ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

আমরা আসলে কোথায় চলেছি?

প্রকাশিত: ০২:২০ এএম, ০৪ অক্টোবর ২০১৬

রিক্সায় চড়ার ক্ষেত্রে আমরা অনেক মানবিক। নিতান্তই তাড়াহুড়ো না থাকলে কখনোই যাত্রাপথে বৃদ্ধ রিক্সাওয়ালাকে বেছে নেইনা। আমাদের খুব মায়া লাগে, আমরা আহা উহু করতে পারি, শুধু পারিনা কারো অবলম্বন হতে। প্রায় তিন-চার বছর আগে গুলিস্তানে একজন বৃদ্ধ রিক্সাওয়ালাকে দেখেছিলাম। প্রচণ্ড জ্যামে গাড়ির মধ্যে বসে আছি, হঠাৎ আমার চোখ আটকে গেল সেই বৃদ্ধ রিক্সাওয়ালার দিকে। তীব্র শ্বাসকষ্টে সে অস্থির। একটুখানি অক্সিজেনের জন্য সে কী প্রাণপণ আকুলতা! একটু পরপর রাস্তায় নুয়ে পড়ছে। খুব কষ্ট করে রাস্তা থেকে উঠে পকেট থেকে ইনহেলার বের করে মুখে নিলো কিন্তু সেটা খালি টের পেয়ে হাহাকার করে উঠলো। এরপর একই কাজ করছে ঘুরে ফিরে বারবার।

একবার পকেট থেকে টাকার থলে বের করে রাস্তায় বসে টাকাগুলো গুনলো এবং সেই অতিসামান্য টাকা দিয়ে ইনহেলার কেনা যাবেনা ভেবে বুক চাপড়াতে লাগলো। হঠাৎ আমি অনুভব করতে লাগলাম শ্বাসকষ্টটা আমারই হচ্ছে। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। আমি সিট ছেড়ে তড়াক করে দাঁড়িয়ে গেলাম। অন্তত ইনহেলার কেনার টাকাটা দিলেও বেচারা আশপাশ থেকে ইনহেলার কিনে রোগের তাৎক্ষণিক নিরাময় করতে পারবে। আমি গাড়ি থেকে নামতে যাব ঠিক সেসময় আমার পাশের যাত্রী আমাকে নামতে নিষেধ করলো। আমি অনেকক্ষণ ধরে রিক্সাওয়ালাকে খেয়াল করছি এবং  গাড়ি থেকে কেন নামছি যাত্রী ভদ্রলোক হয়তো আঁচ করতে পেরেছিলেন।

ভদ্রলোকের নিষেধ শুনে আমি অবাক হয়ে তার দিকে তাকালাম। আমার দৃষ্টিতে তীব্র বিদ্রুপ! নিজে মানবিক অনুভূতিহীন ঠিক আছে আরেকজনকে কেন বাগড়া দেবে! যাইহোক, এরপর যাত্রী ভদ্রলোক যা শোনালেন তাতে এক পৃথিবীসমান বিস্ময় নিয়ে আমি রিক্সাওয়ালার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। খেয়াল করলাম, পাশের গাড়ি থেকে নেমে এক ব্যক্তি রিক্সাওয়ালার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ভদ্রলোক নিজের ইনহেলারটি বাড়িয়ে দিলেন রিক্সাওয়ালার দিকে কিন্তু বৃদ্ধ সেই ইনহেলারটি নিলো না। বৃদ্ধ তার আচরণে বুঝিয়ে দিলো সে এই ইনহেলারটি ব্যবহার করে না। ইনহেলারটি আপাতত ব্যবহারের জন্য ভদ্রলোক আরেকবার অনুরোধ করলেন, রিক্সাওয়ালা আবারও ইনহেলারের অফার ফিরিয়ে দিয়ে কোমর থেকে একটা পলেথিনের ব্যাগ বের করে তার ভেতরে রাখা টাকা গুনতে শুরু করলো। এবার তার খুব কষ্ট হচ্ছে, বুক পাঁজর ভেঙ্গে নিঃশ্বাস নেয়ার চেষ্টা করছে সে। ঠিক তখন নিজের করণীয় প্রসঙ্গে আমি রীতিমত সিদ্দান্তহীনতায় ভুগছি।

