ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

বিদেশ গমনে ইচ্ছুকদের রপ্তানি নয়, সহযোগিতা করুন

প্রকাশিত: ০৮:৩১ এএম, ১৯ অক্টোবর ২০১৬

সম্প্রতি মালয়েশিয়ায় নতুন করে বাংলাদেশ থেকে লোক পাঠানোর জন্য তৎপরতার কথা দেখতে পাচ্ছি পত্র-পত্রিকায়। আমি লিখেছি `মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ থেকে লোক পাঠানোর` কথা। কিন্তু, লোক পাঠানো সংক্রান্ত ব্যবসায়ি বা এর সাথে সংশ্লিষ্ট সবার প্রচলিত ভাষা হচ্ছে- `শ্রমিক রপ্তানি `। অর্থাৎ বিদেশি শ্রমবাজারে শ্রমিক রপ্তানি। সাধারণত বাজার বলতে বুঝি যেখানে পণ্য বেচাকেনা হয়। বাজারে ক্রেতাদের কাছে পণ্য বিক্রি করেন ব্যাপারীরা। স্থানীয় বা দেশের বাজার ছাড়া বিদেশের বাজারেও আমরা পণ্য বেচাকেনা করি, যেটাকে আমদানী-রপ্তানি বলি। বিদেশে তৈরি পোশাকের বাজারে আমরা তৈরি পোশাক রপ্তানি করি। কিন্তু, বিদেশের শ্রমবাজারে কি রপ্তানি করি? উত্তর হচ্ছে- মানুষ রপ্তানি করি। অর্থাৎ বিদেশি শ্রম বাজারে আমরা যে পণ্য রপ্তানি করি সে পণ্যের নাম-`মানুষ`। এ বাজারে মানুষই পণ্য। হয়ত এ জন্যই এ বাজারে যিনি ব্যবসা করেন তাকে যুগযুগ ধরে আদম ব্যাপারী বলে জানেন সাধারণ মানুষ।

বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে ধারাবাহিক অসামান্য অবদান রাখা প্রধানতম খাত হলো প্রবাসী আয়। এই প্রবাসী আয় উত্তরোত্তর বৃদ্ধিতে এ খাতের নতুন নতুন পণ্য (আদম) রপ্তানিকারক ব্যাপারীদেরও অবদান আছে বলতে হবে অবশ্যই। কারণ ব্যাপারী বা মধ্যস্বত্ব ভোগী না-হলে নতুন কোন মানুষ বিদেশে কাজ করতে যাওয়া সম্ভব না বললেও চলে। যে দেশে আমার সোনার বাংলাদেশের নতুন মানুষটা যাবে সেখানে যদি পূর্ব থেকে তার কোন আত্মীয়-স্বজন না- থাকে তাহলে তাকে ষোল আনাই ব্যাপারীর উপর নির্ভর করতে হয় আল্লাহ ভরসা বলে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রায় যে এক কোটি বাংলাদেশি প্রবাসী রয়েছে এর মধ্যে পেশাজীবী ছাড়া অধিকাংশই সাধারণ শ্রমিক হিসেবে বিদেশে গেছে। বলা যায় অদক্ষ শ্রমিক হিসেবে গেছে। বিদেশে গিয়ে অধিকাংশ বাংলাদেশিরা খুব তাড়াতাড়ি সে দেশের ভাষা শিখে নিয়ে, নিজের কাজ আয়ত্ত্ব করে নিয়ে অনেকেই দক্ষ শ্রমিকে পরিণত হয়। নিজেকে মূল্যবান শ্রমিকে রূপান্তর করে নেয়।

