নারী ধর্ষণ: আরে এটা কোনো ব্যাপার?
কি হয়েছে? সমস্যা কি? কি এমন ঘটেছে যে এটাকে জাতীয় ইস্যু বানাতে হবে? মেয়েটিকে কি মেরে ফেলা হয়েছে, লাশ পাওয়া গেছে পাটক্ষেতে? ওহ, তাও না? জাস্ট ধর্ষণ? তার সঙ্গে পা কাটা হয়েছে? তাতে কি? মাথা তো আর কাটা হয়নি। কি বললেন, স্বামীর গলায় তালোয়ার ধরেছিল? স্বামীর গলা কি কেটে ফেলেছে? কাটেনি? তাহলে আর এমন কি! ১৫ দিন ধরে আহত মেয়েকে ধর্ষণ করেছে? তারপরও মরেনি! খুব কড়া জান তো,একেবারে কই মাছের প্রাণ। এই মেয়েগুলো খুব শক্ত ধাঁচের হয়! সংখ্যালঘু ধর্ষণ সম্পর্কে এমনই কি ভাবে না প্রশাসন?
বলছি বাগের হাটের মোল্লার হাটের সোবহান মোল্লার ঘটনাটার কথা। যেটা নিয়ে মিডিয়া তেমন মাথা ঘামায়নি। সেই সঙ্গে আরও বলছি সেই মেয়েটির কথা যাকে ধর্ষণ করেছে তারই গৃহশিক্ষক। বলছি বাগেরহাটেরই মোড়েলগঞ্জে যে মেয়েটিকে লঞ্চে তুলে ধর্ষণ করা হয়েছে কাজ দেওয়ার নাম করে বাড়ি থেকে নিয়ে গিয়ে। বলছি আরও অনেক মেয়ের কথা যারা কখনও দরিদ্র বলে, কখনও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বলে, কখনও আদিবাসী বলে, আবার কখনও স্রেফ মেয়ে বলে ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। না তারা নিহত হয়নি। যেহেতু তারা নিহত হয়নি তাই তাদের ধর্ষণ, তাদের উপর নির্যাতন তেমন কোনো গুরুত্বও পায়নি। তাহলে কি মরে গেলে গুরুত্ব পেত? না, তাও নয়। এরা মরলেই কি আর না মরলেই কি। আর যদি গুরুত্ব পেত খবর হিসেবে তাহলেও কি বিচার হতো তার হত্যার? না তো। তনু হত্যার কি বিচার হয়েছে? বিচার হয়েছে অন্যান্য ধর্ষণ ও হত্যার?
ঢাকায় মাইক্রোবাসে গারো তরুণী ধর্ষণের ঘটনাটি মনে আছে? সেই ঘটনার বিচার হয়েছে? জানি না। আরও অনেক ধর্ষণ ও নিপীড়নের ঘটনা ঘটেছে, ঘটছে, ঘটে চলবে এই ভূখণ্ডে। কারওটা মিডিয়ায় গুরুত্ব পাবে, কারওটা পাবে না। এটাই নিয়ম। নারী এখানে এমনিতেই একবারে তলার শ্রেণির নাগরিক। তাকে চাইলেই ধর্ষণ করা যায়, প্রকাশ্যে বিবস্ত্র করা যায়, পহেলা বৈশাখের উৎসবের মধ্যে হাজার লোকের চোখের উপরে যৌন নির্যাতন করা যায়, ছুরি বসিয়ে দেওয়া যায় শরীরে, চাপাতি দিয়ে কোপানো যায়, মোবাইলে তার আপত্তিকর ছবি তুলে মজা লোটা যায়, আবার সেই ছবি ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দিয়ে দশজনকে সেই মজার ভাগ দেওয়া যায়। আর নারী যদি হয় দরিদ্র, যদি হয় সংখ্যালঘু, যদি হয় আদিবাসী তাহলে তো আরও মজা। তাকে ধর্ষণ করে দুশো মজা লুট। কেউ কিচ্ছু বলবে না। পূর্ণিমার ঘটনা মনে নেই? কত্ত মজা করা গিয়েছিল মেয়েটিকে নিয়ে!
সংখ্যালঘু বা আদিবাসী নারী ধর্ষণের শিকার হলে সেই সমাজের মানুষেরই সোচ্চার হতে হয়, তাদেরকেই মানববন্ধন করতে হয়। সংখ্যাগুরুরা এসব লঘু বিষয় নিয়ে মাথা ঘামাবে না। আর যদি মেয়েটি সংখ্যাগুরুদের একজনও হয় কিন্তু যদি হয় দরিদ্র তাহলেও কেউ তার জন্য মাথা ঘামাতে আসবে না। নারীকে ধর্ষণ তো রাস্তায় থুথু ফেলার মতো সামান্য অপরাধ। চাইলেই করা যায়।
যতদিন না রাষ্ট্র ও সমাজ নারীর উপর নির্যাতন ধর্ষণ যৌন নিপীড়নের ঘটনাকে গুরুত্বপূর্ণ বলে না ভাববে ততোদিন প্রশাসনও এটাকে তুচ্ছ ভাববে। আর সহজ হিসেবে ততোদিন এটা লঘু ঘটনা হয়েই থাকবে। ধর্ষণ বিষয়ে জিরো টলারেন্স মনোভাবের কথা কতবার, কতভাবে বলা হচ্ছে, লেখা হচ্ছে। তবু কারুরই যেন কিছুই আসে যাচ্ছে না। চলছে চলবে এমনি একটি মনোভাবের ভিতর দিয়ে দিন পার হচ্ছে। নারীর উপর নির্যাতন সেকেন্ডারি বা তারচেয়েও কম, একেবারেই গৌণমাত্রার কম গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হিসেবে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় বিবেচিত হয়েছে।
বাগেরহাটের এই সোবহান মোল্লা ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে এক সংঘালঘু পরিবারের গৃহবধূকে ১৫ দিন ধরে আটকে রেখে নির্যাতন চালানোর পরও তাকে খুঁজে পাচ্ছে না পুলিশ। কেন ১৫ দিনের ভিতরেই তাকে গ্রেফতার করা হয়নি? হয়নি কারণ হয়তো ওই পরিবারটিকে ভিটেছাড়া করলে যে সম্পত্তি দখল করা হবে, সোবহান মোল্লার দাপট আরও বাড়বে সেখানে ক্ষমতার দই চিড়ার ভাগ আইনের রক্ষকরাও পাবেন। কিন্তু এইভাবে আর চলতে পারে কি?
ধর্ষণের বিরুদ্ধে, নারীর উপর নির্যাতনের বিরুদ্ধে, যে কোনো মানবাধিকার লংঘনের ঘটনার বিরুদ্ধে সোচ্চার ও গণআন্দোলন গড়ে তুলতে এত দেরি করছি কেন আমরা? আসুন সবাই মিলে অন্তত শহীদ মিনারে জমায়েত হই। মোল্লারহাটের ওই পিশাচটার কঠোর শাস্তি দাবি করে একদিন অন্তত রাজপথে দাঁড়াই না আমরা?
এইসব নরপিশাচদের প্রকাশ্যে ফাঁসি হোক। আমরা (নারী-পুরুষ সবাই মিলে) যদি একটা আন্দোলন করতে পারি ধর্ষণ বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত এবং ধর্ষকদের প্রকাশ্যে শাস্তি না হওয়া পর্যন্ত আমরা কেউ রাজপথ ছাড়বো না তাহলে কি পারবো না কুম্ভকর্ণ প্রশাসনের ঘুম ভাঙাতে?
লেখক : কবি, সাংবাদিক।
এইচআর/এমএস