সহিংসতার বৃত্তের বাইরে
বদরুলের উপযুক্ত শাস্তি, খাদিজার সুস্থতা সব মানুষের চাওয়া এখন। কিন্তু সুস্থ হয়ে উঠলেও স্বাভাবিক জীবন আর খাদিজা পাবে কিনা জানা নেই। কিন্তু বাংলাদেশের নারীরা জানলো, যত কুলাঙ্গারই হোক পুরুষের প্রেমের আহ্বান ফিরিয়ে দিলেই বীভৎস আক্রমণ।
একটি মেয়ের স্বাধীন ও সহজ জীবনযাপনের অন্যতম শর্ত— তার শরীরটিকে কীটদংশন থেকে বাঁচিয়ে রাখা। কিন্তু সেটিই অসম্ভব হয়ে পড়ছে বদরুলদের জন্য। বদরুল কুপিয়েছে, কেউ অ্যসিড মারে, কেউ ধর্ষণ করে। বাংলাদেশের সমাজ এখন আর সম্পূর্ণভাবে পুরুষতন্ত্র ও তার ধ্বজাধারীদের কবলে নেই। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে মানুষকে লিঙ্গপরিচয়ের ঊর্ধ্বে দেখার চোখ তৈরি হচ্ছে। কিন্তু এসব কাণ্ড বলে দেয় নারীকে হেয় করে দেখে যে সমাজ, তার ব্যাপকতার তুলনায় এই ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি অতি ক্ষুদ্রপরিসরে বিরাজমান।
সিলেটের ঘটনা সমাজের চোখ খুলবে কিনা ঠিক নেই, তবে আলোচনা হচ্ছে। বারবার যখন এমন ঘটে তখন প্রশ্ন আসে, একটি মেয়ে শুধু কিছু মাংস ও যৌনগ্রন্থির পুঁটুলি এই মনোভাবের উৎস কোথায়? এটা কি প্রাকৃতিক নিয়ম যে পুরুষ নারীর সম্মতির পরোয়া করবে না? না কি তা পরিবেশ দূষণের মতোই ভোগাকাঙ্ক্ষী মানুষের দূষিত চরিত্র? পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে কি এরা কোনো শিষ্টাচারের শিক্ষা পায়নি?
অনেকে বলছে নিগ্রহকারীদের নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির আমূল পরিবর্তন প্রয়োজন, তাই কঠোর শাস্তির পাশাপাশি মনের সংশোধনে নজর দিতে হবে। কিন্তু তার পথ কতটা খোলা রেখেছি আমরা? মা-বোন ছাড়াও যে একটি মেয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব আর প্রীতির সম্পর্ক রাখা যায়, দক্ষতা ও মেধায় মেয়ে আর ছেলেতে কোনও তফাত নেই, এই বোধ স্কুল, কলেজে ছেলে মেয়েদের মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার এক বড় বাধা মেয়ে ও ছেলেদের আলাদা স্কুল ও কলেজ। লিঙ্গ সচেতনতার পাঠ ঠিকভাবে নিতে হলে আরো সব স্কুল কলেজকে কো-এডুকেশন সিস্টেমে আনতে হবে। তবেই ছেলেরা শিখবে যে মেয়েটি তার পাশে সেও তার মতো মানুষ। এই সংবেদনশীল বোধ কত জরুরি প্রতিটি পরিবার আজ বুঝছে হারে হারে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছেন বদরুলের কঠিন শাস্তি হবে। তার রাজনৈতিক পরিচয়ের চাইতে বড় পরিচয় সে অপরাধী। আমরা আশ্বস্ত হতে চাই। সমাজের সর্বত্র যে আলোড়ন উঠেছে, আশা করি বদরুল সত্যিই উপযুক্ত শাস্তি পাবে। কিন্তু অবাক হয়ে লক্ষ্য করার বিষয় এর মধ্যেই কিছু লোক বদরুলের পক্ষে যুক্তি দেখাবার চেষ্টা করেছে, সেটিতে কিছু লোক আবার সমর্থনও দিচ্ছে। তাই বলতেই হয় মূল অভিযুক্ত যেমন আইনের চোখে দণ্ডের যোগ্য, নারীর প্রতি হিংসাকে যারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে সমর্থন করেন, নিজের দায়বদ্ধতা পালন না করে অথবা কর্তব্যের সীমা উল্লঙ্ঘন করে, তাদেরও প্রাপ্য অপরাধীর শাস্তি ও জনমানস থেকে প্রত্যাখ্যান।