বিদেশে নিজে গিয়ে মোটামুটি স্থির হওয়ার পর অনেকেই নিজের ভাই বা আত্মীয় স্বজনদের ও বিদেশে নিয়ে যায়। কয়েক দশক ধরে এ রকমই হয়ে আসছে। কথা গুলো বলছিলাম শ্রমবাজারে মানুষের `পণ্য` হয়ে ওঠার আলোচনা থেকে। নতুন কোন দেশে যখন বাংলাদেশিদের জন্য শ্রমবাজার উম্মুক্ত হয় বা সৌদি আরব,  আমিরাত, মালয়েশিয়ার মতো দেশে বন্ধ থাকা শ্রমবাজার পূণরায় উম্মুক্ত হয়,  তখন সেখানে কয়েক বছরের মধ্যে কয়েক লাখ নতুন শ্রমিক যায়। এই নতুন শ্রমিকদের মধ্যে যাদের কোন আত্মীয় স্বজন সে দেশে আগে থেকে থাকে না তারা পুরাপুরি পণ্য হয়েই বিদেশ যায়। শ্রমবাজার উম্মুক্ত হলে ব্যাপারীরা তৎপর থাকেন শ্রমিক রপ্তানিতে। যত রপ্তানি তত আয়। নতুন মানুষটিকে যে কাজে পাঠানো হচ্ছে সে মানুষটি কাজটি করার জন্য পারফেক্ট কিনা, চুক্তিপত্রে বেতন যা লেখা আছে তা দিয়ে ঋণ নিয়ে বিদেশে গিয়ে দ্রুত ঋণশোধ করতে পারবে কিনা, আরো কত বিষয়ে বোঝার-জানার থাকে। নতুন বিদেশ যেতে আগ্রহীরা এত কিছু বুঝে না কখনো। ব্যাপারী যে কাজে লোক পাঠানোর সুযোগ পান সে কাজে যে কাউকে ইচ্ছে মতো রপ্তানি করেন। ব্যাপারির দরকার পাসপোর্ট, টাকা আর মানুষের শরীরটা। ভালো-মন্দ এতো কিছু দেখার সময় নেই, ব্যবসার দরকার। লোক রপ্তানি হলেই টাকা।

অন্যদিকে যে মানুষটি স্বপ্ন পূরণের একবুক আশা নিয়ে বিদেশ যেতে চায় সে ওখানে যাওয়ার আগে, কাজ করার আগে কখনও ভাবতেই পারে না বিদেশে প্রথম-প্রথম গিয়ে কি রকম ভোগান্তি পোহাতে হয়, কত কষ্ট লাগে বিদেশে, কত অসহায় লাগে নিজেকে। অনেক সময় পরাধীনতা কারে কয় তাও বোঝা যায় প্রথম বিদেশ গেলে। এ অবস্থায় সে নিজেকে পণ্যই মনে করে। অবশ্যই শত ভোগান্তি সত্ত্বেও এক সময় গিয়ে তেতো হয়ে যায় সে দেশে। ছয় মাস এক বছর দুই বছর হিসেব করতে করতে দশ-বিশ বছর হয়ে যায় বিদেশে। হয়ে ওঠে পরিপূর্ণ মানুষ, অটোমেটিক ভুলে থাকে নিজে রপ্তানি হয়ে বিদেশে আসার কথা।  সদ্য বিদেশে যাওয়া অপরিচিত দুজন বাংলাদেশি যখন পরিচয় হন, তখন আলাপে নিজেদের যিনি রপ্তানি করেছেন তার কথা বলতে গিয়ে দালাল বা ব্যাপারী উল্লেখ করেন। আলোচনা চলাকালীন হঠাৎ যদি কোন একজনের ব্যাপারী সামনে এসে পড়েন তখন অপরজনকে পরিচয় করিয়ে দেন একটা ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করে-`ওনি আমার এজেন্ট ` এই বলে। অর্থাৎ ব্যাপারী সামনে আসলে `এজেন্ট` হয়ে যান। নতুন বিদেশে আসলে সব সময় হাতটা পাথরের নিচে আছে মনে হয়। হয়ত তাই ব্যাপারীকে সম্মান করে ইংরেজি `এজেন্ট` শব্দটা ব্যবহার করার প্রচলন হয়ে গেছে আগে থেকে। অবশ্যই আমার মতো সাধারণ প্রবাসীদের বিদেশ পাঠানোর ক্ষেত্রে শ্রমিক রপ্তানিকারকদের অবদান স্বীকার করতে হবে। অনেক সময় সরকার ও সংশ্লিষ্ট দেশের সাথে তাদের তৎপরতা ও আগ্রহের কারণে নতুন নতুন শ্রমবাজার সৃষ্টি হয় বা বন্ধ শ্রমবাজার উম্মুক্ত হয়। তাই দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধিতে বিশাল অবদান রাখা রেমিটেন্সের জন্য জনশক্তি রপ্তানিকারকদেরও ধন্যবাদ জানাতে হয়।

