জাপানে প্রবীণদের এ কেমন জীবন?
এক অতিপ্রাকৃত আওয়াজে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল ছুটির দিন ভোরে। পাগলা ঘণ্টির মতো ছোটা এই প্রবাস জীবনে ছুটির দিনের লেপের ওমের ভেতর থেকে ঘুম ভাঙা এক অসহ্য অভিজ্ঞতা। মনে মনে বললাম , ‘কী যন্ত্রণা!’ থেমে থেমে কয়েকবার শুনতে পেলাম, আর উত্তরোত্তর পাশ বালিশে কানচাপা দিয়ে গেলাম। সকাল ১০টায় লাটসাহেবি ঘুম থেকে উঠে নাশতা বানাতে চুলার কাছে দাঁড়িয়ে অবচেতনেই চোখ গেলো পেছনের বিল্ডিংয়ে। কিছু কালো স্যুট-প্যান্ট, স্কার্ট পরা মানুষের আনাগোনা। এবারে খেয়াল করেই দেখলাম বিশেষ ধরনের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে, আপদমস্তক মুড়ে কোনো মানুষকে স্ট্রেচারে বের করে সেই গাড়িতে ঢোকাচ্ছে। উল্লেখ্য, জাপানিরা মৃত মানুষের মুখ দেখায় না। গুলশান হ্ত্যাকাণ্ডের শিকার সেই ছয়জনের চেহারাও দেখতে দেয়নি মিডিয়া।
বুঝলাম সেই ফ্ল্যাটে বুড়ো দম্পতির কেউ মারা গেছেন, ভোরের আওয়াজটা ছিল গোঙানির বা স্বজন হারানোর আর্তনাদ। সবচেয়ে মর্মান্তিক হচ্ছে, পেছনে যে রয়ে গেল সেও একদিন চলে যাবে, কিন্তু সাধারণ হিসেবে তার চলে যাওয়াটা হবে একা। কেউ জানবে না । শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করার সময় তার পাশে থাকবে না কোনো দয়ার্দ্র চোখের ছায়া, যেই ছায়া গভীর ঘন হবে তার বিচ্ছেদ বেদনায়। তার লাশ পরে থাকবে একদিন, দু’দিন, সাত দিন। শরীর পচে গন্ধ ছড়ালে প্রতিবেশী পুলিশকে খবর দেবে। পুলিশ এসে উদ্ধার করবে, বাড়িটি বিশেষ তালিকাভুক্ত হবে; যেই বাড়ি কোনো জাপানি তো নয়ই, সচরাচর কোনো বিদেশিও নেহায়েত নিরুপায় না হলে নেবে না।
জাপান সরকার অনেক কিছুই প্রচলন করেছেন, আইসি কার্ডের এক চিপেই সব তথ্য থাকবে ‘মাই নাম্বার’ কার্ড সিস্টেমে। এতে একা মানুষগুলো কয়েক দিন জিমে বা বিভিন্ন পাবলিক/প্রাইভেট সেন্টারে না গেলে কর্তৃপক্ষের কাছে বার্তা যাবে। বাড়িতে লাগানো সেন্সরে তার নড়াচড়ার অস্তিত্ব না পাওয়া গেলেও একই বার্তা যাবে। এতে মৃত শরীর বিকৃত হওয়ার আগে অন্তত বের করা যাবে- এই!
