৭ নভেম্বর উদযাপনকারীদের হাতে গণতন্ত্র কতোটা নিরাপদ?
রাজনীতি যে মুহূর্তে রাজনৈতিক নেতৃত্বের হাতছাড়া হয়ে যায়, সে মুহূর্তে গণতন্ত্র এবং রাজনীতি দুয়েরই মৃত্যু ঘটে- বাংলাদেশে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর ঠিক এই ঘটনাটিই ঘটেছিল। যদিও ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকেই এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ভেতর দিয়ে কিন্তু ৭ নভেম্বর এই প্রক্রিয়া দীর্ঘ দুই দশকেরও বেশি সময়ের জন্য স্থায়িত্ব লাভ করে। বাংলাদেশে শুরু হয় সেনাশাসন ও তার বাই প্রোডাক্ট হিসেবে আমরা পাই দুটি রাজনৈতিক দল বিএনপি এবং জাতীয় পার্টি। এবং সেই সঙ্গে উপরি হিসেবে বাঙালি জাতির কপালে জোটে জামায়াতের মতো ধর্মভিত্তিক ও স্বাধীনতাবিরোধী রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানও।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেই দেশের সেনাবাহিনীকে একটি রাজনৈতিক চরিত্র দেওয়ার চেষ্টা করেন জিয়াউর রহমান। যে মুহূর্তে তিনি নিজেকে ‘প্রভিন্সিয়াল চিফ’ হিসেবে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করার চেষ্টা করেন এবং উপস্থিত ‘সিভিলিয়ানদের’ দ্বারা তার সে চেষ্টা প্রতিহত করা হয়, তা থেকেই প্রমাণ পাওয়া যায়, পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তাদের মতো জিয়াউর রহমান একটি স্বাধীনতা-উন্মুখ জাতির রাজনৈতিক ভাগ্যকে কলুষিত করতে চেয়েছিলেন এবং এতে তিনি সফলও হন ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর এসে। কিন্তু এতে কি দেশের প্রতিবিপ্লবী রাজনৈতিক চক্রের কোনো ইন্ধন ও সহযোগিতা ছিল না? অবশ্যই ছিল।
সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে জাসদের জন্ম ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমাদের সামনে যে সত্য স্পষ্ট হয় তাকে আসলে প্রতিবিপ্লবী অপশক্তি ছাড়া অন্য কোনো নাম দেওয়া যায় না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগ যখন একটি ‘তলাবিহীন ঝুড়িকে’ মেরামত করে তাকে একটি শক্ত ভিত্তি দেওয়ার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তখন জাসদের রাজনীতি কেবল একটি বিরোধী পক্ষ হিসেবে কাজ করেনি, বরং গণবাহিনী গঠন করে দেশটাকে অস্থিতিশীল করায় সবচেয়ে বড় ভূমিকাটি রেখেছে। সেনাবাহিনীকে রাজনীতিতে টেনে আনার দ্বিতীয় প্রক্রিয়াটি আমরা এসময়ই দেখতে পাই। জাসদের সিভিল-মুখগুলোর সঙ্গে মেজর জলিল ও কর্নেল তাহেরকে আমরা দেখি দেশের সেনাবাহিনীকে খুব কৌশলে রাজনীতিতে টেনে আনার ক্রীড়নক হিসেবে। সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করে সরকার উৎখাতের এই প্রচেষ্টা তখন বৈশ্বিকভাবেই জনপ্রিয় ছিল ঠিকই কিন্তু আগেই বলেছি বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের পাকিস্তানের নিগড় থেকে জান বাজি রেখে বেরিয়ে আসার অন্যতম মূল কারণ কিন্তু ছিল পাকিস্তানের সেনাশাসন ও অগণতান্ত্রিক চরিত্র। ফলে জাসদের সিভিল নেতৃত্ব ও সামরিক বাহিনী থেকে আসা নেতৃত্বের মাঝে ব্যক্তিত্বের ও চিন্তার দ্বন্দ্ব ছিল উন্মুক্ত (জাসদের উত্থান-পতন : অস্থির সময়ের রাজনীতি, মহিউদ্দিন আহমদ, প্রথমা প্রকাশন)।