এই সমাজে খাদিজারা কী করে বাঁচে?
খাদিজার জন্য আমাদের মায়াকান্নার শেষ নেই। কেউ উৎকণ্ঠায়, কেউ উদ্বিগ্নতায়, কেউবা আহা উহু করছি। ইশ, মেয়েটাকে অমন করে কোপালো? কি করে পারলো? আর সবাই আবেগাপ্লুত, বিস্মিত, হতবাক, বিহ্বল হলেও আমি নই মোটেও। আমি একটুও অবাক হইনি, বিস্ময়বোধের প্রয়োজনও বোধ করিনি। কারণ, সে সমাজ আমরা তৈরি করেছি, করছি তাতে খাদিজাদের কোপ খাওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়, স্বাভাবিক ঘটনা খুবই। বলতে বাধ্য হচ্ছি, ‘আহা উহু’ করা স্রেফ মায়াকান্না ছাড়া আর কিছু নয়।
অমন ঘটনা কি প্রথম ঘটেছে? না ঘটেনি। মনে আছে জুলেখা এবং মায়ার কথা? জুলেখা ১৭, মায়া ১৪। একজন কিশোরগঞ্জের, অন্যজন সিরাজগঞ্জের। দূরত্ব যতই থাকুক, অপমান, অসম্মান, বেদনা, যন্ত্রণার নৈকট্যে দুজন একই। প্রেমের নামে অশ্লীল উৎপাত, উৎপীড়নে দুজনই আত্মহত্যা করেছিল। খুবতো আগের নয়, ঘটনা ২০০৯ সালের।
মনে পড়ে সিমির কথা? সিমি চারুকলার মেয়ে। ২০০১ সালে বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে সিমি আত্মহত্যা করেছিল। চিরকুটে লিখেছিল, ‘আমার জন্য কোনো বিচার হলো না। তা হোক, কিন্তু আমার মতো অন্য কিছু মেয়ের জন্য আমি নিজে এভাবে প্রতিবাদ করলাম। ভবিষ্যতে যাতে কোনো মেয়েকে এভাবে মরতে না হয়, আমার মতো জঘন্যতম অপমানিত হয়ে।’ সিমির পর মহিমা, রুমী, তৃষ্ণা আরো অসংখ্য নাম, কেউ ঝাঁপ দিয়েছে, কেউবা শূন্যে ঝুলেছে নেহাত পুরুষের অসভ্য উৎপীড়নে। যদি আরো নাম বলতে চাই, এ তালিকা আরো দীর্ঘতর হবে। কজনের বিচার করেছি, শাস্তি দিয়েছি আমরা এ পর্যন্ত। ঘটনার সংখ্যায়, বিচার ও শাস্তির সংখ্যা দেখা যাবে নেহাত নগণ্য।
নারী-পুরুষ সকলে মিলে এক উৎকট, পুরুষতান্ত্রিক সমাজ তৈরি করেছি। নারী অপুরুষতান্ত্রিক, এমন ভাবার কারণ নেই কোনো। এখানে নারীরাও বীভৎস পুরুষতান্ত্রিকতায় ভোগে। পুঁজিবাদ এই পুরুষতান্ত্রিকতাকে আরো উসকে দিচ্ছে। এখনো মেয়েরা অন্যের অধীন, এখনো একা মেয়ে মানে মন্দ মেয়ে, এখনো কালো মেয়েরা অপয়া যে সমাজে, সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র আর যৌনযন্ত্র যেখানে, সেখানে নারী নিগৃহীত হবে না তো হবে কোন সমাজে?
বদরুল দেখেছে এখানে দিনে দুপুরে ধর্ষণ করলে, এসিড ছুড়লে, মেয়েদের গায়ে পেট্রল ঢাললে, আগুনে পোড়ালে, পাথর ছুড়লে, ইঁদুরপেটা করলেও যায় আসে না কিছু, পার পায় অনেকে। সমাজে হামেশাই কোপাকুপি হচ্ছে, এ দল ও দল, এ মত ও মত। বদরুল তাই চাপাতি তুলে নিয়েছে। যে বদরুল খাদিজাকে কুপিয়েছে, অনেকেই বলছে সে তাকে ভালোবাসতো। প্রেমে প্রত্যাক্ষিত হয়ে অমনটি করেছে। যারা বলছে তারা ভুল বলছে, ভুল বকছে। প্রেম সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণা তাদের নেই। খুন আর প্রেম কখনো এক হতে পারে না। খুনি আর প্রেমিক কখনো এক নয়। প্রেম মানেই তো এই নয়, কাউকে হাতের মুঠোয় পেতে হবে। ভালো কাউকে লাগতেই পারে। ভালোলাগা, ভালোবাসতে চাওয়া দোষের কিছু নয়। তুমি শুধু আমার অথবা আর কারো নও- এমন মানসিকতা আর যাই হোক ভালোবাসা নয় কখনও। বিশ্বাস হয় না বদরুলের প্রেম ছিল খাদিজার প্রতি, হয়তো বিকৃত কাম ছিল। অবদমিত বাসনা ছিল, যৌন লালসা ছিল, লকলকে জিহ্বা ছিল খাদিজার প্রতি।
