আমেরিকান সমাজের ‘অস্বস্তি’
আমেরিকান সমাজ নারীর হাতে ক্ষমতাকে দেখতে পছন্দ করে না। আমেরিকানরা ক্ষমতাধর নারীর ব্যাপারে অস্বস্তি বোধ করে।
আমেরিকান সমাজে লৈঙ্গিক বৈষম্য আছে।
অর্থাৎ, আমেরিকা নারীর ক্ষমতায়নে সফল নয়।
আমেরিকার এই ব্যর্থতার সার্টিফিকেট পাওয়া গেছে স্বয়ং আমেরিকান প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার কাছ থেকে।
বিশ্বের অনেক দেশের শাসন ক্ষমতা নারীর হাতে থাকলেও আমেরিকা নারী দ্বারা শাসিত হতে অস্বস্তি বোধ করে। আর তাই এ দেশে এখনো কোন নারী প্রেসিডেন্ট হতে পারেননি। প্রেসিডেন্ট ওবামা স্পষ্টতঃ হতাশা প্রকাশ করেছেন। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে লড়াই করা প্রথম নারী রাজনীতিবিদ হিলারী ক্লিনটনের পরাজয় ঘটবে কেবল তিনি নারী বলে, পরাজয় ঘটবে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প জিতে যাবেন বলে নয়, পরাজয় ঘটবে নারীকে ক্ষমতাধর বানাতে বা ক্ষমতাধর নারীকে মেনে নিতে আমেরিকান সমাজের অস্বস্তি আছে বলে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের ছুঁড়ে দেওয়া চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করবেন কি, হিলারী ক্লিনটনকে মুখোমুখি হতে হচ্ছে আমেরিকান সমাজের লৈঙ্গিক বৈষম্যের। স্বামী বিল ক্লিনটনের চারিত্রিক পাপের দায়ভার, অর্থনৈতিক অনৈতিকতার ভার তাঁকে বহন করতে হয়, বিল ক্লিনটনের ‘স্ত্রী’ হিসেবেই করতে হয়। এর পরিবর্তে সিনেটর, সেক্রেটারি অব স্টেট, পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারী ক্লিনটন হিসেবে সিদ্ধান্ত নিতে কি কি ভুল করেছিলেন, কেবলমাত্র তার জন্য সমালোচিত হতেন তবে ভাল হ’ত। বারাক ওবামাকে হয়তো আক্ষেপ করে লৈঙ্গিক বৈষম্যের বিষয়টি স্বীকার করতে হ’ত না।
আমেরিকান সমাজ তাহলে কি? কনজারভেটিভ, এভাবে এই অস্বস্তির ব্যাখ্যা দেওয়া চলে। বিশ্বের নানান দেশে অনেক নারী সরকারপ্রধান হিসেবে ক্ষমতাধর হয়েছেন, এটা এই কনজারভেটিভ সমাজ দেখে, তবে আমলে নেয় না। তবে আমেরিকান জনগণ ভোট দিয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করেন না। ৫৩৮ জন নির্বাচকমণ্ডলীর ভোটে নির্বাচিত হবেন প্রেসিডেন্ট। এর অর্থ হিলারী ক্লিনটন যদি নির্বাচিত না হন, তবে বুঝতে হবে বেশির ভাগ নির্বাচক তাঁকে কেবলমাত্র ‘নারী’ হিসেবে গণ্য করেছেন, অস্বস্তি বোধ করেছেন। নির্বাচনে জয়-পরাজয়ের দায় বা কৃতিত্ব যদি নির্বাচকমণ্ডলীর হাতেই থাকে, তবে কেন আমেরিকার জনগণ তথা সমাজকে টেনে আনলেন প্রেসিডেন্ট ওবামা? কেন সরাসরি নির্বাচকমণ্ডলীর ভেতরই অস্বস্তি বিরাজমান বলে জনগণ তথা সমাজকে দায়মুক্ত করলেন না? কেন ওবামা আমেরিকান জনগণ তথা সমাজকে বারবার মনে করিয়ে দেন, জনগণ তথা সমাজের উন্নয়নে নারীর ভূমিকা কত ব্যাপক? বারাক ওবামা নারী ও শিশুর ক্ষেত্রে আমেরিকান জনগণ তথা সমাজ ‘ডাবল স্ট্যান্ডার্ড’ নীতি প্রদর্শন করে বলে সরাসরি অভিযোগ করেছেন। তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে নারীর শ্রমের সমান মজুরি প্রাপ্তি, পারিবারিক ও অসুস্থতাজনিত কারণে ছুটিলাভ, শিশু পরিচর্যার সুযোগ লাভ ইত্যাদি বিষয়ে নীতি প্রণয়নে সবাইকে এগিয়ে আসতে বলেন, কেননা তিনি এগুলো বাস্তবায়িত করতে পারেননি। মাতৃত্ব ও পিতৃত্বকালীন ছুটি বেতনসহ হোক্, এই দাবি করতে হয় প্রেসিডেন্ট ওবামাকে। পরবর্তী প্রেসিডেন্ট যদি ‘নারী’ হন, তবে এই সব সুযোগ প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে বলে তিনি হিলারী ক্লিনটনকে সমর্থন জানাচ্ছেন।
