নো সাইলেন্স প্লিজ!
দুবাই মলে বিশাল একটি বইয়ের দোকান আছে। নামটা মজার-কিনোকুনাইয়া। জাপানিজ ব্যবসায়ীর এই দোকানটিতে এশিয়ান বই-ম্যাগাজিন বেশি থাকতো বলে এখানে ঢুঁ মারতাম, যখন আমি চাকরিসূত্রে দুবাই থাকতাম। আমার দুই মেয়ের বড় পছন্দের জায়গা ছিল এটি। ছুটির দিনে সকালে ঢুকে সন্ধ্যা পার করে বের হয়েছি, এমন কত বার যে হয়েছে। পাশেই বিশ্বের সর্বোচ্চ ভবন, বুর্জ খলিফা। কিনোকুনাইয়ায় সময় কাটিয়ে বইয়ের সঙ্গ নিয়ে মনটাকে ফুরফুরে করার পর বুর্জ খলিফার পাশে দাঁড়ালে নিজেকে কেন যেন ক্ষুদ্র মনে হয় না, উচ্চতাকে মনে হয় ফালতু একটা ব্যাপার। সন্ধ্যা নামলেই বুর্জ খলিফার সামনের হ্রদটাতে সুরের সাথে পানিকে নাচতে দেখে মনে হয়, কী আছে জীবনে!
এক দিনের কথা বলি। তার আগে কিনোকুনাইয়া’র ভেতরের সজ্জাটা কেমন, সেটুকু বলে নিচ্ছি। অসংখ্য বই। বই আর বই। কোথাও কোথাও বসে পড়ার ব্যবস্থা। খাবারের অর্ডারও দেওয়া যায়, খেতে খেতে বই পড়ার সুবিধা দেওয়ার জন্য। কোথাও কোথাও গ্রুপ করে পড়ার ব্যবস্থা। এমনকি কেউ একজন বই পড়ছে আর অন্যরা তাকে ঘিরে বসে শুনছে, এমন ব্যবস্থাও আছে এখানে। পুরোটা দিন কাটিয়ে দেওয়া যায়, বইয়ের ভিড়ে নিজেকে হারিয়ে ফেলা যায়, এরকম অসাধারণ অভিজ্ঞতার পসরা সাজিয়ে বসেছে কিনোকুনাইয়া। সেখানেই একদিন খুব বড় একটি ধাক্কা খেয়েছিলাম।
এক বৃটিশ মহিলা ছোট বাচ্চাদের বই পড়ে শোনাচ্ছিলেন। খুব মজা করে পড়ছেন আর তাকে ঘিরে থাকা বাচ্চারা শুনছে। আমার কন্যারাও ভিড়ে গেল দলে। মন দিয়ে শুনছে। কখনো কখনো হেসে উঠছে। কখনো চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। দম বন্ধ করে অপেক্ষা করছে এর পরে কি ঘটবে তা জানার জন্য। বইটি ছিল হ্যারি পটার সিরিজের, দিব্যি মনে আছে।
বাচ্চাদের সবাই যে চুপ করে শুনছিল, তা কিন্তু নয়। তিনটে বাচ্চা কিছুতেই মনোযোগ দিচ্ছিল না, নানা রকমের শব্দ করছে, কেবলি ছোটাছুটি করছে এরকম। একজন তো গল্প শুনতে ব্যস্ত দু’টি বাচ্চার উপর হুমড়ি খেয়ে পড়েই গেল। তখন বই পড়ে শোনানো বাদ দিয়ে সেই বৃটিশ মহিলা খুব বিনয়ের সাথে বাচ্চা তিনটের মা’কে কাছে ডাকলেন। কিভাবে পড়লে তাদের বাচ্চারা গল্প শুনতে আগ্রহী হবে, জানতে চাইলেন তিনি। তিনটি বাচ্চার তিন মা মুখ শুকিয়ে আমসি করে ফেললেন সাথে সাথে। এটুকু পর্যন্ত হলেও হয়তো বা ঠিকই ছিল। কিন্তু তার এই জানতে চাওয়ার প্রেক্ষিতে একটি মা যখন ডুকরে কেঁদে উঠলেন, তখন চমকে যেতে হল। স্পষ্ট শুনলাম, তিনি বলছেন, ‘আমি দুঃখিত। আমার বাচ্চাটার অটিজম আছে। আমি ওকে নিয়ে কোথাও যাই না। ও চুপ থাকতে পারে না। সবাই বিরক্ত হয়।’
কিনোকুনাইয়া’র পরিবেশটা এমন, সবাই চুপচাপ বই দেখছে, বই পড়ছে। বইয়ের দোকানের চেয়ে একে লাইব্রেরি বলাটাই বেশি যুক্তিযুক্ত বলে মনে হত আমার কাছে। সেই পরিবেশ বিঘ্নিত হচ্ছে এই তিনটি বাচ্চার নো সাইলেন্স অ্যাটিচ্যুডের কারণে। অটিজম ওদের মস্তিষ্ককে বুঝকে অক্ষম করে রেখেছে যে লাইব্রেরিতে শব্দ করতে নেই, গল্প শুনতে হয় চুপ করে বা বইয়ের সাথে কথা বলতে হয় মনে মনে।
