হিলারি নন হেরেছে আইসিস
মিডিয়া যে আসলে সাধারণ মানুষকে বুঝতে পারে না সেটা আবারও প্রমাণিত হলো যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফলের মধ্য দিয়ে। মিডিয়ার এই শনৈঃ শনৈঃ এর যুগে যখন মিডিয়া চাইলেই কাউকে হিরো কিংবা জিরো বানিয়ে দিতে পারে সেখানে তাদের সকল সমর্থন এবং অনৈতিক সহযোগিতার পরও হিলারি ক্লিনটনের যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে না পারা আসলে বিগ মানি’র ক্ষমতায় টিকে থাকা তথাকথিত লিবারেল মিডিয়ার পরাজয় এবং সে কারণেই ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয় আসলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের বিজয়। এখন প্রশ্ন হলো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ ডোনাল্ড ট্রাম্পকে বিজয়ী করে বড় ধরনের কোনো ভুল করলো কিনা? এ প্রশ্নের উত্তর আমাদের সময় বলে দেবে, আপাততঃ এই নির্বাচন ও নির্বাচনকে ঘিরে তৈরি হওয়া কিছু মিথ নিয়ে ব্যাখ্যায় যাওয়া যাক।
সর্বশেষ বারাক ওবামা যখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন তারপর থেকেই আমরা জেনে আসছি যে, পরবর্তী প্রেসিডেন্ড হিসেবে ডেমোক্রেট দল থেকে হিলারি ক্লিনটন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চলেছেন। কেউ কেউ আগ বাড়িয়ে একথাও বলছিলেন যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেহেতু একজন কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করেছে সেহেতু তারা এবার একজন নারীকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করবে। অনেকেই বড় মুখ করে বলতে শুরু করেছিলেন যে, বারাক ওবামা যেহেতু প্রেসিডেন্ট সেহেতু পৃথিবীতে শান্তির সুবাতাস বয়ে যাবে। কিন্তু সেটা যে কতো বড় ভুল ব্যাখ্যা ছিল তার প্রমাণ হলো বারাক ওবামার পক্ষেও মধ্যপ্রাচ্যসহ পৃথিবীর কোথাওই শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়নি, যার প্রত্যেকটি জায়গাতেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে কনফ্লিক্ট বা সংঘাত চলমান রয়েছে। উল্টো এসব সংঘাতপূর্ণ জায়গায় বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে আইসিস- এর মতো ভয়ঙ্কর দানব মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, তারা এখন বাংলাদেশের মতো ক্ষুদ্র ও শান্তিপূর্ণ রাষ্ট্রকেও গ্রাস করতে চাইছে।
দুঃখজনক সত্য হলো হিলারি-ওবামার নেতৃত্বেই যে এই ধর্মাশ্রয়ী দানবের জন্ম হয়েছে তা এখন আর গোপন কোনো তথ্য নয়, উইকিলিকস্-এর কল্যাণে পৃথিবী এই সত্য জেনে গেছে। সুতরাং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই নির্বাচনে হিলারির বিরুদ্ধে যারা ভোট দিয়েছেন তারা মূলতঃ আইসিস-কে পরাজিত করতে চেয়েছেন বলে আমার বিশ্বাস। আর এ জন্য উইকিলিকস-এর প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান এ্যাসাঞ্জকেও একটা ধন্যবাদ মুক্তিকামী মানুষের পক্ষ থেকে দেওয়া উচিত বলে বিশ্বাস করি।
