গৃহকর্মীকে পরিবারের সদস্য ভাবুন, সেও মানুষ
দু মুঠো ভাত পাওয়ার আশায়
কাজ করি ভাই পরের বাসায়
তাইতো সমাজ ডাকে মোদের বুয়া-
মনের ভিতর স্বপ্ন গুলো
যেথায় শুধু উড়ছে ধুলো
কষ্ট গুলো বাষ্প হয়ে হাওয়ায় ভাসে ধোঁয়া
দুমুঠো ভাত, পোড়াকষ্ট, বৃত্তবন্দীজীবন আর অমানুষিক নির্যাতন এই শব্দগুলো যেন গৃহকর্মী আর কাজের লোকদের সাথে সমার্থক হয়ে উঠছে প্রতিনিয়ত। আমাদের সভ্য সমাজের মানুষরূপী কিছু অমানবিক হায়েনাদের চিন্তার পরিসীমায় এই কাজের লোকদের জীবন আর বেঁচে থাকা নিতান্তই তুচ্ছ। গরম খুন্তির ছ্যাঁকা, হাতুড়ি দিয়ে মাথা ফাটানোসহ আরও সব নিষ্করুণ নির্যাতনের কাছে মানবিকতা লুটোপুটি খাচ্ছে নির্মমভাবে।
কখনো কী ভেবেছেন একটু
একটু খাওয়া-পরা আর আশ্রয়ের খোঁজে যে মেয়েটি দিনরাত কলুর বলদের মতো খেটে মরে আপনার আমার বাসায় তার সম্পর্কে একবারও ভেবেছেন কী? তারও স্বপ্ন ছিল, সাধ ছিল আর ছিল শত আহ্লাদ, ঠিক আপনার আদরের মেয়েটার মতোই। প্রজাপতি আর ফড়িং ধরার বয়সটাকে জলাঞ্জলি দিয়ে যে মেয়েটি আপনার বাসায় কাজ করে, সে কীভাবে আপনার রান্না ঘরের কোণায় গুটি-শুটি হয়ে শুয়ে থাকে তার খোঁজ নিয়েছেন কী? আপনি অফিস থেকে ফেরার পথে আপনার মেয়ের জন্য যেমন চকলেট, আইসক্রিম আর ললিপপ নিয়ে আসেন তেমনি আপনার বাসায় কাজের মেয়েটির বাবাও লাহিড়ী হাট থেকে মুড়ি-মুড়কি আর গুড়ের জিলাপি নিয়ে আসতো।
একবারও কী আপনি আপনার মেয়ের জন্য আনা একটা চকোলেট তুলে দিতে পেরেছেন ওই নিষ্পাপ কাজ করে খাওয়া ছোট্ট মেয়েটিকে! একবারও কী কাছে ডেকে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলতে পেরেছেন-‘এই ফুলি মনটা খারাপ কেন তোর, মন খারাপ করিস না, আমরা পরশুদিন পিকনিকে যাবো, তুইও আমাদের সাথে যাবি ঠিক আছে’ বলেননি, বললে দেখতেন ওই আদর প্রত্যাশী চোখ দুটোতে কী আনন্দই না খেলা করছে।
পরিবারের সদস্য মনে করলে ক্ষতি কী?
কাজের মেয়ে, বুয়া বা গৃহকর্মী হিসেবে না দেখে পরিবারের সদস্য মনে করুন। স্নেহ আর ভালোবাসার বড় কাঙাল এরা। সোহাগ মাখা কণ্ঠে ওদের সাথে একটু ভালো আচরণ করতে দোষটা কোথায়? ওরাও আমার আপনার মতো রক্ত-মাংসের গড়া মানুষ। ওদের সাথে নির্দয় আচরণ আর গরম খুন্তির ছ্যাঁকা দিয়ে শরীরের বিভিন্ন স্থানে গদগদে ক্ষত সৃষ্টি করার মধ্যে বীরত্ব প্রকাশ পায় না, প্রকাশ পায় আপনার মধ্যে থাকা পশুত্ব, হায়েনারূপী অমানবিক আর অসভ্য এক বুনো দানবের প্রতিচ্ছবি। সে প্রতিচ্ছবিকে সবাই ঘৃণা করে।
আসুন মানবিক হই
রবী ঠাকুরের লেখা পোস্টমাস্টার গল্পের বারো-তেরো বছরের রতনের কথা নিশ্চয়ই মনে আছে। ছোট্ট এই মেয়েটি পোস্টমাস্টারের রান্নাবান্না ও দেখভাল করতো। পোস্টমাস্টার সাহেবের অন্য জায়গায় বদলী হলে তিনি যেদিন বিদায় নিয়ে নৌকায় করে চলে যাচ্ছিলেন সেই চলে যাওয়ার মর্মন্তুদ বিদায়ক্ষণ আজও পাঠকের মনকে নাড়া দেয়। রতনের চোখের সাথে সাথে পাঠকের চোখও জলে ভিজে যায়। এই ভেজা চোখই মানবতা। আমাদের সবার হৃদয়ে এই মানবতা ছুঁয়ে যাক। আমরা সবাই কাজের লোক বা গৃহকর্মীদের প্রতি মানবিক হই। তাদের সাথে সদয় আচরণ করি।
লেখক: সিনিয়র সহকারী পুলিশ কমিশনার, মিডিয়া এন্ড পাবলিক রিলেশনস, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ, ঢাকা।
এইচআর/এবিএস