আ. লীগের সম্মেলন দেশ উন্নয়নের বার্তা আনে
আজ ২২ ও আগামীকাল ২৩ অক্টোবর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সম্মেলন। সর্বত্র সাজসাজ রব। নেতা কর্মীদের মাঝে আনন্দ উল্লাস। সরগরম দলীয় কার্যালয়। সম্মেলনের প্রস্তুতি চলছে রাজধানী থেকে প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত। গণমাধ্যমগুলোও নিয়মিত প্রচার করছে সম্মেলনের খবরাখবর। এ নিয়ে আগ্রহ জেগেছে জনমনে।
তবে অনেকের মনে নানান প্রশ্নও। কে আসছেন নেতৃত্বে? তাতে জনগণের কী লাভ হবে? কিংবা প্রশ্ন খুঁজছে, তাতে দেশের কী মঙ্গল হবে? এমন কিছু প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে এই লেখায়।
আওয়ামী লীগ এদেশের বৃহত্তম প্রাচীন রাজনৈতিক দল। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ১৯৪৭ সালের ২৩ জুন ঢাকার কে এম দাশ লেনের ‘রোজ গার্ডেনে’ এক কর্মী-সম্মেলনের ভেতর দিয়ে আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ করে আওয়ামী লীগ। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী সভাপতি, টাঙ্গাইলের শামসুল হক সাধারণ সম্পাদক এবং জেলবন্দি অবস্থায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অন্যতম যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন।
এর মধ্য দিয়ে অচিরেই আওয়ামী লীগ হয়ে ওঠে পূর্ব বাংলার জনগণের স্বার্থরক্ষাকারী সুসংগঠিত প্রধান রাজনৈতিক শক্তি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবিস্মরণীয় নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক অবদান।
তারপর ধ্বংসস্তূপের মধ্যে দাঁড়িয়ে শূন্য হাতে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকারকে দেশ পুনর্গঠনের কাজে আত্মনিয়োগ করতে হয়। বঙ্গবন্ধুর ক্যারিসমেটিক নেতৃত্ব এবং বিজয়ী জনগণের বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা ও আত্মত্যাগের মনোভাবের কারণে সল্প সময়ে বাংলাদেশ যুদ্ধের ক্ষত মুছে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে। বঙ্গবন্ধু অবিলম্বে একটি পরিপূর্ণ সরকার ও জাতীয় প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তুলে দ্রুততার সঙ্গে দেশ পুনর্গঠনের কাজে মনযোগ দেন।
তারই ফলশ্রুতিতে মাত্র নয় মাসের মাথায় ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসমৃদ্ধ একটি সংবিধান উপহার দেয়। এই সংবিধানের ভিত্তিতে ১৯৭৩ সালের ৮ মার্চ অনুষ্ঠিত হয় স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম অবাধ নিরপেক্ষ সংসদ নির্বাচন। নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে ২৩৯ টি আসনে জয়ী হয়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষের নিরঙ্কুশ সমর্থন লাভ করে।
মাত্র সাড়ে তিন বছরে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ধ্বংসস্তূপ থেকে যুদ্ধোত্তর পুনর্গঠন সম্পন্ন হয়। উন্মোচিত হয় সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত। কিন্তু জাতির দুর্ভাগ্য, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কালরাতে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৩২ নম্বরের ঐতিহাসিক বাসভবনে সপরিবারে নিহত হন। আবারো জাতির বুকে চেপে বসে সামরিক শাসন ও স্বৈরতন্ত্রের জগদ্দল পাথর।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৯০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ দীর্ঘ ১৬ বছর জেনারেল জিয়া ও জেনারেল এরশাদের সামরিক স্বৈরতন্ত্রের যাতাকলে আটকা পড়ে।
