ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

জলবায়ুর পরিবর্তনে খাদ্য ও কৃষিতে করণীয়

প্রকাশিত: ০৩:১০ এএম, ১৬ অক্টোবর ২০১৬

বছর ঘুরে আবারো ফিরে এলো বিশ্ব খাদ্য দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য বদলে যাচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে খাদ্য এবং কৃষিও বদলাবে- Climate is Changing. Food and Agriculture must too। একেবারেই সময়ের প্রেক্ষিত। গেল বছরগুলোতে জলবায়ুর পরিবর্তনে আমাদের পরিবেশ প্রতিবেশের কি দারুণ পরিবর্তনই না হচ্ছে। শুধু কি পরিবর্তন। ক্ষতি করছে সব। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করছে আমাদের কৃষির। আর কৃষির সাথে খাদ্য তো ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। পরিবেশের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বিভিন্ন মাত্রায় দেখা যায়। গরম কাল আরও তাপময়, ক্ষণিকে আবার হঠাৎ ঠাণ্ডা। অনিয়মিত ও অসময়ে বৃষ্টি, কম সময়ে অধিক পরিমাণে বৃষ্টি এবং এর ফলে সৃষ্ট জলাবদ্ধতা ও ভূমিধস, ভূমি ক্ষয়, শুকনো মৌসুমে কম বৃষ্টিপাত, বন্যার পরিমাণ ও তীব্রতা অযৌক্তিকভাবে বেড়ে যাওয়া, আকস্মিক বন্যা, দীর্ঘায়িত বন্যা ও খরার ফলে ফসলহানি, অতিরিক্ত ঠাণ্ডা ও গরম, উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ত জমির পরিমাণ বেড়ে যাওয়া, নদী তীরবর্তী এলাকার ভাঙ্গন ভূমিক্ষয়, সেচ খরচ বৃদ্ধি ও সুপেয় পানির কম প্রাপ্যতা এসবই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের ফল।

বাংলাদেশ কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির দেশ। অনাদিকাল থেকে কৃষি ও কৃষকের নিষিক্ত আবাহনে বিধৌত এ দেশ। সোদা মাটির গন্ধ, সবুজ শ্যামলিমা, শত নদী ও বিচিত্র ফসলের দেশ বাংলাদেশ। শিল্পায়নের বাতাস যখন উত্তর দিক থেকে দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হলো তখন কার্বনের বিষাক্ত ছোবলে নীল হলো এশিয়ার বিস্তীর্ণ সবুজ প্রান্তর। এ যেন উদোর পিন্ডি বুদোর ঘাড়ে। সংকীর্ণ চিন্তা, আমিত্বের ঘোড়াটোপে আক্রান্ত পৃথিবী সবাইকে নিয়ে ভালো থাকার বদলে বিভাজিত পথে হেঁটেছে অনেক দিনধরে। বর্তমানে কোন দেশের জলবায়ু ও আবহাওয়া পরিবর্তনের মাথা ব্যথা যে একক নয় বরং তা যে বিশ্বব্যাপী তা হালে বুঝতে পেরেছে সবাই। পরিবর্তিত পরিবেশে বিশ্ব খাদ্য নিরাপত্তার প্রশ্নে বিশ্ববাসীর প্রয়োজন কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তার। সুতরাং ভাবতে হবে সবুজ সুন্দর পৃথিবী গড়ার; জলবায়ু পরিবর্তনে কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তাকে এক সাথে মোকাবেলা করার সব প্রচেষ্টা একসাথে চালাতে হবে।

