সৈয়দ শামসুল হকের কথা ও কবিতায় আমাদের জনমানস
সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের সাথে আমার স্মৃতি অনেক। তিনি যখন কথা বলতেন, তন্ময় হয়ে শোনতাম। জেনে নিতাম- আমাদের আগামী দিনগুলোর স্বপ্নসাধনার কথা। জেনে নিতাম, এই প্রজন্ম কীভাবে ঘুরে দাঁড়াবে। কীভাবে প্রতিষ্ঠিত
হবে মহান মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ।
তাঁর সাথে আমার আড্ডা, কথা হয়েছে বেশ কয়েকবার নিউইয়র্কে। তাঁকে নিয়ে অনুষ্ঠান করেছি। আন্দোলন করেছি। হাত উঁচিয়ে শ্লোগান দিয়েছি। আমাদের প্রিয় হক ভাই ছিলেন নির্ভীক মানুষ। তাঁর অসীম সাহস আমাদের চমকে দিতো। মনে পড়ছে,
একবার একাত্তরের কুখ্যাত নরঘাতক গোলাম আজমকে নিয়ে নিউইয়র্কে তার অনুসারীরা একটা সভা করছিল। `মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি`- যুক্তরাষ্ট্র শাখা সিদ্ধান্ত নেয়, সেই সভা স্থলে প্রতিবাদ সমাবেশ
করবে। এই সময় সৈয়দ শামসুল হক নিউইয়র্কে অবস্থান করছিলেন। তিনিও সিদ্ধান্ত নেন- সেখানে যাবেন। আমরা একই গাড়িতে করে সেখানে যাই। প্রতিবাদ শ্লোগান শুরু হয়। তিনিও উচ্চকন্ঠে শ্লোগান ধরেন। অনেক তরুণ কবিকে ঘিরে রেখেছিলেন।
অন্যপাশে রাজাকার অনুসারীরা শ্লোগান দিচ্ছে। কবি আমাদের একবারে সামনে চলে আসেন। তাঁর বাহু আমার বাহুর সাথে লাগানো। একসময় কবি আমাদের তরুণদের বলে উঠেন- তোমরা কি মনে করো আমি তোমাদের চেয়ে কম তরুণ ? আমরা হেসে উঠি। বলি- না হক ভাই, নিরাপত্তার বিষয়টি তো দেখতে হবে। তিনি বলে উঠেন- ডোন্ট ওয়ারি।
তৃতীয় ‘আমেরিকা-বাংলাদেশ-কানাডা (এবিসি)’ কনভেনশন অনুষ্ঠিত হয় নিউইয়র্কে। ২৩ ও ২৪ জুন ২০১২ শনি ও রোববার দুই দিনব্যাপী জমজমাট অনুষ্ঠান ছিল সেটি। ওই অনুষ্ঠানটির সাহিত্য বিষয়ক সেমিনারের মূল সমন্বয়কের দায়িত্ব ছিল আমার উপর। সেই সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন তিনি। সেমিনারে তিনি বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেন।
সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক বলেন, ভাষাকে বাঁচাতেই লিখতে হবে। পাঠক কজন, তা বিবেচনায় না রেখেই লেখককে তার সৃষ্টি চালিয়ে যাওয়া দরকার। তিনি বলেন, `পাওয়ার অফ ওয়ার্ডস`-এর বিকল্প কিছু নেই। আর এ শক্তি সব ভাষাতেই আছে। শুধু ব্যবহারের অপেক্ষায়ই থাকে সেই শক্তি।
সৈয়দ হক বলেন, রিজেকশন থেকে শিক্ষা নেয়ার অনেক কিছুই আছে। তিনি বলেন, এই বয়সে এসে আমি দৃঢ়তার সঙ্গে আপনাদের জানাতে চাই, আমি চাইলে যে কোন ইংরেজ ভাষাভাষী লেখকের চেয়ে ভালো ইংরেজিতে আমি লিখতে পারতাম। কিন্তু আমি লিখিনি। কারণ বাংলা আমার ভাষা। বাংলা আমার গর্ব। আমি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করি যে কোন ভাষার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারে বাংলা ভাষা।