বয়স্ক মানুষের ভারে উদ্বিগ্ন জাপানে গড়-আয়ু বিশ্বে সবচেয়ে বেশি, ৮২ শতাংশ থেকে ৮৩ শতাংশ। অবসরের বয়স সীমা বাড়িয়ে ৫৫ থেকে এখন ৬০-৬৫ করা হয়েছে। তাতেও নিস্তার নেই, তারা যে বেঁচে থাকে অবসরের পরে আরো ৩০ অথবা ৪০ বছর! পেনশন বাজেটে সরকার পেরেশান। তাদের চিকিৎসা, বাসস্থান, যাতায়াত ভাড়াও ফ্রি। এই ফ্রি জেনারেশনই এখন মোট লোকসংখ্যার ২৬ শতাংশ। সুস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, জীবনযাপন পদ্ধতি, নিয়মিত শরীরচর্চা সবকিছু মিলিয়ে জীবন শুকিয়ে গেলেও আয়ু তো ফুরায় না। জিমেও এদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। কারণ, তারা অচল হয়ে পড়ে গেলে দেখার কেউ তো নেই। যদি কেউ অ্যাম্বুলেন্স ডাকাতে সক্ষম না হয়, তো হাসপাতালেই কাটাতে হবে। এছাড়াও দৈনন্দিন কোনো কাজ তো পড়ে থাকবে না। কাজেই ৮০ থেকে ৯০ বছরেও জিমে ট্রেড মিলে দৌড়ে নিজেদের সচল রাখে অন্তত নিজের কাজ, ঘরের কাজ করার সচলতা যেন থাকে- যতদিন প্রাণবায়ুটা বেরিয়ে না যাচ্ছে।
ক্লান্ত সিল্ভার এইজের মানুষগুলোর মধ্যে অনেকেই বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবায় যুক্ত হন। সেখানে বন্ধু বানায়, দলবেঁধে বাসে-ট্রেনে ঘুরে বেড়ায়। বিউটি পার্লার, কসমেটিক্স কর্নারে কেবল তাদের ভিড়। চুল রঙ করছে, কার্ল করছে, পার্ম করছে, এই সেবা নিচ্ছে, সেই সেবা নিচ্ছে। কসমেটিক্স কর্নারের সেলস গার্ল নকল হাসি দিয়ে যাই গছাচ্ছে কিনেই যাচ্ছে। প্রথম প্রথম চোখ বের হয়ে যেতো এসব দেখে! আরে এই অশীতিপর বুড়া মানুষ এতো সেজে কী করবে? এসব লোশন, এইজ মিরাকেল, প্রসাধন কিনে আর কী হবে?
এখন আস্তে আস্তে বুঝি, না তাদের বয়সে বুদ্ধিলোপ পায় না, এই বোকামির বিনিময়ে তারা টক-টাইম কেনে! আমাদের মোবাইলের টক-টাইম না, বিক্রেতার কথা বলার সময়। স্বাভাবিক নিয়মেই দোকানি বা পার্লার কর্মী যতক্ষণ তারা চলে না যায়, ততক্ষণ কথা বলতে বাধ্য। আর তারা কিনবেই জেনে ক্লান্তি আসে না সেলস গার্লেরও। এটাই তাদের প্রাপ্তি। কারণ তাদের ‘দুঃখের কথা কইতে গেলে, এই দুনিয়ার সবাই বলে, শোনার সময় নাই!’
যাদের এতো পয়সা নাই বা শখ নাই, তারা যাত্রাপথে সহযাত্রীদের টক-টাইম চেয়ে বসে। বাসে কোনো বুড়ো-বুড়ি পাশে বসতে আসছে দেখলেই হাতের কাজ ফেলে দ্রুত হেডফোন কানে দিতে হয় বা ঘুমের ভান করে মটকা মারতে হয়, না হলে পুরো যাত্রা তার অহেতুক কথা শুনে যেতেই হবে। নাতি-নাতনি ক্রিসমাসে দেখা করতে যাবে আশায় টাকা আলাদা করে রাখেন। নাতি-নাতনিরও সেটাই হাতখরচা। আর তাদের নাতি-নাতনির টক-টাইম কেনা, সঙ্গলাভ।