তার মানে কি নারী-বিদ্বেষী, অভিবাসন-বিদ্বেষী ডোনাল্ড ট্রাম্পকে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হিলারির বিকল্প হিসেবে নিয়েছে? আমার মনে হয়, হিলারি নয় বেছে নিয়েছে আইসিস-এর বিকল্প হিসেবে। সেই সঙ্গে যদি একথা জোর দিয়েই বলি যে, হিলারি যে প্রক্রিয়ায় প্রাইমারিতে জয়লাভ করে ডেমোক্রেট দলের প্রার্থী হয়েছিলেন সেটাও কোনোভাবেই সুষ্ঠু ও স্বাভাবিক ছিল না। উইকিলিকসের কল্যাণেই আমরা জানি যে, হিলারি ক্লিনটন বার্নি স্যান্ডার্সকে হারিয়েছিলেন ষড়যন্ত্র করেই। এক্ষেত্রে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে যদি বার্নি স্যান্ডার্সের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হতো তাহলে আজকের ফলাফল যে উল্টো হতো না, তা হলফ করে বলা যাবে না। একজন পশ্চিমা বামপন্থী বিশ্লেষকের মতে, একজন পাগল ও একজন শয়তানের মধ্যে মার্কিন জনগণ একজন পাগলকে প্রাধান্য দিয়েছে এবং জনগণ এ কারণেই ভুল করেনি যে, পাগল তার নিজের ভালোমন্দ তথা দেশ ও দেশের মানুষের ভালোমন্দ ঠিকই বুঝবে, কিন্তু একজন শয়তানের কাছে রাষ্ট্র ও জনগণের চেয়েও নিজের ‘ইগো’ ‘উচ্চাভিলাষ’ প্রাধান্য পাবে এবং শেষাবধি তাতে জনগণের পরাজয় ঘটতো। আর তাই হিলারিকে পরাজিত করে ট্রাম্পকে বেছে নিতে দ্বিধা করেনি যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এবারের নির্বাচন যতোটা বিশ্বময় আলোচিত হয়েছে ততোটা আলোচনায় আসেনি আর কোনো নির্বাচন। এর মূল কারণ হিলারি ক্লিনটন ও ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেই, গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে দু’পক্ষই এতোটাই নিচে নেমেছিলেন নির্বাচনী প্রচারণায় যে, অনেকেই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকেই ঘৃণা করতে শুরু করেছিলেন। দু’পক্ষই একে অপরকে আঘাতে ‘বিলো দ্য বেল্ট’ নীতির আশ্রয় নিয়েছিলেন এবং একে অন্যকে নর্দমা থেকে নোংরা তুলে ঘায়েল করার চেষ্টা করেছেন। অথচ বৈশ্বিক মিডিয়া বিষয়টির জন্য কেবল ট্রাম্পকে এককভাবে দায়ী করেছে, হিলারিকে ‘আক্রান্ত’ হিসেবে প্রমাণ করার চেষ্টায় রত থেকেছে, যা অত্যন্ত নোংরাভাবে ফুটে উঠেছিল। এমনকি দু’পক্ষের নির্বাচনী প্রচারণা ফান্ডের দিকেও যদি দৃষ্টি দেই তাহলে দেখতে পাই যে, হিলারি ক্লিনটন মূলতঃ অর্থ পেয়েছেন মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানি, ইসরায়েলি অক্ষশক্তি এবং তথাকথিত এনজিও-টাইকুনদের কাছ থেকে।
অপরদিকে ট্রাম্পের ফান্ড মূলতঃ তার নিজস্ব ব্যবসা থেকে অর্জিত সম্পদ থেকেই। নির্বাচনী প্রচারণা ক্যাম্প যদি দেখেন তাহলে দেখা যায় যে, ট্রাম্পের চেয়ে হিলারির ক্যাম্পের সংখ্যা প্রায় কয়েকগুণ বেশি। এরকম ভাবে তুলনা করলে প্রমাণ পাওয়া যায় যে, হিলারি ক্লিনটনের পাশে মিডিয়া, ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান, এনজিও-টাইকুন, মাল্টি ন্যাশনালস-এর অর্থ সবকিছুই ছিল আর ট্রাম্প ছিলেন একা, একা এবং সম্পূর্ণ একা। সেক্ষেত্রে ট্রাম্পের এ বিজয় তার একার আর হিলারির পরাজয় সামগ্রিকভাবে ক্ষমতালোভী অক্ষশক্তির। কিন্তু বিজয় লাভের পর প্রথম বক্তব্যে ট্রাম্প সে ভুল ভাঙিয়ে দিয়ে বলেছেন যে, তিনি এখন সবার প্রেসিডেন্ট, তিনি কোনো দলের প্রেসিডেন্ট নন। মজার ব্যাপার হলো, নির্বাচনী প্রচারণায় যে মারমুখী চেহারা নিয়ে ট্রাম্প আবির্ভূত হয়েছিলেন বিজয়ের পর তার চেহারা থেকে তা উধাও হয়েছে, এমনকি তার বক্তব্যও অত্যন্ত মার্জিত ছিল। সকাল যদি দিনের আলামত দেয় তাহলে বলতেই হবে যে, প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্প খুব একটা খারাপ হবেন না, আসলে পশ্চিমের কোনো নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের পক্ষেই খুব বেশি গণবিরোধী হওয়া সম্ভবপর হয় না, ট্রাম্পও হবেন না।