আমেরিকার পরবর্তী প্রেসিডেন্ট কি হিলারী ক্লিনটন হতে পারবেন? ১৯১৬ সালে আমেরিকার প্রথম নারী রাজনীতিবিদ হিসেবে জেনেট র্যা ঙ্কিন হাউজ অব রিপ্রেজেন্টিটিভ হিসেবে নির্বাচিত হন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া ঠিক হবে কি না তা নিয়ে বিতর্কে জেনেট র্যা ঙ্কিনকে শুনতে হয়েছিল, তিনি ‘নারী’ বলেই দুর্বল আর তাই যুদ্ধ চাই বলে ভোট দিতে পারেন না। আমেরিকার রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ কেবল-ই ‘নারী’ হিসেবে বিবেচিত হওয়ার কুসংস্কারের যাত্রা শুরু সেই শুরু থেকে। ১৯৮৪ সালে ওয়াল্টার মন্ডাল তাঁর রানিং মেট হিসেবে গেরাল্ডাইন ফেরারো-কে নির্বাচিত করেন, ২০০৮ সালে জন ম্যাককেইন রানিং মেট হিসেবে নিয়েছিলেন সারাহ্ পলিনকে। কোন অভিজ্ঞতাই সুখকর নয়। বিশ্বের প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট শ্রীলংকার শ্রিমাভো বন্দরনায়েক সেই ১৯৬০ সালে যখন ক্ষমতাধর হয়েছিলেন, হিলারী ক্লিনটন তখন কলেজে পড়তেন। ক্রমশঃ পরিণত হওয়া সেই হিলারী ক্লিনটন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে যুদ্ধ সমর্থন করেছেন, আমেরিকান সমাজে তিনি নাকি ‘যুদ্ধবাজ’ হিসেবে বিবেচিত, তবুও তিনি নির্বাচিত হবেন না কেবল মাত্র ‘নারী’ বলে? অনেকে বলছেন, তিনি ঠিক ‘মার্গারেট থ্যাচার’-এর মতো নারী নন বলেই নির্বাচিত হবেন না। মনে পড়ে যায়, মার্গারেট থ্যাচার মানবী না হয়ে টিকে থাকার জন্য বাধ্য হয়েছিলেন লৌহমানবী হতে। হিলারী কেবলি মানবী, লৌহমানবী নন বলেই ‘অস্বস্তি’!
নির্বাচনের সময় প্রার্থীদের পরস্পরকে আক্রমণ করতেই হয়। ডোনাল্ড ট্রাম্প আর হিলারী ক্লিনটনও আক্রমণ করছেন। হিলারীকে আক্রমণের সময় ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর চেহারা নিয়ে কুৎসিত মন্তব্য করেন, কেননা নারীর চেহারা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। বয়োবৃদ্ধ স্যান্ডারস-কে ‘বুড়ো’ মনে না হলেও হিলারীকে ‘বুড়ি’ ডাক শুনতে হয়েছে অনেকের কাছ থেকেই। দাঁতমুখ খিঁচিয়ে ট্রাম্প বলেছেন, ‘লুক এ্যাট দ্যাট ফেস! উড এনিওয়ান ভোট ফর দ্যাট? ক্যান য়্যু ইমাজিন দ্যাট, দ্য ফেস অব আওয়ার নেক্সট প্রেসিডেন্ট?’ হিলারীর চেহারা ‘৬১ বছর বয়সী বৃদ্ধা মহিলা’র চেহারা, যা দেখার চেয়ে আন্ডা দেখা অনেক ভাল, ট্রাম্প আন্ডার গায়ে ডাইনির ছবি এঁকে হিলারীর অস্তগত যৌবনকে ঝুলিয়ে রাখতে চান। যৌবনবতী নারী আর অস্তগত যৌবনের নারীর মূল্য সমাজের কাছে এক নয়, বুঝিয়ে দিয়েছিলেন ট্রাম্প। রোলিং স্টোন-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ট্রাম্প হিলারী প্রসঙ্গে বলেন, ‘আই মিন, শি ইজ আ উইমেন, আর তাই আমি তাঁকে নিয়ে বাজে কথা বলতে চাই না, কিন্তু হে জনাবগণ, ভাবুন তো, ‘আর উই সিরিয়াস?’
প্রশ্নটা আসলেই তাই। আমেরিকান সমাজ কি সত্যিই সিরিয়াস? এই নারী কিন্তু আমেরিকান সমাজের দারুণ ভীতি ওসামা বিন লাদেনকে গর্ত থেকে বের করেছিলেন, তবুও তাঁকে নিয়ে সিরিয়াস হওয়া যাবে না। রিপাবলিকান নারী রাজনীতিবিদদের কানেও তো প্রশ্নটি গেছে, তাই না? আমেরিকান সমাজের নারী অংশটিও শুনতে পেরেছে প্রশ্নটি। শুনলেই বা কি? আমেরিকান সমাজে নারী তেমন কিছু করতে পারেন কি? জনসংখ্যার শতকরা ৫২ ভাগেরও বেশি নারী, যদিও সুপ্রিম কোর্টে নারীর উপস্থিতি মাত্র এক তৃতীয়াংশ, সিনেটে ২০ ভাগ, হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভস-এ ১৭ ভাগ, নারী গভর্নর আছেন মাত্র ১০ ভাগ!