আবহাওয়া ও জলবায়ু বিষয়টা জেনে পরিবর্তনের কথা জানা যাক। আবহাওয়া হলো কোন স্থানের কম সময়ের বা যে কোনো মুহূর্তের বায়ুমণ্ডলীয় অবস্থা। এটি কোন অঞ্চলে ফসলের উৎপাদন ও ফলনে বিশেষ করে কৃষিতে বেশ প্রভাব বিস্তার করে। জলবায়ু কোনো স্থানের দীর্ঘ সময়ের সাধারণত ২৫ বছর বা ততোধিক সময়ের গড় নির্দেশ করে। এটি  কোনো অঞ্চলে ফসলের প্রকার ও জাত নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করে। পরিবর্তিত জলবায়ুতে সবুজ এ পৃথিবী দিন দিন উত্তপ্ত হচ্ছে। বেশিরভাগ গবেষকদের অভিমত একবিংশ শতাব্দীর শেষে পৃথিবীর তাপমাত্রা পরিমাণ হবে এমনি যা গত দেড়লাখ বছরেও বাড়েনি। পরের শতাব্দীতে বিশ্বের তাপমাত্রা আরো ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার বেশিও বাড়তে পারে এবং ভূপৃষ্ঠে পানির উচ্চতা ৮৮ সেন্টিমিটার উঁচু হবে। পৃথিবীতে কার্বনডাই অক্সাইডের পরিমাণ গত ২ কোটি বছরের যে কোন সময়ের চেয়ে বেশি। বর্তমানে বিশ্বের জনসংখ্যার ৩০ জনের মধ্যে ১জন প্রাকৃতিক দুর্যোগ দ্বারা আক্রান্ত হয়। ২০২৫ সনে ৫ হাজার কোটি লোকে এমন সব দেশে বাস করবে যেখানে পানি সরবরাহ বিপদগস্ত হবে।

আগামী ৫০বছরের মধ্যে পৃথিবীর বড় শৈলশ্রেণি সামুদ্রিক উচ্চতাপে নিশ্চিহ্ন হবে। একশ বছর শীতকালীন প্রাকৃতিক অবস্থা এখনকার মতো থাকবে না। আগামী ২শ’ বছরে পশ্চিম কুমেরুর তুষার আচ্ছাদন গলে যাওয়ার সম্ভাবনা ২০ ভাগের মধ্যে এক ভাগ। তা ঘটলে উপকূলীয় নগরগুলো নিউইর্য়ক থেকে লন্ডন এবং অটোয়া থেকে সিডনি পর্যন্ত সব ডুবে যাবে। এশিয়ার গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলের ১০০ কোটিরও বেশি মানুষ ২০৫০ সনের মধ্যে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হবে। কলেরা ও ম্যালেরিয়ার মতো রোগ ছড়িয়ে পড়বে। মানুষের জীবনযাত্রা ও অর্থনীতির ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব হবে সবচেয়ে মারাত্মক। বিশ্বের প্রায় ২.৫ কোটি মানুষ জলবায়ু উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে। জাতিসংঘ মানব উন্নয়ন সূচক অনুযায়ী জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী যুক্তরাষ্ট ৪৪ শতাংশ, জাপান ১৩ শতাংশ, জার্মানি ৭ শতাংশ, যুক্তরাজ্য ৫ শতাংশ, স্পেন, অস্ট্রেলিয়া, কোরিয়া ৩ শতাংশ এবং বাকি ২৮ ভাগ অন্যান্য সবাই মিলে। এ প্রেক্ষিতে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে ইন্দোনেশিয়ার বালিতে জলবায়ু বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এর পোশাকি নাম কনফারেন্স অব পার্টিস অব দ্য ইউএন ফ্রেম ওয়ার্ক কনভেনশন অন ক্লাইমেটিক একচেঞ্জ। কিয়েটো সম্মেলনের একমাত্র সাফল্য হলো ২০০৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্টকে সংলাপে বসানো কার্বনমুক্ত বিশ্ব গড়তে।

পরিবর্তিত জলবায়ুতে বাংলাদেশ বিশ্ব জলবায়ুর এ পরিবর্তনে বাংলাদেশ সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। আগামী কয়েক দশকের মধ্যে ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস এর বেশি উঞ্চতা বাড়বে এবং ৪৫০ সেন্টিমিটার এর বেশি সমুদ্রস্ফীতির মুখোমুখি হবে। তখন এদেশ স্থায়ীভাবে প্লাবিত হবে এবং লবাণাক্ততা বৃদ্ধির কারণে দেশের উপকূলীয়, নিম্নাঞ্চল অর্থনৈতিক উপযোগিতা হারাবে। জলবায়ুর এ পরিবর্তনে বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে খরাপ্রবণ এলাকায় খরার প্রকোপ আরো বাড়বে। শুধু তাই না সুন্দরবনও সাংঘাতিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ হবে। পরিবর্তিত এ পরিস্থিতিতে আগামী ২০৫০ সনে বাংলাদেশের এক-পঞ্চমাংশ সমুদ্রগর্ভে তলিয়ে যাবে। বর্তমানে গরমকালে প্রচণ্ড তাপদাহ এবং শীতকালে শীতের তীব্রতা এ দেশের আবহমান আবহাওয়ার পরিবর্তনের ইঙ্গিত বহন করছে। পঞ্চগড়ে ১০-১২ বছর ধরে অস্বাভাবিক শীতের তীব্রতা বেড়ে যাওয়ায় ধানে পোকার আক্রমণ বেড়েছে। শ্রীমঙ্গল এলাকায় বৃষ্টিপাত বেড়ে যাওয়ায় রবিশস্যের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। অতীতে এদেশে প্রায় ৮ হাজার প্রজাতির ধান উৎপাদিত হতো। এখন ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হচ্ছে। আগামী ৫০ বছরে ধানের উৎপাদন ১ দশমাংশ কমার আশংকা করেছেন বিশেষজ্ঞরা। এভাবে বিলুপ্ত হতে পারে আলুর বিভিন্ন প্রজাতির এক চতুর্থাংশ।