সৈয়দ হক বলেন, রোমান হরফে বাংলা ভাষার প্রতি ‘ভাষার আগ্রাসন; চলছে। যে বাঙালি ‘৫২ সালে ভাষার জন্য রক্ত দিয়েছিল, সেই প্রজন্ম এখন বাংলিশে এসএমএস করে প্রতিদিন কোটি কোটিবার। তিনি বলেন, বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন বোর্ডের চেয়ারম্যানের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। তিনি আমাকে কথা দিয়েছেন, যেসব মোবাইল থেকে বাংলা লেখা যায় না, সেসব কোম্পানির মোবাইল বাংলাদেশ আমদানি করবে না। তা আসছে বছর থেকেই কার্যকরী হবে বলে আমরা আশা করছি। যেসব মোবাইল থেকে বাংলা হরফে লেখা যায়, তেমন মোবাইল বাংলাদেশেও তৈরির চেষ্টা চলছে। তিনি বলেন, বাংলাসাহিত্য, বিশ্বের যে কোন ভাষা ও সাহিত্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়েই এগিয়ে যাচ্ছে। এ নিশ্চয়তা আমি আপনাদের দিচ্ছি।
সৈয়দ শামসুল হক বলেন, মালদ্বীপের জনসংখ্যা প্রায় সাড়ে তিন লাখ। সে দেশের একজন তরুণী লেখিকা আমাকে জানিয়েছেন, তিনি টাইপ করে বাঁধাই করে তার লেখা ৫০০ পৃষ্ঠার একটি বই দেড়শ কপি ছেপেছিলেন। তিন বছরে বিক্রি হয়েছে একশ কপি। তাই আমাদের হতাশ হওয়ার কী আছে? ১৬ কোটি মানুষের দেশ বাংলাদেশ।
এবিসি কনভেনশনে কবি সৈয়দ শামসুল হক তার সমাপনী বক্তব্যে বলেছিলেন, বাংলা হচ্ছে বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম ভাষা। আমি মনে করি অন্য ভাষার চর্চা ভালো। তবে নিজ ভাষা, সংস্কৃতিকে বাদ দিয়ে নয়। তিনি বলেন, বাংলা একাডেমি যদি একজন প্রবাসী লেখককে পুরস্কার দিতে চায়, তবে তাকে বাংলা একাডেমি পুরস্কারটি দেয়া দরকার। এখানে `প্রবাসী` আর স্বদেশী` ক্যাটাগরি বিভাজন গ্রহণযোগ্য নয়। তিনি যোগ করেছিলেন- আমি প্রবাসী হলে এবং আমাকে এমন পুরস্কার দেয়া হলে আমি তা গ্রহণে অসম্মতি জানাতাম। উল্লেখ্য, পরে বাংলা একাডেমি এই পুরস্কারটির নাম পরিবর্তন করে `সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ সাহিত্য পুরস্কার` নামকরণ করে।
সৈয়দ হক বলেন, একজন লেখকের স্থানিক পরিচয় কোন বিষয় নয়। লেখক যে কোন স্থানে থেকেই তার লেখালেখি চালিয়ে যেতে পারেন। যারা বিদেশে থেকে লেখালেখি করবেন, তাদের নিয়মিত পড়াশোনা করতে হবে। পাঠাভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। প্রজন্মকে পড়াশোনায় উদ্বুদ্ধ করতে হবে। মনে রাখা দরকার, আমরা সবাই সৃষ্টিশীলতা চাই। আর সৃষ্টির জন্য অধ্যবসায় খুবই দরকারি ব্যাপার।
দুই.