আপাতঃদৃষ্টিতে মনে হয়, মস্তিষ্ক বুঝতে দিচ্ছে না বলে এরা বোধহয় লাইব্রেরিতে থাকতে চায় না, বইয়ের সঙ্গ ভালবাসে না। শিখতে অক্ষম, অটিজমে আক্রান্ত আর জটিল বৈশিষ্ট্যের বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষদের নিয়ে কাজ করা যুক্তরাজ্যভিত্তিক স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান ডায়মেনশন এক গবেষণায় দেখেছে, এরকম মানুষগুলো আর দশটা স্বাভাবিক মানুষের চেয়েও লাইব্রেরিতে সময় কাটাতে বেশি পছন্দ করে। দাবি উঠেছে, বিশেষ মানুষদের প্রতি আরো বেশি সহানুভূতিশীল লাইব্রেরি গড়ে তোলা প্রয়োজন।
এই লাইব্রেরির অন্যতম বৈশিষ্ট্য কি? ‘সাইলেন্স প্লিজ’ সাইনবোর্ড উঠিয়ে দিতে হবে। চাই ‘নো সাইলেন্স প্লিজ’ লেখা সাইনবোর্ড। অটিজম ফ্রেন্ডলি লাইব্রেরির জন্য ‘নো সাইলেন্স প্লিজ’ ক্যাম্পেইন শুরু করেছে ডায়মেনশন। কেননা অটিজমে আক্রান্ত মানুষগুলো যখন বুঝতে পারে, কোথাও কথা বলা বা শব্দ করার উপর বিধিনিষেধ আছে, কথা বললে বা শব্দ করলে কেউ ভ্রূ কুঁচকালে বা ঠোঁটের উপর আঙ্গুল রেখে হিশ্ বলে চুপ থাকতে ইঙ্গিত করলে তারা ভয়ানকভাবে অস্থিরতায় ভুগতে শুরু করে। ডায়মেনশন ৪৬০জন অটিস্টিক শিশু-কিশোর-তরুণ আর বয়স্ক মানুষ ও তাদের পরিবারের উপর একটি জরিপ চালিয়ে দেখেছে, ওরকম কোনো বিধি নিষেধ না থাকলে এই মানুষগুলোর শতকরা ৯০ ভাগ স্থানীয় লাইব্রেরিতে নিয়মিত যেতে চান। একজন অটিস্টিক তরুণ নাকি জরিপকারীকে বলেছিলেন, ‘দয়া করে বন্ধুত্বপূর্ণ আর ননজাজমেন্টাল হউন। আমি যদি খুব আওয়াজ করি আর আনপ্রেডিক্টেবল হয়ে যাই, তাহলে ধাক্কা খাবেন না। হাসুন এবং দয়া করে আমার মায়ের সাথে সুন্দর ব্যবহার করুন, বেরিয়ে যেতে বাধ্য হওয়াটা আমাদের সবার জন্যই কষ্টকর হতে পারে।’
লাইব্রেরিয়ান এবং লাইব্রেরি স্টাফদের বিশেষ মানুষদের কিভাবে লাইব্রেরি ব্যবহারে সাহায্য করতে হবে, তার প্রশিক্ষণও দেয়া জরুরি। আরো বেশি সহ্য ক্ষমতাসম্পন্ন হতে হবে, অনুভূতি প্রকাশে সবার মত নন যিনি, তাকে সাহায্য করার মনোভাব থাকতে হবে। সহজেই বই খুঁজে পাওয়ার উপায় থাকতে হবে, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষগুলোর পরিবারের সদস্যদের উপস্থিতিকে সম্মানজনক করার ব্যবস্থাও জরুরি। লাইব্রেরির ইন্টেরিয়র নিয়েও ভাবতে হবে, যেখানে আলোর ব্যবহার কিছুতেই কারোর অনুভূতিকে বিরক্ত করবে না, দেয়ালের টেক্সচার হবে আকর্ষণীয়, মৃদু স্বরের সঙ্গীতও বাজতে পারে, থাকা উচিত নানা রকম খেলনা ও খেলার আয়োজন। অডিও-ভিডিও সহায়তা উপকরণ, লিফলেট এই মানুষদের তো বটেই, সাধারণ জনতাকেও এদের সাথে সহানুভূতিশীল ব্যবহারে সচেতন করে তুলতে সাহায্য করবে।
ডিজিটাল বাংলাদেশ সহজেই এদের জন্য ওয়েবভিত্তিক সামাজিক গল্পের বই সাজিয়ে রাখতে পারে, যাতে ঘুরে ঘুরে হয়রান না হয়ে বই খুঁজে পাওয়াটা সহজ হয়ে যায়। লাইব্রেরি গড়ে তুলতে পারে বিশেষ শিশু ও বয়স্কদের জন্য বই পড়া কার্যক্রম, জনপ্রিয় করে তুলতে পারে বিশেষ বুক ক্লাব। এসব জায়গায় বিশেষ শিশু বা বয়স্ক ব্যক্তি বই পড়ে শোনালে বিশেষ শিশু বা বয়স্ক শ্রোতার জন্য বুঝতে সহজ হবে বেশি। সাধারণ লাইব্রেরির লাইব্রেরিয়ান আর লাইব্রেরি স্টাফরা প্রশিক্ষিত থাকলে সাধারণ পাঠকের পাশাপাশি বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন পাঠকের সত্যিকারের সাহায্যে এগিয়ে আসতে পারবেন। বিশেষভাবে মনে রাখতে হবে, স্টাফদের কাছে এই মানুষগুলো সাহায্য চাইছেন আর স্টাফরা তাদেরকে পাশে দাঁড় করিয়ে রেখে পরিবারের সদস্যের সাথে কথা বলছেন, তা যেন না হয়। সরাসরি যোগাযোগ ঘটাতে হবে এদেরই সাথে, কোনো ভাবেই এদের অনুভূতিতে আঘাত করা যাবে না, কখনোই অসমাপ্ত বৈশিষ্ট্যের বাক্য ব্যবহার করা যাবে না।