১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত করা হয় বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে। এদেশের মানুষের ‘ভোট ও ভাতের’ অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার প্রতিজ্ঞা নিয়ে তিনি মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে ফিরেন নিজ দেশে। দেশে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা জনগণকে ঐক্যবদ্ধ ও সুসংগঠিত করেন।
এরপর ১৯৯৬ সালের ২৩ জুন আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা দিবসে জননেত্রী শেখ হাসিনা প্রথম সরকার গঠন করেন। দীর্ঘ ২১ বছর পর আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় পুনঃপ্রত্যাবর্তনের ফলে পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর সূচিত স্বৈরশাসন, স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী ধারার অবসান হয়। শেখ হাসিনার সরকার জাতীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন।
মাত্র পাঁচ বছরে উন্নয়ন-অর্থনীতি এবং সামাজিক ক্ষেত্রে অর্জিত হয় চমকপ্রদ সাফল্য। জনগণের মাথাপিছু আয় ২৮০ মার্কিন ডলার থেকে বেড়ে ৩৮৬ মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়। বিশ্বসভায় গড়ে উঠে বাঙালি জাতির নতুন দৃশ্য।
২০০১ সালে সংসদ নির্বাচনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং বিএনপি-জামায়াত জোটের যোগসাজশে অভূতপূর্ব কারচুপির মাধ্যমে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের অনিবার্য বিজয় ছিনিয়ে নেয়া হয়। জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকারের পাঁচ বছরের শাসনামলে বাংলাদেশের সামনে যে অমিত সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছিল বিএনপি-জামায়াত জোটের পাঁচ বছরে দুঃশাসনের ফলে সেই সম্ভাবনার অপমৃত্যু ঘটে এবং ‘হাওয়া ভবন’কে রাষ্ট্রক্ষমতায় সমান্তরাল কেন্দ্রে পরিণত করা হয় এবং এটি হয় দেশের সমুদয় দুর্নীতি ও জঙ্গিবাদের প্রসূতি কেন্দ্র।
২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ প্রায় নয়-দশমাংশ আসনে নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে। মূলত এই ফলাফল ছিল বিএনপি-জামায়াত ঐক্যজোট সরকারের দুর্নীতি, লুটপাট, দুঃশাসন ও অগণতান্ত্রিক পন্থায় ক্ষমতায় চিরস্থায়ী করার বিরুদ্ধে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নিরবচ্ছিন্ন আন্দোলন সংগ্রাম এবং নির্বাচনী ইশতেহারে প্রদত্ত ‘রূপকল্প ২০২১’ বা ‘দিন বদলের সনদের’ অঙ্গীকারের পক্ষে গণরায়।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার এবং পরবর্তী ২ বছরের সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়কের চরম অব্যবস্থাপনা থেকে সৃষ্ট গভীর অর্থনৈতিক, সামাজিক, ও রাজনৈতিক সংকট উত্তরণের লক্ষ্যে এই বিজয় বাঙালি জাতির জন্য সম্ভাবনার এক স্বর্ণদুয়ার উন্মোচন করে।
২০২০ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশত বার্ষিকী এবং ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীকে সামনে রেখে এই দিনবদলের সনদ তথা নির্বাচনী ইশতেহারে কেবল পাঁচ বছরের নয়। আগামী ২০২১ সালে আমরা কেমন বাংলাদেশ দেখতে চাই তার একটি রূপকল্প তুলে ধরা হয়।
২০০৯ সালের জানুয়ারী মাসে সরকার পরিচালনার দায়িত্বগ্রহণের পর থেকে সকল একাগ্রতা, বিচক্ষণতা ও লক্ষ্যে পৌঁছার স্থির সংকল্প নিয়ে জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার অর্থনৈতিক উন্নয়নে ঐতিহাসিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে।
সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে উন্নয়ন পরিকল্পনার ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০১০-২০২১ গ্রহণ করা হয়।
নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নে উদ্যোগী হয়। অবকাঠামো নির্মাণে অতীতের সকল রেকর্ড ভেঙে মহাসড়ক ও উড়াল পথ নির্মাণসহ ঢাকায় মেট্রোরেল চালু করার মতো উচ্চাভিলাসী প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। প্রবৃদ্ধির হার ক্রমাগত বৃদ্ধি, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ও ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতি ও বাজেট ঘাটতি হ্রাস, বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভে সর্বোচ্চ রেকর্ড, ঋণ ব্যবস্থার সার্বিক উন্নয়নসহ অর্থনীতিতে এক নজিরবিহীন ইতিবাচক পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়।
বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিতরণ, স্বাস্থ্য, খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি নিশ্চিতকরণ, সামাজিক সুরক্ষা ও জেন্ডার সমতা, ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনে তথ্য প্রযুক্তির ব্যাপক প্রসার, পরিবেশ বিপর্যয়রোধ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাসহ উন্নয়নের সকল ক্ষেত্রে শুরু হয় নতুন কর্মযজ্ঞ।
এই অর্জনের মধ্য দিয়ে ঘোষিত হয় স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বার্ষিকীর বছর ২০২০ সালে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তরিত হওয়ার লক্ষ্য। সারা বিশ্বে বাংলাদেশ হয়ে উঠে উন্নয়নের এক বিস্ময়। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে অতীতের সকল নেতিবাচক উক্তি ও আশংকাকে ভুল ও ভিত্তিহীন প্রমাণ করে জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে বিশ্ব দরবারে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে।
সহস্রাব্দের উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জনে বাংলাদেশের সাফল্য ছিল নজরকাড়া। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনে বাংলাদেশ নতুন প্রতিশ্রুতি নিয়ে অগ্রসর হয়। লক্ষ্য স্থির করা হয় ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে অর্থনৈতিকভাবে উন্নত সমৃদ্ধশালী দেশের সক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করা। শেখ হাসিনার দক্ষ নেতৃত্বে এই রূপকল্প এবং বাস্তবের পথে এগিয়ে যাওয়াকে বিশ্ববাসীও দেখছে অবাক দৃষ্টিতে। স্বীকৃতিও মিলছে একে একে।
২০১৬ সালের মার্চে যুক্তরাষ্ট্রের খ্যাতনামা ম্যাগাজিনের দৃষ্টিতে শেখ হাসিনা বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় প্রভাবশালী নেতাদের তালিকায় দশম স্থানে রয়েছেন এবং ওআইসি সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে তিনিই একমাত্র নারী হিসেবে আখ্যায়িত হয়েছেন।
এবছরই ফোর্বস ম্যাগাজিনের মতে বিশ্বের ক্ষমতাধর শত নারীর তালিকায় রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা ৩৬ নম্বরে স্থান করে নেন। বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেশের অগ্রগতিকে স্বীকৃতি দিয়ে তাঁ হাত ধরে দেশে এসেছে অনেকগুলো আন্তর্জাতিক সম্মাননা। ফলে জাতি হিসেবে আমাদের সবার বিশ্ববাসীর কাছে সম্মানিত করেছেন শেখ হাসিনা।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আস্থা কেবল আওয়ামী লীগের লক্ষ লক্ষ নেতা-কর্মীদের নয়। আস্থা এদেশের সকল মানুষের। আসন্ন সম্মেলনের মাধ্যমে শেখ হাসিনা পুনরায় আওয়ামী লীগের দায়িত্ব নেয়া মানে বাংলাদেশের দায়িত্ব নেয়া। তাই এই সম্মেলন দেশের মানুষের কাছে এতোটা গুরুত্ব বহন করে। এবারের সম্মেলনের ডাক- ‘উন্নয়নের মহাসড়কে এগিয়ে চলেছি দুর্বার, এখন সময় বাংলাদেশের মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার’। উপরে উল্লেখিত আমার কথাগুলো এই আহ্বানের সঙ্গেই যেন মিশে আছে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ২০তম জাতীয় সম্মেলনের সাফল্য কামনা করছি।
এএম
লেখক: ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং সাবেক সংসদ সদস্য।