মজার ব্যাপার হলো, যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনকে নিয়ে বাংলাদেশের মতো অতি মাত্রায় রাজনৈতিক ‘সচেতনতার’ দেশে যে পরিমাণ আগ্রহ ও উদ্দীপনা তৈরি হয়েছিল তা সত্যিই অভাবনীয়। বিশেষ করে হিলারিকে কেন্দ্র করে দেশের একটি বিশেষ শ্রেণি (বিএনপি-জামায়াত, এনজিওকর্মী, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক) অত্যধিক আশাবাদী হয়ে উঠেছিলেন যে তাদের আচরণে বোঝার উপায় ছিল না যে, হিলারি নির্বাচিত হলে আসলে কোন্ দেশের প্রেসিডেন্ট হবেন, আমেরিকার নাকি বাংলাদেশের? তাদের আচরণে মনে হতো, হিলারি বাংলাদেশে শেখ হাসিনার সরকারকে টপকে এদেশেই প্রেসিডেন্ট হতে যাচ্ছেন। তাদের আশার গুড়ে বালি পড়েছে সন্দেহ নেই, কারণ ট্রাম্প-এর বিরোধিতায় আসলে তাদের আর কোনো যুক্তি নেই হিলারির প্রতি যুক্তিহীন সমর্থন ছাড়া, কারণ যে কারণে ট্রাম্প বিশ্বের কাছে সমালোচিত যেমন নারী-বিদ্বেষ, বর্ণবাদ, অভিবাসী-বিদ্বেষ, এর প্রত্যেকটিই আসলে বাংলাদেশে বর্তমান এবং এদের মধ্যে তুলনামূলক ভাবে একটু বেশিই লক্ষ্যণীয়।
দুঃখজনক হলো, পরাজিত এই শিবিরের জন্য হিলারি ক্লিনটন কোনো বার্তা রাখেননি, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রেও তার সমর্থকদের সামনে এসে দাঁড়িয়ে নির্বাচনে পরাজয়কে মেনে নেওয়ার মতো সাহস তার হয়নি। তিনি ট্রাম্পকে ফোন করে অভিনন্দন জানিয়ে অন্তরালে গিয়েছেন। তার অপেক্ষমান সমর্থককূলকে অশ্রু ও ভগ্ন হৃদয় নিয়ে বাড়ি ফিরতে হয়েছে। কোনো ভাবেই হিলারি ক্লিনটন উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারেননি। বরং তিনি বিশ্বকে ট্রাম্পের মতো একজন ‘এলোমেলো’ ব্যক্তিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রেসিডেন্ট তথা বিশ্বের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে গেলেন। এজন্য অবশ্যই হিলারির নিন্দা হওয়া উচিত, আজকে স্যান্ডার্সের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় যদি ট্রাম্প জয়ী হতেন তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের সমালোচনাটা বৈধ হতো, কিন্তু এখন তাদের সমালোচনা করবো আমরা কোন্ মুখে? ট্রাম্পের উল্লম্ফনতো আমাদের জানাই কিন্তু হিলারির গুপ্ত-এজেন্ডাতো আমাদের কারোরই জানা নেই, তাই নয় কি?
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাকি বিশ্বের সম্পর্কের সমীকরণ কোনো ভাবেই সরল নয়। বরং এই সম্পর্কটা অত্যন্ত সমীকরণের ওপর দাঁড়ানো। ট্রাম্প চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে বন্ধুতার কথা বলেছেন, হিলারি বলেছিলেন তার উল্টো কথা। আইসিস দমনে রাশিয়ার ভূমিকার সঙ্গে সরাসরি সংঘর্ষে নেমেছিল ওবামা-হিলারির আমেরিকা। ট্রাম্পের আমেরিকায় এই সমীকরণ বদলালেও বদলাতে পারে। মানুষ হিসেবে আমরা কেবল আশাই করতে পারি, দুরাশা নয়।
ঢাকা, ৯ নভেম্বর, বুধবার, ২০১৬
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট
এইচআর/এবিএস