এছাড়া ২০ শতাংশের বেশি মাছের প্রজাতির অস্তিত্বও হুমকির মুখে পড়বে। বাংলাদেশের মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাবে ১৭ টি নদী। ড. আইনুন নিশাতের মতে জলবায়ু পরিবর্তনের লক্ষণগুলো হলো- বর্ষায় বৃষ্টিপাত কম হওয়া, সঠিক সময়ে না হওয়া, সঠিক সময়ে শীত শুরু না হওয়া, শীতের প্রকোপ কমে যাওয়া, শীতকালের দৈর্ঘ্য কমে যাওয়া, প্রতি বছর তাপমাত্রা অল্প করে বেড়ে যাওয়া, আগাম পানি আসা, পানির চাপ বাড়া। এছাড়া এসআরডিআই’র রিপোর্টে ১৯৭৩ থেকে ২০০০ সন পর্যন্ত উপকূলীয় অঞ্চলের প্রায় ১৭ লাখ হেক্টর জমি নতুন করে লবাণাক্ততা দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে যা মোট আবাদী জমির মতকরা ২০.৪ ভাগ। পরিবেশ বিজ্ঞানী ড. জহুরুল হকের মতে তাপমাত্রা ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লে বাংলাদেশে গমের উৎপাদন প্রায় বন্ধ হয়ে যাবে। আলু ও শীতকালীন ফসলের ফলনে ধস নামবে। ২০৩০ সনের বাংলাদেশের জলবায়ুর অবস্থা দাঁড়াবে গরমকালে তাপমাত্রা ০.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যাবে এবং শীতকালে ১.৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস কমবে, গরমকালে বৃষ্টিপাত বাড়বে শতকরা ১১ ভাগ কিন্তু শীতকালে কমবে শতকরা ৩ ভাগ, গরমকালে বাষ্পীভবন বাড়বে শতকরা ১৫.৮ ভাগ এবং শীতকালে বাড়বে শতকরা ০.৯ ভাগ।

পরিবর্তিত জলবায়ুতে বাংলাদেশের কৃষিতে ফসল উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে এবং হুমকির মুখে আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা। কৃষি বিশেষজ্ঞদের মতে বীজের গজানো, পরাগায়ন, ফুল ও ফল ধরা, পরিপক্বতা হতে সুনির্দিষ্ট তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, বৃষ্টিপাত ও সূর্যালোক প্রয়োজন। জলবায়ুর এ উপাদানগুলো পরিবর্তিত হয়েছে কিন্তু বীজ বপন ও চারা রোপণের সময় পরিবর্তন সম্ভব হয়নি। ফলে কৃষি মৌসুমের সাথে ফসল চাষাবাদ খাপ খাওয়ানো যাচ্ছে না। গড় তাপমাত্রা বাড়ার কারণে গম, ছোলা, মসুর, মুগ ডালসহ কিছু কিছু ধানের উৎপাদন কমে যাওয়ায় কৃষকরাও মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। গমের বীজ গজানোর তাপমাত্রা হলো ১৫-২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর কম বেশি হলে বীজ গজাবে না। গম পাকার সময়ে আর্দ্রতা বেশি ও ঘন কুয়াশা থাকলে ব্লাক পয়েন্ট রোগ হবে, ফলনও কম হবে। পাট ও বোরো ফসলের ফলনও কমে যাবে মারাত্মকভাবে। টাস্কফোর্স রিপোর্ট থেকে জানা যায় সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা ২০৫০ সন পর্যন্ত ১মিটার বাড়তে পারে। এর প্রভাবে ৩ হাজার মিলিয়ন হেক্টর উর্বর জমি স্থায়ীভাবে হারিয়ে যাবে, ২ মিলিয়ন টন ধান, গম, আখ, পাট, মটরসহ রবিশস্য উৎপাদন কমে যাবে। ব্রি’র মতে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে। ধানে রোগ ও পোকার আক্রমণ হচ্ছে। কৃষকরা আবহাওয়া বুঝতে পারছে না। বৈশ্বিক উঞ্চায়নের কারণে বৃষ্টিপাত বেড়ে যাবে এবং বর্তমান শতাব্দীতে বাংলাদেশে বন্যার পরিমাণ ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে।