পুরুষরা মেয়েদের কী চোখে দেখছে? দখলদারির বাইরে গিয়ে কোনও সম্পর্ক স্থাপন করা কি আদৌ সম্ভব নয়? সিলেটের ঘটনার পর উত্তর খুঁজছে পুরুষরাও। উত্তর খুঁজতে হবে রাষ্ট্রকেও। একটা দেশের অর্ধেক নাগরিক যদি একটা প্রান্তিক অবস্থায় নির্বাসিত হয়, তাদের ক্রমাগত অবিচার, লাঞ্ছনা এবং সহিংসতার শিকার হয়, তা হলে সেই দেশের পক্ষে সত্যিকারভাবে এগিয়ে যাওয়া অসম্ভব। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক উন্নতির পথে চলতে সংকল্পবদ্ধ, কিন্তু পারছেনা। এই খুনি বদরুলরা সমাজের স্তরে, স্তরে, ঘরে ঘরে পথ আগলে বসে আছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, পারিবারিক হিংসা দৈহিক আঘাত থেকে শুরু করে মানসিক অবসাদ, নানা ধরনের স্বাস্থ্য-সমস্যা সৃষ্টি করে। সমস্যাগুলির পারস্পরিক সম্পর্কও অনেক সময়েই রীতিমত প্রবল। যেমন, পারিবারিক হিংসা মেয়েদের যে মানসিক সংকটে ফেলে, অন্তঃসত্ত্বা মেয়েদের ক্ষেত্রে তার একটা বাড়তি প্রতিক্রিয়া থাকে— নবজাতকের ওজন কম থাকে, যা শিশুর স্বাস্থ্য এবং পুষ্টির পক্ষে ক্ষতিকর। মেয়েদের উপর হিংসার ফলে মেয়েদের আয়, কর্মক্ষমতা এবং সাফল্যের সম্ভাবনা ব্যাহত হয়, বিচ্ছিন্নতা বাড়ে, কাজ করার সামর্থ্য বিপন্ন হয়, কাজে যোগ দেওয়ার সুযোগ কমে, নিজেদের ও শিশুদের দেখভাল করার সামর্থ্য কমে। তাই, মেয়েদের উপর হিংসা প্রকারান্তরে প্রবৃদ্ধিকে রোধ করছে।
অনেক দেশেই নারী নির্যাতন রোধে আইন হচ্ছে, বাংলাদেশও ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু সেইসব আইন প্রয়োগের জন্য দেশকে সঙ্ঘবদ্ধ ভাবে তৎপর হতে হবে, যাতে প্রশাসনের দায়বদ্ধতা বাড়ে, অপরাধীরা শাস্তি পায়। যারা সমাজের সর্বস্তরে কাজ করছেন তাদের সঙ্গে নীতিকারদের যোগাযোগ বাড়াতে হবে। একটা সামগ্রিক উদ্যোগ জরুরি। সেই উদ্যোগে পুরুষের ভূমিকা, ছেলেদের ভূমিকা, সমাজনেতাদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। যে গভীর লিঙ্গবৈষম্যের মানসিকতা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে নারীদের প্রতি হিংসা বাড়ায় তাকে সমাজের মন থেকে নির্মূল করার কাজে নামতে হবে।
সমাজকে অনুধাবন করতে হবে সুস্থির গণতান্ত্রিক সমাজ, স্বচ্ছ এবং দায়বদ্ধ প্রশাসন, শান্তি ও নিরাপত্তা, বাজার অর্থনীতির সমৃদ্ধি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের প্রসার চাইলে নারীর প্রতি যে সহিংসতার বৃত্ত বিরাজান তার বাইরে যেতে হবে। নারীর সুস্থ, নিরাপদ জীবন যাপন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান এবং ক্ষমতায়নে সমান সুযোগ পরিবার, সমাজ এবং জাতির সমৃদ্ধি নিশ্চিত করে।
এইচআর/এমএস