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে জাসদের অংশগ্রহণ ছিল কি ছিল না তা নিয়ে গবেষণা হতে পারে কিন্তু সে গবেষণার আগেই যে কথাটি জোর দিয়ে বলা যায় যে, বঙ্গবন্ধুর সরকারকে অস্থির ও অস্বস্তিতে ফেলার জন্য শতভাগ দায় জাসদকে নিতেই হবে। দেশের ভেতর অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে হত্যার জন্য একটি শিশু রাষ্ট্রকে যতোটা কঠোর হওয়ার প্রয়োজন ছিল বঙ্গবন্ধুর সরকার ঠিক ততোটা কঠোর হতে পারেনি আর সেই সুযোগটাই জাসদ গ্রহণ করেছিল। সারা দেশে লুটপাটসহ নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হত্যার জবাবে রক্ষীবাহিনী যেটুকু করেছিল তা সত্যিকার অর্থে উল্লেখ করার মতো কোনো বিষয় নয়। অনেকেই এর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করতে পারেন কিন্তু পাকিস্তানিরা চলে যাওয়ার পর যে ‘এনার্কি’ এদেশে ঘটার সুযোগ ছিল তা দমনে রক্ষীবাহিনীর মতো বাহিনীর প্রয়োজন ছিল বৈকি। সে প্রসঙ্গ যদিও ভিন্ন কিন্তু আলোচনার স্বার্থে এই কথাটুকু বলতেই হলো কারণ এখনও অনেক বুদ্ধিমান মানুষ জাসদ নিয়ে আলোচনায় রক্ষীবাহিনীর প্রসঙ্গ আনতে পারলে বর্তে যান।
ফিরে আসা যাক ৭ নভেম্বর প্রসঙ্গে। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে। দেশে চলছে মেজরদের শাসন, মুশতাক বঙ্গভবনে নবাবী করছে। একের পর এক ফরমান জারি হচ্ছে। জিয়াউর রহমান তক্কে তক্কে রয়েছে ক্ষমতা দখলের। সেই সময় কর্নেল তাহের খুনি মেজরদের সঙ্গে জিয়াউর রহমানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য দেন-দরবারও করছেন বলে মহিউদ্দিন আহমেদ’র বই থেকে আমরা জানতে পারছি। এর মধ্যেই খালেদ মোশাররফ একটি ক্যু করে ফেললেন কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তাকে সঙ্গে নিয়ে। প্রশ্ন উঠতে পারে যে, খালেদ মোশাররফ ক্যু করে কি জনগণের বা রাজনৈতিক শক্তির হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন? সে বিষয়ে বিতর্ক হতে পারে কারণ তিনি সে সুযোগ পাননি। কিন্তু তার ক্যু-এর নিট ফলাফল হলো জেলের ভেতর জাতীয় চার নেতাকে হত্যার ঘটনা, যার ফলশ্রুতিতে রাজনৈতিক নেতৃত্বের আর কোনো সুযোগ থাকলো না দেশের রাজনীতিতে নেতৃত্ব দেওয়ার। ১৯৭৫ সালের নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহটি আসলে সে কারণে কোনো বিপ্লব, সংহতি বা সৈনিকদের উত্থানের কালপর্ব নয়, বরং রাজনৈতিক নেতৃত্বকে হত্যা করে দেশের রাজনীতির চাবিটি সেনাবাহিনীর হাতে নিয়ে নেওয়ার ভয়ঙ্কর সময়। এতে একদিকে যেমন সেনাবাহিনীর ‘প্রফেশনালিজম’-কে হত্যা করা হয়েছে তেমনই সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করে একদল সেনা কর্মকর্তা দেশে-বিদেশে ও ইতিহাসে সর্বত্রই সেনাবাহিনীর চরিত্রকে কালিমালিপ্ত করেছে।
অপরদিকে সেনাবাহিনীকে রাজনৈতিক ভাবে উচ্চাভিলাষী করে রাষ্ট্র পরিচালনায় টেনে এনে দীর্ঘ সময়ের জন্য দেশকে সামরিক শাসনাধীন করা হয়েছে। গণতন্ত্রকে নির্বাসনে পাঠানো হয়েছে এবং আগেই বলেছি যে, তার বাই প্রোডাক্ট হিসেবে আমরা পেয়েছি বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতের মতো গণতন্ত্র-বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি। এখন বলুন, এই ত্রয়ী শক্তির বিপক্ষে দাঁড়িয়ে আওয়ামী লীগের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক চরিত্র কতোটা সঠিক পথে থাকা সম্ভব? ৭ই নভেম্বরের বাই প্রোডাক্ট হিসেবে আমরা আরো পেয়েছি কালো-বাজারি লুটেরা শ্রেণির হাতে ক্ষমতা চলে যাওয়ার প্রবণতা, সাম্প্রদায়িক উস্কানি দিয়ে দেশের ভেতর বিশৃঙ্খলা তৈরির প্রবণতা যা রাজনৈতিক ভাবে প্রতিষ্ঠা পায় দুই সামরিক আমলে এবং পরবর্তীতে বিএনপি যাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয় ২০০১ সালের নির্বাচনের সময়, দুর্নীতি-কে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকিয়ে দিয়ে জিয়াউর রহমান নিজে সৎ হিসেবে নিজেকে জাহির করেন। যদিও আমরা তার বিখ্যাত উক্তির মধ্যে যে দুটিকে সব সময় শুনে থাকি তাহলো ‘আমি রাজনীতিতে রাজনীতিবিদদের জন্য কঠিন করে তুলবো’ আর ‘টাকা কোনো সমস্যা নয়’। কেউ কি ৭ নভেম্বরের ঘটনার এই নিট ফলাফলকে কোনো ভাবে অস্বীকার করতে পারবেন? না করার কোনো সুযোগ রয়েছে?