লেখার শুরুর দিকে মালয়েশিয়ায় নতুন করে শ্রমিক পাঠানোর কথা বলেছিলাম। সেটাই আলোচনা করি- মালয়েশিয়ার বাতাসে যে সব আলোচনা শুনছি তার সার কথা হচ্ছে, মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ থেকে জি টু জি প্লাস পদ্ধতিতে লোক পাঠানো শুরু হলে এতে বিশৃঙ্খলা, অনিয়ম হওয়ার সাম্ভবনা আছে। জনশক্তি রপ্তানিকারকদের মধ্যে দ্বিধাবিভক্তি, সিন্ডিকেট গঠনসহ বিভিন্ন নেতিবাচক তৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারটি রক্ষার জন্য, অনিয়ম রুখার জন্য এ বাজার নিয়ে সরকারের আলাদা তদারকি টিম গঠন করা দরকার। জনগণের কাছে ঘোষণা দিয়ে সরকারি কর্মকর্তার পাশাপাশি এ সংক্রান্ত অভিজ্ঞ বেসরকারি লোককেও অন্তর্ভুক্ত করা যায়। কোন অনিয়ম হলে, বিশৃঙ্খলা হলে তদারক সংশ্লিষ্ট কমিটির দায়িত্ব প্রাপ্ত ব্যক্তি দায়ী থাকবে।

মনে করিয়ে দিতে পারি মালয়েশিয়ার মানুষ বা মালয়েশিয়ার সরকার অভিযোগ কম পছন্দ করেন। অভিযোগ থাকলে অ্যাকশন নিতে দেরি করে না। ২০০৭ সালের কলিং ভিসা ২০০৯ সালের মার্চ মাসে এসে বন্ধ হয়েছিলো অনিয়ম, বিশৃঙ্খলার অভিযোগের কারণে। এতে লাভবান হয়েছিলো মালয়েশিয়া। আর্থিক ক্ষতি হয়েছিলো বাংলাদেশের। ঐ সময় প্রায় ৩৩হাজার লোকের রেডি ভিসা বাতিল করা হয়েছিলো। ৩৩হাজার ভিসার জন্য মালয়েশিয়ায় জমা দেওয়া লেভি (রাজস্ব) আর ফেরত আসেনি। তাই উম্মুক্ত হতে যাচ্ছে বলে প্রচার হওয়া মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার নিয়ে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রাণলায়কে অনেক বেশি সজাগ থাকতে হবে অনিয়ম বিশৃঙ্খলা এড়াতে। জনশক্তি রপ্তানি একটি সেবামূলক ব্যবসা। এ খাতে ব্যবসায়িদের সেবার বিষয়টিতে জোর দিতে হবে। জনশক্তি রপ্তানিকারকদের মনে রাখতে হবে তাদের পণ্যের নাম মানুষ। তাই তারা যেনো অনেক বেশি মানবিক হন। তাহলেই জনশক্তি রপ্তানিকারকদের মঙ্গল, দেশের মঙ্গল, সম্ভাব্য নতুন প্রবাসীর মঙ্গল।

মালয়েশিয়ার বন্ধ শ্রমবাজারটি খোলার (বেসরকারিভাবে লোক পাঠানো) সম্ভাবনা শুরু হয়েছে গত এক বছর ধরে। তখন থেকে জনশক্তি রপ্তানিকারকরা কীভাবে ব্যবসা করবে, কারা ব্যবসা করবে, কত ব্যবসা করবে, কারা ব্যবসা করতে পারবে না এ রকম কত আলোচনা-তর্কবিতর্ক চলছে। ওনাদের সব আলোচনায় ব্যবসা শব্দটা আছেই। আমার কথা হচ্ছে- ব্যবসা অবশ্যই করবেন, তাই বলে শুধু ব্যবসা-ব্যবসা করলে সেবার চিন্তাটা তো হারিয়ে যাবে। একবুক স্বপ্ন নিয়ে বিদেশ যেতে ইচ্ছুক আমাদের দেশের সহজ-সরল মানুষ গুলো যেনো না-ঠকে সে দায়িত্ববোধ জনশক্তি রপ্তানিকারকদের ও এ সংক্রান্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তাদের মনে সদাজাগ্রত থাকুক। জনশক্তি রপ্তানি নয়, বিদেশ গমনে ইচ্ছুকদের প্রতি সহযোগিতার হাত(ন্যায্য লাভের মাধ্যমে) প্রসারিত হোক। শুভ কামনা পরিবারের দায়িত্ব নিয়ে বিদেশগমন ইচ্ছুক বাংলাদেশি ভাইদের জন্য।

লেখক :  মালয়েশিয়াপ্রবাসী।

এইচআর/পিআর

আরও পড়ুন