আমার পাশের যাত্রী আমাকে সিটে বসতে বললেন। আপা, রিক্সাওয়ালার ইনহেলারের দরকার নাই তার দরকার টাকা। সেই টাকা দিয়ে সে সন্ধ্যাবেলায় হিরোইন আর গাঁজা খাবে। এই রাস্তায় এই নিয়ে তিনবার আমি তাকে একই নাটক করতে দেখেছি। জ্যামের মধ্যে সে এই নাটক শুরু করে। কথা শুনে আমি তখন অনুভূতিহীন। খুব মায়া লাগছিল বৃদ্ধের জন্য। ইতোমধ্যে গাড়ি চলতে শুরু করেছে। আমি নির্লিপ্তভাবে তাকিয়ে আছি রিক্সাওয়ালার দিকে। দেখলাম, পুরো সুস্থ মানুষের মত সে রিক্সা চালানো শুরু করলো। যেন এতোক্ষণ কিছুই হয়নি! যেন একটা পথ নাটক মঞ্চস্থ হলো!  

আমরা প্রায়শঃই অন্যের দিকে আঙ্গুল তুলি, নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ করি। মাত্র দুইহাত দূরে জলজ্যান্ত একজন মানুষ মরে যায় অথচ আমরা সেই ব্যক্তিকে সাহায্য করার কোনো প্রয়োজন মনে করি না। কিন্তু কেন করি না?  মানবিক অনুভ’তিপ্রবণ একটি জাতি হঠাৎ করেই এমন নির্লিপ্ত আচরণ শুরু করেছে বিশ্বাস করি না। কিছু কারণতো অবশ্যই আছে! হয়তো অসংখ্যবার একইধরনের কারণের মধ্য দিয়ে যেতে যেতে আমরা নিজের অজান্তেই মানবিক সব গুণাবলী এককালীন হারাতে বসেছি। আমাদের সামনে উদ্ভূত কোন পরিস্থিতিকে মোকাবেলা করতে প্রথমেই আমরা যে কাজটি করি তাহলো-সন্দেহ পোষণ। খুব সহজে কাউকে বিশ্বাস করাটা প্রায় অসম্ভবের পর্যায়ে চলে গেছে। খুব অসহায় লাগে ভাবতে যে আমি নিজেও এই দলভুক্ত। হুট করেই কিছু অপ্রস্তুত সময়ের সামনে পড়ে গিয়েছি এবং করণীয় সম্মন্ধে প্রচণ্ড সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগেছি কিংবা আশেপাশের কেউ  আমার ভুলটি ধরিয়ে দিয়েছে।

বৃদ্ধ রিক্সাওয়ালার  ঘটনাটি আমাকে এখনো অস্থির করে তোলে। অভিনয়ের মাধ্যমে মানুষকে ধোকা দিয়ে উপার্জনের এই যে চিন্তা সেটা বৃদ্ধের মাথায় কীভাবে এসেছে! নাকি এটা তার আচরণগত সমস্যা!  নিশ্চয়ই বৃদ্ধ নিজের অভাবমোচন করতে অপারগ। সে যা উপার্জন করে হয়তো তা দিয়ে সংসার চলেনা। বাড়তি উপার্জনের পথ হিসেবে সে এই ধোকাবাজিকে বেছে নিয়েছে। অভাববোধ থেকে রাষ্ট্র, সমাজ কিংবা ব্যক্তির যে অবক্ষয় এটা চক্রাকারে আবর্তিত হচ্ছে। আমরা কেউই এই অবক্ষয়ের দায় এড়াতে পারিনা। কোনো না কোনোভাবে কোনো মাধ্যমের দ্বারা আমরা বঞ্চিত এবং তার ফলাফল এই অবক্ষয়।