আর যাই হোক তা ভালোবাসা নয়, প্রেম নয়। বদরুল কোনো প্রেমিক নয়, নেহাত খুনি। খাদিজা তার হাত থেকে ছুটতে চেয়েছে, বাঁচতে চেয়েছে, রেহাই পেতে চেয়েছে পারেনি। বদরুল তাকে টেনেহিঁচড়ে এনে, কুপিয়েছে এলোপাতাড়ি। খাদিজাকে তো সে খুনই করতে চেয়েছে। ভালোবাসা যদি সত্যিই কারো প্রতি থাকে কারো, সে তাকে কখনো আঘাত করতে পারে না শারীরিক, মানসিক কোনোভাবেই। সত্যিকারের ভালোবাসা কেবল ভালোবাসতেই জানে। কোনো প্রতিদান চায় না, প্রত্যাশা করে না, কেবল দিতে জানে অকাতরে।
সমাজ উল্টোপথে হাঁটছে। বড় বড় সুউচ্চ ভবন, নতুন মডেলের গাড়ি, পশ রেস্তোরাঁ, কফিশপ, ফ্যাশন হাউজ দেখে ভাবার কোনো কারণ নেই-খুব আধুনিকতার হাওয়া বইছে। আধুনিকতা চিন্তায়, বিজ্ঞানমনষ্কতায়, যুক্তিবাদে, জ্ঞানচর্চায়, মানবিকতায়। মেয়েদের আড়ালে রেখে, খোঁয়াড়ে ভরে, বোরকা-হিজাব পরিয়ে, এগিয়ে যাবে সমাজ- ভুল। অনেককেই বলতে শুনি, মেয়েরা বোরকা-হিজাব পরলে নিরাপদ। পুরুষের অন্যদৃষ্টি থেকে, লালসা থেকে নিরাপদ থাকবে, নয়তো আক্রমণের শিকার হবে মেয়েরা। বোরকা-হিজাবমুক্ত নারী দেখলেই যদি পুরুষের অন্যদৃষ্টি, লালসা এসে ভিড় করে মনের কোণে তাহলে সমস্যা তো নারীর নয়, পুরুষেরই। পত্রিকায় খাজিদার যে ছবি দেখেছি তাতে তো তাকে যথেষ্ট পর্দানশীল বলেই মনে হয়েছে। বোরকা-হিজাব পরা খাদিজা। কোথায়, সে তো পুরুষের অশ্লীল আক্রমণ থেকে রেহাই পায়নি। তনুও তো বোরকা পরতো, হিজাব পরতো, ধষর্ণের হাত থেকে রেহাই পায়নি তনুও।
বিষয় বোরকা, অবোরকা নয়, বিষয় মানবিক মূল্যবোধ। মানসিকতা, মানুষের প্রতি সম্মান, প্রেম, ভালোবাসা। প্রধানমন্ত্রী যথার্থ বলেছেন, ‘দেখলাম মানুষ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে আর মোবাইলে ভিডিও তুলছে। অথচ কেউই মেয়েটিকে বাঁচাতে এগিয়ে গেল না। চেষ্টাও করলো না। একটা লোক কোপাছে আর এতগুলো লোক দাঁড়িয়ে দেখছে। তারা কি একজোট হয়ে ওই লোকটিকে ধাওয়া দিতে পারতো না? মেয়েটিকে রক্ষা করতে পারতো না?’
আসলেই তাই। যারা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খাদিজাকে কোপানোর দৃশ্য ভিডিও করেছে, তাদের অপরাধ বদরুলের চেয়ে কম নয়। তাদের অনেকেরই মানসিক সমর্থন রয়েছে এই নৃশংসতায়, বীভৎসতায়। ফেসবুক, ইউটিউব জুড়ে হাজারো ভিডিও। যৌন হয়রানির, ধর্ষণ চেষ্টার, নারী নিগ্রহের। এক ধরনের বিকৃত আনন্দ রয়েছে, বোঝা যায় যারা এসব ভিডিও করেছে, দেখে। এসব ভিডিও ইউটিউব চ্যানেলে দেদারসে রমরমা ব্যবসাও করছে।
পুঁজি ও পুরুষতান্ত্রিকতা একে অপরকে জড়াজড়ি করে সুখ দিচ্ছে, অসুখ তৈরি করে সমাজে। তারই ফসল এইসব বদরুল। অনেকে অনেক পরিচয় দেবার চেষ্টা করেছে বদরুলের, কিন্তু এসব বিকৃতকাম, সাইকোপ্যাথ বদরুলদের কোনো পরিচয় নেই। এরা বিচ্ছিন্ন, পরগাছা, নোংরা কীট। হাত পাসর্বস্ব অমানুষ মাত্র।
লেখক : সম্পাদক, আজ সারাবেলা। ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, মিডিয়াওয়াচ। পরিচালক, বাংলাদেশ সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট জার্নালিজম অ্যান্ড কমিউনিকেশন। সদস্য, ফেমিনিস্ট ডটকম, যুক্তরাষ্ট্র।
[email protected]
এইচআর/এমএস