জলবায়ুর পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় ইস্যু খাদ্য নিরাপত্তা। এ পৃথিবীর গরীবদের মধ্যে আছে কৃষক, জেলে এবং গবাদিপশু পালনকারী। এরাই পরিবর্তিত জলবায় বা প্রাতকৃতিক দুযোগের শিকার হয় বেশি। কেননা এরাতো নুন আনতে পান্তা ফুরানোর দলের মানুষ। এদের না আছে থিত নাছে ভিত। এরা বড় অসহায়। এরমধ্যে জনসংখ্যা বাড়ার প্রবণতা এগিয়েই চলছে। তথ্য বলে আগামী ২০২৫ সাল নাগাদ পৃথিবীর জনসংখ্যা দাঁড়াবে ৯.৬ বিলিয়নে। এ বাড়তি জনসংখ্যার দুমুঠো খাদ্য যোগানে বৈরি পরিবেশ আর অবস্থার মধ্যেও ব্যস্ত থাকতে হবে কঠিনভাবে। আমাদের উৎপাদনশীলতা আর স্থায়ীত্বকে যদি সঠিকভাবে ধরে না রাখা যায় তাহলে অবস্থা বেগতিক হয়ে যাবে যেকোন সময়। সুতরাং সবার আগে ভাবতে হবে পরিবেশ প্রতিবেশ আর নির্ভেজাল বাঁচার সমীকরণ নিয়ে। একথাতো ঠিক দিনদিন আমাদের আবাদি জমি কমছে আতংকিত হারে। আর খাদ্য চাহিদা বাড়ছে জ্যামিতিক হারে।

এ অসম সমীকরণে আমাদের খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থাকে ঠিক রাখার জন্য আামদের বহুমুখি সম্মিলিত কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। খাদ্য উৎপাদনক ট্রেন্ডকে ঠিক রেখে সব ধরনের এবং সব পর্যয়র অপচয় রোধ করতে হবে যৌক্তিকভাবে। নৈতিকতা, নীতি উৎপাদন, ব্যবস্থাপনা, কর্তন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, পরিবহন, বিপণন, অবকাঠামো সবখানেই সমানভাবে গুরুত্ব দিতে হবে কাক্ষিত মাত্রায়। সে কারণেই বিশ্ব খাদ্য সংস্থা এবারের প্রতিপাদ্যের মাধ্যমে জানান দিচ্ছে পৃথিবী বদলে যাচ্ছে, সুতরাং বদলাচ্ছে আমাদের সব কিছু। বিশেষ করে আমাদের কৃষি আমাদের খাদ্য। সে প্রেক্ষিতে আমাদের কার্যবকর ব্যবস্থা নিতে হেব দেরি না করে। এর ফলাফলের ওপর ভিত্তি করেই আগামী ৭-৮ নভেম্বর ২০১৬ মরক্কোতে জাতি সংঘ আয়োজিত জলবায়ুর পরিবর্তন শীর্ষক করফারেন্স (সিওপি) অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। সে জন্য এফএও সারা পৃথিবীর সবকটা দেশকে বলছে পরিবর্তিত জলবায়ুভিত্তিক পরিকল্পনায় গ্রামীণ উন্নয়ন আর সমৃদ্ধির জন্য বেশি বেশি কার্যকর কর্মসূচি সংযুক্ত করতে হবে।

