার শিকার হতো না। আর পরবর্তী সময়ে সিসিটিভি ফুটেজেও দেখা গেছে, অভিযুক্তদের বেশিরভাগই বহিরাগত।
খুবই হাস্যকর লাগলো শুনতে যখন রাষ্ট্রদূতের ব্যাগ চুরির ঘটনায় অনেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দোষারোপ করছেন। এ দোষারোপ কি বুঝে করা হচ্ছে নাকি না বুঝে- তা নিয়ে আমি সন্দিহান। প্রসঙ্গক্রমে বলতে হচ্ছে, যারা এ ধরনের কথা বলছেন তারাও হয়তো নিজের বিশ্ববিদ্যালয় রেখে, বেশিরভাগ সময়েই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে আড্ডা দিতে আসেন। যাকগে সে কথা। আগেই বলেছি, এ ধরনের ঘটনার জন্য কর্তৃপক্ষকেই দায়ী করা হবে এখানে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনে পাঁচটি বছর কাটিয়েছি। তখনও দেখেছি, শ্রেণিকক্ষ থেকে শুরু করে শিক্ষকদের কমনরুম প্রায় প্রতিটি জায়গা উন্মুক্ত অর্থাৎ সেখানে নেই কোনো ধরনের নিরাপত্তা বেষ্টনী বা নজরদারি। শিক্ষকদের কমনরুমে হয়তো কোনো শিক্ষার্থী প্রবেশ করতো না, তবে চাইলে যে কেউই যখন-তখন সেখানে ঢুকে পড়তে পারে। শুধু কলাভবন নয় এনএক্স বিল্ডিং, কার্জন হল, আইবিএ বিল্ডিং কিংবা ব্যবসায়িক অনুষদ সবই অনেকটা অরক্ষিত। শুধু মেয়েদের হলে প্রবেশে আইডি চেক করা হয়। মজার ব্যাপার হলো, এই আইডি কার্ড আবার অসাধারণ কিছু ছিল না। সাধারণ একটা কাগজে নিজের ছবি, নাম-ঠিকানা, জন্মতারিখ, হল আর ডিপার্টমেন্টের নাম লেখা যা আবার লেমেনেটিং করা। চাইলে যে কেউই এই আইডি কার্ড খুব সহজেই তৈরি করে নিতে পারে নীলক্ষেত থেকে। নীলক্ষেতে কিন্তু নামি-দামি বিশ্ববিদ্যালয়েরও সার্টিফিকেটের কপিও খুঁজলে পাওয়া যায় সহজেই। নজরদারি বাড়ানো গেলে হয়তো অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা থেকে রেহাই পাবে খোদ বিশ্ববিদ্যালয়টি।
আমি নিজে নৃবিজ্ঞানের ছাত্রী হয়েও প্রথম দুই থেকে তিন মাস আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ক্লাসরুমে ঢুকে বসে থাকতাম। অবশ্য তার কারণও ছিল। আমার কলেজ বান্ধবীরা সবাই ওই বিষয়ের ছাত্রী ছিল বলে আমিও নিজ আগ্রহে তাদের সঙ্গে বসে ক্লাস করতাম। কারো বোঝারই কোনো উপায় ছিল না যে, আমি সেই ক্লাসের ছাত্রী নই। আইডি চেক করে কোন ক্লাসরুমে শিক্ষার্থীদের প্রবেশ করানো কিংবা ক্লাস চলাকালীন কোন সময়েই শিক্ষার্থীদের আইডি চেক করা হয় না কিংবা প্রচলন নেই। তাই চাইলে যে কেউ যে কোনো সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসরুম থেকে শুরু করে অনুষ্ঠানে পর্যন্ত অংশ নিতে পারে। তবে হ্ঁযা দীর্ঘমেয়াদে হয়তো কেউ এ কাজগুলো করতে পারবে না। আর তাই তো, রাষ্ট্রদূত যতটুকু সময় বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাতে ছিলেন ঠিক ততটুকুই অর্থাৎ অল্প সময়ের মধ্যেই যা ঘটার তা ঘটেছে, মানে খোয়া গেছে রাষ্ট্রদূতের হাতব্যাগটি।
বিলেতে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে দেখলাম, এখানে মানুষের চোখের চেয়ে সিসি ক্যামেরার চোখ অনেক বেশি তীক্ষ্ণ। কেউ ক্লাসে না এসে বলবে উপস্থিত ছিল এমনটি হওয়ার নয়। তার ওপর ক্লাসের প্রথম প্রহরে কোনো শিক্ষার্থী এসে চলে যাবে কিংবা ক্লাস ফাঁকি দেবে- সে সুযোগ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দিতে নারাজ। ৯টার ক্লাসে সবার উপস্থিতি নেয়া হয় আঙুলের ছাপের মাধ্যমে- তাও আবার প্রথম আধাঘণ্টার মাঝে। আবার ক্লাস শেষ হওয়ার পর আবার নেয়া হয় আঙুলের ছাপ- যাকে আমরা বায়োমেট্রিক বলি। এমনকি যে আইডি কার্ড সরবরাহ করা হয়ে থাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তা দেয়ালে লাগানো মেশিনে স্পর্শ করে শিক্ষার্থীদের প্রবেশ করতে হয় মূল বিল্ডিং, ক্লাসরুম এমনকি লাইব্রেরিতেও। এসব নজরদারির কারণেই কিন্তু বহিরাগতরা কোনো ধরনের ঘটনা ঘটাবার সাহস পাচ্ছে না।
এ মুহূর্তে এতগুলো কথা বলছি কারণ চুরি কিংবা নারী লাঞ্ছনার ঘটনায় অভিযুক্তদের আমরা যতটা না ধিক্কার জানাচ্ছি- তার থেকেও বেশি কলুষিত হচ্ছে স্থান অর্থাৎ যেখানে ঘটনাটি ঘটেছে তার নাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো ঐতিহাসিক একটি স্থানের নাম কলঙ্কিত হচ্ছে শুধু নজরদারির অভাবে। এ বিশ্ববিদ্যালয় যে শক্তি ও প্রেরণা সঞ্চার করে তার ওপর ছোবল মারতে শকুনরা বাইরে থেকে সদা প্রস্তুত। তাই শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কারোরই উচিত হবে না অপশক্তিকে নিজের মাঝে বিস্তারের সুযোগ দেয়া। নিরাপত্তার বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে সবাইকে।
লেখক : টিভি নিউজ প্রেজেন্টার।
এইচআর/এনএইচ/আরআইপি