বয়সের রঙের সংজ্ঞা এটা উল্টে দিয়েছে। জীবন পার করে মনের কথা না বলে, সাদা-কালো পোশাকে মুড়িয়ে রেখে, হালকা ন্যাচারাল কালার গ্লস লিপস্টিকে। বয়স ৬০ হলে লাল রঙ চড়ে ঠোঁটে । চুলে, চোখের পাতায়, কাপড়ের রঙে রামধনু রঙের বাহুল্য! মুখে কথার খৈ। আমার বাসায় উচ্চ সালামি দিয়ে ইংরেজি শিখতে আসতো অনেক বুড়ো মানুষ। ক’দিন পরেই বুঝে গেলাম, আসল উদ্দেশ্য কথা বলা। আমিও তখন জাপানে এসে হোমসিকনেসে ভুগছি, তাই এই অহেতুক আড্ডাবাজি খারাপ লাগতো না। পরে নিয়মিত পেশায় ব্যস্ত হয়ে গেলে সবাইকে বিদায় দিতে হলো।
এদিকে নতুন জেনারেশনের বাচ্চা নেয়ায় অনাগ্রহ, কোনো সম্পর্কের ঘেরাটোপেই যাচ্ছে না এই জেনারেশনের ৪০ শতাংশ। তাই, এরা সবাই খুব কুকুর পোষে। নতুন জেনারেশন বাচ্চা না নিয়ে কুকুর পালা শ্রেয় মনে করে। সুপার মার্কেটে বাচ্চাদের খাবার, জামার কর্নার না থাকুক, পোষা প্রাণির কর্নার থাকবেই। বাচ্চা বড় হবে, ভুলে যাবে, সরে যাবে। কুকুর তো ভুলে যাবে না। ঘর রক্ষা করবে, বিপদে কাউকে ডেকে আনতেও পারবে।
বুড়ো মানুষদের নিয়মিত সাইকেলে চড়তে, জিমে দৌড়াতে দেখে ভাবি আমাদের মায়েরা ৬০ না হতেই আর্থ্রাইটিসে জর্জরিত, বাবারা থাকেন নানা ব্যাধিতে অন্যের সেবায় নির্ভর। এমন একা একা ঘরের কাজের মানুষ, ড্রাইভার, দারোয়ান ছাড়া জীবনে তাদের কী দশা হতো! আমাদের দেশে এখনো খুব কম বৃদ্ধাশ্রম, যেমন থাকুন বাবা-মা আছেন সঙ্গে প্রায়ই। একা থাকলেও যাদের অর্থনৈতিক সচ্ছলতা আছে জীবন চালানোর মতো নিত্যকার সাহায্য-সেবা যেমন তেমন পাওয়া তো যায় এখনো।
উবাস্তে ইয়ামা’র গল্পটা অনেকের জানা। প্রাচীন জাপানে (উবাস্তে; উবা= বৃদ্ধা, স্তুতে=ফেলে দেয়া, ইয়ামা= পাহাড়)। উবাস্তে ইয়ামা পাহাড়টা নতুন নামে দাঁড়িয়ে আছে এখনো জাপানের নাগানোতে। খাবারের অপ্রতুলতার যুগে অকার্যকর বুড়ো বাবা-মাকে পাহাড়ে ফেলে আসার লোকগাথা। মা হাতে গাছের ডাল নিয়ে ছেলের কাঁধে চড়ে পথে ফেলতে ফেলতে যেতেন যেন সন্তান ফেরার পথে আঁধার ঘনালে পথ ভুলে না যায়। বর্তমান সমাজ ব্যবস্থার বিবেচনায় সাংবাদিক তাকাশি হিরোহাসি বলেছিলেন, ‘এখনের নিউক্লিয়ার পরিবার বৃদ্ধ বাবা-মাকে পাহাড়ে পরিত্যাগ করে না। কিন্তু তাদের যে অনির্দিষ্টকালীন একাকিত্বে ছুড়ে ফেলে, তা উবাস্তেইয়ামার চেয়েও করুণ। কারণ পাহাড়ে অনাহারে, শীতে মানুষটা মরতে সময় নেয় না। কিন্তু একা ঘরের এই শূন্য জীবন তো শেষ হয় না ’
আশঙ্কা হয়, বিশ্বায়নের প্রভাবে ভালোটা যেন গ্রাস না করে ফেলে।
লেখক : কলামিস্ট; প্রাক্তন রিসার্চ ফেলো, কিউশু বিশ্ববিদ্যালয়; বিভাগীয় প্রধান, বিজনেস প্ল্যানিং ডিপার্টমেন্ট, স্মার্ট সার্ভিস টেকনোলজিস কো. লিমিটেড, ফুকুওকা, জাপান
[email protected]
এইচআর/এনএইচ/এমএস