ক্ষুদ্র প্রান্তিক কৃষকদের যে কোন পরিস্থিতিতে সহায়তা ও সহযোগিতার মাধ্যমে তাদের সক্ষমতাকে আরো সুদৃঢ় শক্ত সময়োপযোগী করতে হবে। তখনই আমাদের খাদ্য নিরাপত্তার নিশ্চিয়তা দেয়া যাবে অনায়াসে।  জলবায়ুর পরিবর্তনে আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর যে ঋণাত্মক প্রভাব পড়ছে বা পড়বে। এফএও মনে করে আগামী ২০৫০ সাল নাগাদ পুরো পৃথিবীর মানুষকে দুবেলা খাওয়াতে হলে আমাদের সবার খাদ্য উৎপাদন ৬০% হারে বাড়াতে হবে। সুতরাং সেভাবেই আমদের কাজ করে যেতে হবে নিরবচ্ছিন্নভাবে। ২০৩০ সাল নাগাদ আমারা আমাদের পৃথিবীকে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত রাখবো সে মোতাবেক আমদের পরিবর্তিত জলবায়ুর কথা মাথায় রেখে যথোপযুক্ত পরিকল্পনা কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে এবং তার কার্যকর বাস্তবায়ন কতে হবে সবাই মিলে সর্বোতভাবে।

সর্বোচ্চ গুরুত্বের সাথে আমাদের সম্মিলিতভাবে ভাবতে হবে পরিবর্তিত জলবায়ুতে আমাদের বিভিন্ন আঙ্গিকে করণীয় কি। এর সাথে আমাদের ক্ষুদ্র প্রান্তিক কৃষকদের সার্বিক কল্যাণে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে। বিশেষ করে খাদ্য উৎপাদন চক্রের প্রতিটি পর্যায়ে আমাদের গুরুত্ব দিতে হবে। যে করেই হোক চাহিদা মতো উৎপাদন, প্রয়োজন মতো পুষ্টিসম্মত খাদ্য গ্রহণ এবং পরিবেশ ঠিক রেখে সব কাজের সুষ্ঠু সমন্বয় করা। তবেই আমারা আগামী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে পারবো অনায়াসে। আমাদের প্রাণের পৃথিবী দিনদিন উষ্ণময় হচ্ছে। বরফ গলে নদী সাগরে মিশছে, নদী সাগরের পানির উচ্চতা বাড়ছে কেবলি। এরই সাথে বন্যা, খরা, ঘুর্ণিঝড় ধেয়ে আসছে প্রতিনিয়ত। এ কারণে দুটো জিনিস বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে। ০১. যারা গরীব কৃষক তাদের উৎপাদন আর যাপিত জীবনের ওপর যারা অন্ন যোগায় খাদ্যে জন্য আর ০২ হচ্ছে ২০২৩০ সাল নাগাদ ক্ষুধাকে নির্মূল করার কাজে আঘাত হানছে। এরই মাঝেও সুখের খবর আছে। এখনো আমরা আমাদের সাহায্য সহযোগিতা করতে পারি। খাদ্য অপচয়, বনায়নকে আরো বিস্তৃত করা। আমাদের উৎপাদনের মূল আধার জমি ও পানিকে দুষণ মুক্ত রেখে আগামীর পথে এগিয়ে যাওয়া।

এ প্রেক্ষিতে আমরা কি করতে পারি? পারি সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে পরিবর্তিত জলবায়ুতে অভিযোজিত কার্যক্রম ও কৌশলের সুষ্ঠু বাস্তবায়ন করতে। আমাদের প্রাণের পৃথিবী আমাদের বেঁচে থাকার যাবতীয় রসদ যোগায় আমাদের বাঁচিয়ে রাখে প্রতিনিয়ত তার অযুত অবারিত সম্পদের মাধ্যমে। পৃথিবী তার মাটি জল বাতাস দিয়ে আমাদের উৎপাদনকে সহজতর করে দেয়। যদি এর ব্যতিক্রম হয় পানি দুষিত হয়, মাটি দূষিত হয়, বাতাস দূষিত হয় তাহলে আমরা কোনদিন কোনকালে আমাদের কাক্ষিত খাদ্য উৎপাদন করতে পারবো না। সুতরাং এখনো সময় আছে পৃথিবীর জমি জলকে দূষিত না করে বিশুদ্ধ রেখে আমাদের মমতা আর আন্তরিকতা দিয়ে সুন্দর পরিবেশবান্ধব রাখা। তবেই ধরিত্রী আমাদের সহায়তা হাত প্রসারিত করবে অবারিত।

জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে আমাদের কৃষিও খাদ্যে ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। আমরা আমাদের স্বাভাবিক ট্রেন্ড নিয়ে কৃষিকে আর খাদ্য নিয়ে পরিকল্পনা, উৎপাদন, ব্যবস্থাপনা, প্রক্রিয়াজাতকরণ, বিপণন, সংরক্ষণ এসব করতে পারছিনা। এ জন্য বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থা বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করছে বা করার পরিকল্পনা করছে। কিন্তু অধিকাংশ কার্যক্রমই পাইলট আকারে গুটিকয়েক জেলা বা উপজেলায় বিস্তৃত এবং একটি সংস্থার সাথে আরেকটি সংস্থার কাজের কোন সমন্বয় নেই। এ ক্ষেত্রে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাধ্যমে কৃষি ক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিভিন্ন খাপ খাওয়নোর কলাকৌশল সম্প্রসারণ করা যেতে পারে। কারণ এ প্রতিষ্ঠানটির মাঠ পর্যায় পর্যন্ত প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো আছে যা অন্য কোন সংস্থার নেই। বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে এটা বলা যায় যে ব্যাপক ও সমন্বিত কার্যক্রম গ্রহণ করলে আমাদের দেশের দরিদ্র চাষিরা উপকৃত হবে তথা দেশ উপকৃত হবে। আমরা সক্ষম হব জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলা করে পরিবর্তিত জলবায়ুতে কৃষি ও খাদ্যকে টিকিয়ে রাখতে।

পরিবর্তিত জলবায়ুতে কৃষি ক্ষেত্রে খাপ অভিযোজন কলকৌশল
০১. লবণাক্ততা সহনশীল জাতের উন্নয়ন ও এর আবাদ এলাকা বাড়ানো, ফসলের চাষ, চিংড়ি চাষ, দ্রুত ও গভীর চাষের মাধ্যমে মাটির ক্যাপিলারি নালিকা ভেঙ্গে দিয়ে লবণাক্ততা কমানো। এ জন্য পাওয়ার টিলার দিয়ে চাষাবাদের এলাকা বৃদ্ধি করলে এ সুবিধা পাওয়া যাবে; আমন মৌসুমে বিআর ২৩, ব্রি-ধান ৪০ এবং ৪১ এর চাষ। বোরো মৌসুমে লবণাক্ততা সহনশীল জাতের চাষ;

০২. চাষ পদ্ধতির পরিবর্তন, পানি কম লাগে এমন ফসলের চাষ, মালচিং ও ড্রিপ সেচের প্রবর্তন, এসআরআই পদ্ধতি অনুসরণ, অল্পচাষ বা বিনা চাষে উৎপাদন পদ্ধতিকে উৎসাহিত করে উপযোগী ফসলের চাষ করতে হবে, খরা সহিঞ্চু স্থানীয় জাতের উন্নয়ন ও এর আবাদ এলাকা বাড়ানো। দামী সবজি জাতীয় ফসল টমেটো, তরমুজ, শসা, মরিচের চাষ। মিনি পুকুর, প্লাস্টিক পাইপ/ফিতা পাইপের ব্যবহার বাড়ানো। আইল উঁচু করে চাষ করা। খরার কারণে ধান লাগাতে বেশি দেরী হলে নাবি ও আলোক সংবেদনশীল বিআর ২২,২৩ ও ব্রি-ধান ৪৬ এর চাষ করা। আউশ মৌসুমে বিআর ২৪, বিআর ২৬, বিআর  ২৭, ব্রি ধান৪২ ও ব্রি ধান৪৩ আবাদ করা। আমন ধান কাটার পরে খরা সহনশীল ফসল যেমন- ছোলা চাষ করা যায়। তেল ফসল হিসেবে তিলের চাষ করা যায়। এছাড়াও মাটির গভীরে বীজ বপন, পূর্বে ভিজানো বীজ বপন, মিতব্যয়ী পদ্ধতিতে পানি সেচ, সম্পূরক সেচের ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে খরা মোকাবেলায় কার্য্যকরী পদক্ষেপ নেয়া যায়;