সাদা চোখে স্পষ্ট, ডোনাল্ড ট্রাম্পের চেয়ে সব দিক দিয়েই যোগ্য হিলারী ক্লিনটন। প্রেসিডেন্ট ওবামা বারবার বলছেন, হিলারী হবেন ‘ফাইন প্রেসিডেন্ট’। এরপরও মূলধারার মিডিয়াকে তাঁর র্যা লি, ভাষণ ইত্যাদি কভারেজ দিতে আকৃষ্ট করতে পারেননি হিলারী, এমন অনুযোগ বিদ্যমান। লৈঙ্গিক বৈষম্য আমেরিকান মিডিয়াকে ছাড়েনি। আর তাই মিডিয়াতে বিনোদনের সামগ্রী হিসেবে নারীর উপস্থাপন যতটা ঝলমলে, নারীর অন্য ভূমিকাগুলোকে তুলে ধরতে মিডিয়া আগ্রহী নয়। বরঞ্চ মূলধারার মিডিয়া হিলারীর চেয়ে ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন কতটা যোগ্য প্রার্থী হতে পারেন, তা নিয়ে দারুণ উৎসাহ দেখিয়েছিল, নানা রকমের টক শো আয়োজিত হয়েছে, যাতে আলোচকের মুখে এরকম কথাও উঠে এসেছে, ‘তিনি বলছেন যে তিনি ডাইনি নন, কিন্তু সন্দেহ থেকে যায় তিনি আমাদেরকে না আবার তার তরল খাবারে চুবিয়ে না দেন।’ নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হিলারীকে কত তাড়াতাড়ি সেরে ওঠার চেষ্টা করতে হ’ল, ডাক্তারের সার্টিফিকেট জমা দিতে হ’ল যে তিনি দেশ চালানোর জন্য শারীরিকভাবে সক্ষম আছেন। এসবও পরীক্ষা বৈকি। এরকম কত পরীক্ষা তাঁকে দিতে হবে, তার কেউ জানে না। যদি কোনক্রমে তিনি জিতেও যান, পরীক্ষা কিন্তু থেমে যাবে না। ব্যাপ্তি বাড়বে বহু গুণ। সীতাকে অগ্নিপরীক্ষা দিতে হয়, হিলারীকে দিতে হবে ডাইনি-পরীক্ষা। যদি তিনি ডুবে যান, তবে তিনি ডাইনি নন। আর যদি না ডোবেন, তিনি ধৃত হবেন এবং আগুনে পুড়তে বাধ্য হবেন, নয় কি?
আমেরিকান সমাজ কৃষ্ণ প্রেসিডেন্ট গ্রহণ করতে পারবে কি না, এই নিয়ে তর্ক উঠেছিল। আমেরিকান সমাজ বারাক ওবামাকে নির্বাচিত করে প্রমাণ করেছিল, মানুষের গাত্রবর্ণ নিয়ে কোন ‘অস্বস্তি’ থাকতে নেই। এই বার, সময় এসেছে আমেরিকান সমাজকে প্রমাণ করার, ‘নারী’-কে পুরুষের মতোই যোগ্য মনে করা নিয়েও কোন ‘অস্বস্তি’ থাকতে নেই। তবুও ‘অস্বস্তি’। আমেরিকান সমাজে আওয়াজ ওঠে ‘লক হার আপ’ শ্লোগান। ‘লক হিজ আপ’ নয়। টি-শার্টে লেখা থাকছে ‘কেএফসি হিলারী স্পেশাল...টু ফ্যাট থাইজ, ডট ডট ডট...’ ১৯৯৫ সালে বেইজিং-এ জাতিসংঘের চতুর্থ বিশ্ব নারী কনফারেন্সে হিলারী ক্লিনটনের দেওয়া সেই বিখ্যাত উক্তিটি মনে পড়ে যায়। ‘নারীর অধিকার মানবাধিকার।’
আমেরিকান সমাজ কি ভয় পাচ্ছে? ‘নারী’ প্রেসিডেন্ট নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে পুরুষের চাকরি-ব্যবসা আয়-উপার্জনে টান বাঁধাবেন কি না। ‘নারী’ বসের সাথে কাজ করতে পুরুষ অধীনস্ত ‘অস্বস্তি’ বোধ করেন, এর সাথে জুটে যাচ্ছে ভয়ও। আমেরিকান সমাজের সব ক্ষেত্রে নারীর প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা হয়ে যেতে পারে, ভয় হচ্ছে।
লৈঙ্গিক বৈষম্য যেখানে সমাদৃত, সেখানে ‘অস্বস্তি’ ‘ভয়’-এ পরিণত হয় বৈকি।
লেখক : শিশুসাহিত্যিক
এইচআর/এবিএস