সৈয়দ শামসুল হক তাঁর কবিতায় দেখিয়েছেন একজন কবির দেশপ্রেম কেমন হওয়া চাই। `মানুষ`, `জীবন` ও `নিসর্গ`কে সামনে এনে নিজেকে নিজেই মহৎ কবির মর্যাদা দান করেছেন। তা থেকেই উৎসারিত হয়েছে প্রেমের অন্য রূপগুলো।
পড়া যাক তাঁর সদ্য লেখা একটি কবিতা :
ফুলের গন্ধের মতো থেকে যাবো তোমার রুমালে
ধূপের গন্ধের মতো তোমাদের শান্ত সন্ধ্যাকালে
সমস্ত দিনের শেষে থেকে যাবো নদী পারাপার
তখনো যাত্রীর দেখা পাওয়া যাবে এই নদী পার।
ভোরের প্রথম আলো হয়ে চুমো খাবো ওই গালে
ছায়া লয়ে সরে যাবো বেলাটি পোহালে।
কিন্তু তার আগে আমি আরো কিছুকাল
থেকে যাবো কবিতার পঙ্ক্তি হাতে অপার কাঙাল
[ আরো কিছুকাল ]
সৈয়দ শামসুল হকের কবিতা এই প্রজন্মকে যেমন দ্রোহী করেছে- তেমনি করেছে প্রেমিকও। কবি তাঁর কবিতার মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছেন, ভালোবাসার মাধ্যমেই গড়ে উঠতে পারে একটি সৃজনশীল সমাজ। একটি অগ্রসরমান প্রজন্ম।
তাঁর ভাষায় :
কিছু শব্দ উড়ে যায়, কিছু শব্দ ডানা মুড়ে থাকে,
তরল পারার মতো কিছু শব্দ গলে পড়ে যায়।
এমন সে কোন শব্দ নক্ষত্রের মতো ফুটে থাকে-
তুমি কি দেখেছো তাকে হৃদয়েশ্বরের আয়নায়?
দ্যাখোনি যখন কালো অন্ধকার উঠে আসে- গ্রাসে।
যখন সৌজন্য যায় কবরে মাটি কল্পতায়,
যখন স্তব্ধতা গিলে খেতে থাকে কামুকেরা ত্রাসে,
তখন তাকিয়ে দেখো শুদ্ধতার গভীর ব্যাথায়-
আমার ঠোঁটের থেকে একটি যে শব্দ একদিন
ফুটেছিলো এই ঠোঁটে তোমারই যে দেহস্পর্শ তাপে,
আজ সেই শব্দ দ্যাখো পৃথিবীর বুকে অন্তরীণ-
তবু তারই উচ্চারণে বৃক্ষপাতা বারবার কাঁপে।
পড়ে নিও তুমি তাকে, দেখে নিও আকাশে নয়তো
সেই শব্দ ‘ভালোবাসি’ নক্ষত্রের মতোই হয়তো।।
[কিছু শব্দ উড়ে যায়]
সাহিত্যের প্রতিটি সিঁড়ি স্পর্শ করেছেন সৈয়দ হক। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এমন সাহিত্যিক হয়তো আরো শত বছরেও আসবেন না। তাঁর সাহিত্যে গ্রামীণ মানুষের জীবন ও সংগ্রাম উঠে এসেছে খুব শক্তিশালী মননে। একেবারে কথ্যভাষায়
তার রচিত `পরাণের গহীন ভিতর` ফিরছে মানুষের মুখে মুখে।
জামার ভিতর থিকা যাদুমন্ত্রে বারায় ডাহুক,
চুলের ভিতর থিকা আকবর বাদশার মোহর,
মানুষ বেকুব চুপ,হাটবারে সকলে দেখুক
কেমন মোচড় দিয়া টাকা নিয়া যায় বাজিকর ৷
চক্ষের ভিতর থিকা সোহাগের পাখিরে উড়াও,
বুকের ভিতর থিকা পিরীতের পূর্ণিমার চান,
নিজেই তাজ্জব তুমি – একদিকে যাইবার চাও
অথচ আরেক দিকে খুব জোরে দেয় কেউ টান৷
সে তোমার পাওনার এতটুকু পরোয়া করে না,
খেলা যে দেখায় তার দ্যাখানের ইচ্ছায় দেখায়,
ডাহুক উড়ায়া দিয়া তারপর আবার ধরে না,
সোনার মোহর তার পড়া থাকে পথের ধূলায় ৷
এ বড় দারুণ বাজি, তারে কই বড় বাজিকর
যে তার রুমাল নাড়ে পরানের গহীন ভিতর৷
সৈয়দ হক বাঙালি জাতির ক্রান্তিকালে পাশে দাঁড়িয়েছেন গোটা জাতির। তাঁর দেখানো পথই হোক আগামী প্রজন্মের আলোকবর্তিকা।
এআরএস/পিআর