০৩. ক. আগাম ঢল বন্যাপ্রবণ এলাকায় স্থানীয় ও উফশী জাতের আগাম পাকা ও স্বল্প মেয়াদের বোরো চাষাবাদ ক্ষয়ক্ষতি অনেকটা কমিয়ে আনতে পারে। প্রচলিত জাতের চেয়ে আগাম পাকে এমন ফসলের জাত চাষ, যেমন-ব্রি-ধান ২৯ এর চেয়ে ব্রি-ধান ২৮ পনের দিন আগে কাটা যায়। শিষ পাকা পর্যায়ে ব্রি ধান ২৯ ও ব্রি ধান৩৬ এর জলমগ্নতা সহ্য করার ক্ষমতা আছে। এছাড়াও ব্রি ধান৪৫ চাষ করা যায় যার জীবনকাল ১৪০ থেকে ১৪৫ দিন। গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে ব্রি-ধান২৯ এর ২০-৩০ দিন বয়সের চারা সঠিক সময়ে (১৫-৩০ কার্তিক) রোপণের মাধ্যমে এর জীবনকাল ১৫ দিন কমিয়ে আনা সম্ভব। স্থানীয় জাতের পশুশাইল যথেষ্ট ফলন দিতে সক্ষম।

খ. ভাসমান ধাপে ফসলের/সবজির চাষ। বন্যা পরবর্তী সময়ে নাবী জাতের ধান যেমন- নাইজারশাইল, বিআর-২২ ও ২৩ এবং ব্রি-ধান ৪৬ চাষ করা। দাপোগ পদ্ধতির বীজতলা তৈরি। বন্যা পরবর্তী সময়ে বেশি বয়সের চারা ঘন করে লাগানো যেতে পারে।

গ. বন্যা মোকাবেলা সক্ষম ধানের পাশাপাশি সবজি ও অন্যান্য ফসলের চাষ করা সম্ভব। ফ্রেঞ্চ শিম, মুলা, আলু, পেয়াঁজ, রসুন, মিষ্টিকুমড়া, লালশাক, করলা, চাল কুমড়া, পালংশাক, পুঁইশাক, মটরশুটি এসব চাষ লাভজনক বলে প্রমাণিত হয়েছে।

০৪. কালবৈশাখী, ঝড়/শিলাবৃষ্টিতে বোরো ধান ক্ষতিগ্রস্ত হলে দ্রুত আউশধান বা সবুজসার প্রয়োগ করার পর রোপা আমন ধান চাষ করতে হবে। এতে অধিক ফসল নিশ্চিত করার পাশাপাশি বোরোর ক্ষয়ক্ষতি আংশিক পূরণ করা যেতে পারে। ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার ক্ষতির প্রকৃতি, এলাকার মাটি বা ভূপ্রকৃতি ও আর্থ-সামাজিক অবস্থার আলোকে জলোচ্ছ্বাস পরবর্তী ফসল চাষে ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে আউশ মৌসুমে উফশী রোপা আউশ যেমন: বিআর ১৪, বিআর ৯, বিআর ২০, বিআর ২১, বিআর ২৬, ব্রি ধান২৭, ব্রি ধান২৮, ব্রি ধান৪৫ এর ১ মাস বয়সী চারা বৈশাখ মাসের মধ্যে রোপণ করতে হবে। আমন মৌসুমে নাবী- আমন জাত যেমন: বিআর ২২, বিআর ২৩ এর এক মাসের অধিক বয়সী চারা ভাদ্র আশ্বিন মাসের মধ্যে রোপণ করতে হবে-

০৫. তাপমাত্রা সহনশীল ফসলের জাতের চাষ করা; ৬/ নতুন শস্য পর্যায়ের ওপর ব্যাপক গবেষণা জোরদার করা;৭/ বালাইসহনশীল ফসলের চাষ করা। বালাই প্রতিরোধী জিএমও ফসলের চাষ; ৮/ বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিতে হবে। ভূ-উপরিস্থ পানির ব্যবহার বাড়ানো; ৯/ আবহাওয়ার সব তথ্য ক্ষতিপ্রবণ ও আশংকাজনক এলাকাসমূহে আগাম জানানোর মাধ্যমে ফসল চাষের পরামর্শ প্রদান; ১০/ নতুন শস্য পর্যায় উদ্ভাবন করা এবং এর ব্যাপক প্রচলন করা।

লেখক : কৃষিবিদ, উপপরিচালক (গণযোগাযোগ), কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা

এইচআর/এমএস

আরও পড়ুন