কতরকমের অভাববোধ আর অতৃপ্তি যে জীবনের বাঁকে বাঁকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে! মাঝে মাঝে চলমান জীবন নিজের পথ আগলে স্মৃতিকে নিমন্ত্রণ করে। নিমেষে মনে পড়ে যায়-হাজরো তৃপ্তিকে পাশ কাটিয়ে টুকরো টুকরো অভাববোধ এখনো সগর্বে টিকে আছে। ছোটবেলায় আমরা এমন অনেককিছু পছন্দ করতাম যেগুলো বড়বেলায় এসে আর ভালো লাগেনা, যা যা পছন্দ করতাম না সেগুলোর বেশিরভাগ এখন পছন্দের তালিকার শীর্ষস্থানে আছে। ছোটবেলায় কিছু না পাওয়া থেকে তৈরি হওয়া অভাববোধ বড়বেলায় প্রায়শঃই প্রবল সংকট সৃষ্টি করে। যদিও বড়বেলায় এসে সেই চাহিদাগুলোর কোনো মূল্য থাকেনা, পেলেও কোনো কাজে আসেনা, কখনো কখনো খুবই গৌণ ও হাস্যকর শোনায় কিন্তু বাস্তবতা অন্যরকম। ছোটবেলার সেই অভাববোধ বড়বেলার গোপন ক্ষত যা আজীবন চিনচিনে ব্যথা দিয়ে যায়।

অর্থনীতিতে উপযোগ বলে একটি শব্দ আছে যা বিশেষ ধরনের একটি অর্থ বহন করে। কোনো দ্রব্য বা সেবার অভাব মোচনের ক্ষমতাই হলো উপযোগ। দ্রব্য বা সেবা যা-ই হোক না কেন তা মানুষের অভাব পূরণ করতে পারলেই তার উপযোগ আছে বলে মনে করা হয়। যেমন, খাদ্য, বস্ত্র, কলম, কাগজ প্রভৃতি উপযোগবিশিষ্ট দ্রব্য। অর্থনীতিতে উপযোগ ধারণার সঙ্গে নৈতিকতার কোনো সম্পর্ক নেই। বড়বেলায় এসে ছোটবেলার অভাববোধ চাইলেই মেটানো যায় কিন্তু মন তাতে কিছুতেই তৃপ্ত হয় না। কারণ সময়ের উপযোগ হারিয়েছি। চারআনা দামের একটি নারকেল আইসক্রিম শিশুমনে যে উপযোগ সৃষ্টি করতো, তরুণকালে সেটা করে না। ছোটবেলায় গোল্লাছুট আর বদন খেলার মাঠ বাড়ির সেই বিশাল উঠানকে এখন খুব ছোট্ট মনে হয়। কেউ কোনো উপহার দিলে আমরা জিনিসটার অর্থমূল্য বের করে ব্যক্তির ভালোবাসার গভীরতা  মাপতে থাকি। শিশুদের মত মুখমণ্ডলে ঐশ্বরিক আলো ছড়িয়ে কিছুতেই আর খুশি হতে পারিনা। আমাদের উপযোগ সৃষ্টিকারী উপাদানের সংখ্যা কমতে কমতে এখন প্রায় তলানিতে। খুব বড় প্রাপ্তি, বড় বড় প্রত্যাশার স্বপ্ন নিয়ে আমরা দিন যাপন করি। ক্ষুদ্র বিষয়গুলো আমাদের চোখে আটেনা, মনেতো ধরেই না। আমরা আসলে কোথায় চলেছি? কোথায় পৌঁছানোর পর লম্বা একটা শ্বাস টেনে বলা উচিত- আমি এখন তৃপ্ত!

লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক।

এইচআর/পিআর

আরও পড়ুন