কর্নেল তাহের তার গণবাহিনী বা বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার কর্পোরালদের দিয়ে ৬ নভেম্বর দিবাগত রাতে জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করে এনে বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি স্থায়ী কালসাপ-এর বাসাকে ভিত্তি দিয়ে গিয়েছেন। যার ছোবল থেকে তিনিও বাঁচতে পারেননি, এক বছর না যেতেই ১৯৭৬ সালের জুলাই মাসেই তাকে হত্যা করা হয় ফাঁসির নামে। অপরদিকে বাকি কর্পোরালদের বিনা বিচারে দেশের বিভিন্ন জায়গায় পুলিশ বাহিনী দিয়ে হত্যা করানো হয়। যারা বেঁচে থাকেন তারা আর কোনোদিন ঠিক সেভাবে উঠে দাঁড়াতে পারেননি। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ কেন জাসদ ও জিয়ার হাতে ক্ষতিগ্রস্তদের তার পাশে রেখে রাজনীতি করে সে প্রশ্নের উত্তর খুব সোজা, কারণ, এই রাজনৈতিক ব্যক্তিগুলোর পাশে দাঁড়ানোর আর কেউ নেই। ইনক্লুসিভ রাজনীতির উদাহরণ হিসেবেও আমরা একে দেখতে পারি বা দেখা উচিতও।
এক সময়ের শত্রু যদি ভুল স্বীকার করে পাশে এসে মিত্রের হাত বাড়ায় তাহলে সে হাতকে উপেক্ষা করা ভয়ঙ্কর অপরাধ ও রাজনৈতিক মূর্খতা। এক্ষেত্রে বিএনপিরও সে সুযোগ ছিল, তারাও জিয়াউর রহমানের বিএনপি থেকে খালেদা জিয়ার বিএনপি’তে পরিণত হতে পারতো বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের জীবিত সদস্যদের বিরুদ্ধে কখনও গ্রেনেড হাতে বা কখনও পেট্রল বোমা হাতে নিয়ে বিরোধিতার রাজনীতি থেকে সরে এসে, কিন্তু সে সুযোগ বিএনপি নেয়নি, আর নেয়নি বলেই এখনও বাংলাদেশের রাজনীতিতে আমরা ঐক্য বা সমঝোতার বিষয়টি দেখতে পাই না। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে, জাতীয় চার নেতাকে হত্যার সঙ্গে জিয়াউর রহমান জড়িত থেকে (কিংবা ধরুন প্রচ্ছন্ন মদদ দিয়েই) যে ভয়ঙ্কর পাপ করেছে, তার ছেলে তারেক রহমান সেই একই পাপ করেছে গ্রেনেড হামলার সঙ্গে জড়িত থেকে, এরকম প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে রাজনৈতিক বিরোধিতা চলতে পারে না এবং এই প্রক্রিয়ায় কোনো রাজনৈতিক দলও টিকে থাকতে পারে না, মুসলিম লীগ পারেনি, বিএনপিও তাই পারছে না, আজ তাদের অস্তিত্ব সংকট আসলে তাদের জন্ম প্রক্রিয়ার সেই ৭ই নভেম্বর থেকেই শুরু হয়েছিল।
মুখে গণতন্ত্রের কথা বলে কোনো ভাবেই একটি সেনা অভ্যুত্থানকে তাদের ‘বিপ্লব ও সংহতি’ দিবস হিসেবে উদযাপন গণতান্ত্রিক চরিত্র ও রাজনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, হতে পারে না। ৩ নভেম্বর জেলখানায় জাতীয় নেতাদের হত্যা-দিবস পালন না করে তাদের হত্যার মধ্য দিয়ে সেনা-রাজনীতির উত্থানের সর্বশেষ ধাপ ৭ই নভেম্বর পালন কোনো ভাবেই বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দেয় না, বরং একথাই প্রমাণিত হয় যে, যারা এই দিবসটি উদযাপন করে তারা আসলে গণতান্ত্রিক নেতৃত্ব হত্যা, মুক্তিযোদ্ধা হত্যা ও সেনা-রাজনীতিকে বৈধ মনে করে এবং তার লিগেসি বহন করে। বাংলাদেশ তাদের হাতে কী ভাবে, কোন প্রকারে নিরাপদ বলতে পারেন?
ঢাকা ৭ নভেম্বর, সোমবার ২০১৬
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।
[email protected]
এইচআর/পিআর