লাইব্রেরির কাঙ্খিত নীরবতা বাঙময় হয়ে উঠুক। যে শিশু অটিজমের কারণে ভাষার ব্যবহার করতে পারে না, সে শিশু যোগাযোগ স্থাপন করতে চায় না তা কিন্তু নয়। বরং বই এই শিশুদেরকে দ্রুত ভাষার ব্যবহার শেখানোর কাজটা সহজ করে দেয়। যত ছোট বয়স থেকে বইয়ের সাথে এদের সম্পর্ক গড়ে দেওয়া যায়, তত দ্রুত এদের উন্নতি ঘটে।
সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনে সারা বাংলাদেশের লাইব্রেরিগুলোতে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষের জন্য বন্ধুভাবাপন্ন পরিবেশ গড়ে তোলার কার্যক্রম কি শুরু করা যায় না? যায়, নিশ্চয়ই যায়। লাইব্রেরিয়ান আর লাইব্রেরি স্টাফদের প্রশিক্ষণের বিষয়টিও বাস্তবায়ন করা সম্ভব। যদি সত্যিই আমাদের সবগুলো লাইব্রেরি শিখতে অক্ষম, অটিজমে আক্রান্ত, প্রতিবন্ধী বা বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষদের শেখার আনন্দ দিতে সক্ষম হয়ে যায়, তবে কী দারুণ ঘটনাটাই না ঘটে যাবে!
আর বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষদের কথা না ভেবে উপায় কি? বাংলাদেশে বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় অটিজম শিশুর সংখ্যা বৃদ্ধির হার যত দিন যাচ্ছে ততই বাড়ছে। শহরাঞ্চলের প্রতি এক হাজার শিশুর মধ্যে একজন শিশু অটিজমে আক্রান্ত হচ্ছে। সুসংবাদ হচ্ছে, বাংলাদেশ সরকার প্রতিবন্ধীসহ অটিজমে আক্রান্ত শিশু ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন সব ধরনের শিশু ও বয়স্কদের জন্য নানা ধরনের উন্নয়নমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। বিশ্বের আরো অনেক উন্নত দেশের তুলনায় বরং আমাদের দেশেই এ বিষয়ে অনেক কাজ হয়েছে, আরও হচ্ছে।
এসব শুনে সুস্থ মানুষগুলোই লাইব্রেরিতে যান না, বই পড়েন না, সেখানে বিশেষ মানুষদের কথা ভেবে আর কী হবে, এরকমটি ভাবছেন অনেকেই। কেউ যদি বই পড়ার আনন্দ না নিয়েই নিজেকে দুভার্গা রাখতে চান, সেটা তার ব্যাপার। তবে কেউ যদি বই পড়তে পছন্দ করেন, সেই তার জন্য কেন প্রস্তুতি থাকবে না? লাইব্রেরি যদি মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা বাড়িয়ে দেওয়ার অন্যতম উপায় হয়, যদি বিশেষ মানুষগুলো বইয়ের রাজ্যে সময় কাটিয়ে মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা বাড়িয়ে তোলার সুযোগ পান, তবে সে সুযোগ কেন আমরা তৈরি করব না? আব্দুল্লাহ্ আবু সাঈদ এই বইহীন পরিবেশে বই পড়া কর্মসূচির মধ্য দিয়ে আলোকিত বাংলাদেশ গড়ে তোলার সাহস দেখিয়েছেন, সেই একই রকম সাহস গড়ে তুলবে আমাদের লাইব্রেরির বিশেষ পরিবেশ। সেই পরিবেশ অবৈষম্যমূলক শিক্ষার পরিবেশ, সবার জন্য বই পড়ার আনন্দ উপভোগের পরিবেশ।
লেখক : শিশুসাহিত্যিক
এইচআর/এমএস