ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

একটুখানি চাওয়া

প্রকাশিত: ০৬:০১ পিএম, ২৯ জানুয়ারি ২০১৫

আমি বানিয়ে বানিয়ে গল্প লিখি। বেশিরভাগ সময়েই বাচ্চা-কাচ্চাদের জন্য লিখি বলে আমার লেখালেখিতে খুব দুঃখ কষ্ট বেশি থাকে না। যদি কখনো কাহিনীর খাতিরে অল্প বিস্তর দুঃখ কষ্ট চলে আসে, সেটা লিখতেও আমার খুব সমস্যা হয়। মাঝে মাঝে কাল্পনিক চরিত্রের জন্যই লিখতে লিখতে আমার চোখ ভিজে আসে। যদি কখনো কেউ আমাকে বরিশালের বাসের হেলপার সোহাগ বিশ্বাসের কাহিনীটা দুঃখের গল্প হিসেবে লিখতে বলত, আমি সম্ভবত লিখতে রাজি হতাম না। বলতাম- এটা মোটেও বাস্তব গল্প নয়, কোনো মানুষের জীবনে এত কষ্ট হয় না। কিন্তু আমরা সবাই পত্রপত্রিকায় সোহাগ বিশ্বাসের কাহিনীটুকু পড়েছি। তাই আমরা জানি আমাদের দেশে মানুষের জীবনে এরকম ট্র্যাজেডি হয়।

সোহাগ বিশ্বাসের বয়স মাত্র ১৮। বাবা নেই, মায়ের একমাত্র সন্তান। মা চোখে দেখেন না, সংসারে অর্থকষ্ট। সোহাগ শেষ পর্যন্ত বাসের হেলপারের একটি চাকরি পেয়েছে, বেতন তিন হাজার টাকা। প্রথম যেদিন কাজে যাবে তার উৎসাহের সীমা নেই। মায়ের কাছে দোয়া নিয়ে কাজে যাওয়ার আগে মাকে জিজ্ঞেস করেছে, আজ রাতে কী খেতে চায়, সবকিছু সে কিনে আনবে। সেদিন বরিশালে বিএনপি-জামায়াতের সকাল-সন্ধ্যা হরতাল। সোহাগ বিশ্বাসদের ট্রাকে তাই ভোরবেলা পেট্রোল বোমা মেরে আগুন ধরিয়ে দিল দুর্বৃত্তরা। ড্রাইভার কোনোমতে বেঁচে গেল, ১৮ বছরের সোহাগ বাঁচল না, পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেল। মা চোখে দেখতে পান না বলে সন্তানের পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাওয়া দেহটিকে দেখতে পেলেন না। তার কবর স্পর্শ করে চুপচাপ বসে রইলেন।

আমরা এখন জানি, আগুন ধরিয়ে কাউকে পুড়িয়ে মারতে পারলে তার রেট ২০ হাজার টাকা। সোহাগ বিশ্বাসকে পুড়িয়ে মেরেও সম্ভবত কেউ একজন ২০ হাজার টাকা পকেটে নিয়ে বাড়ি গেছে। কিংবা কে জানে হয়তো বিএনপি-জামায়াতের কর্মীরা নিজেরাই কাজটা করেছে, ২০ হাজার টাকা খরচ করতে হয়নি। তবে একটা বিষয় নিশ্চিত, বিএনপি-জামায়াতের নেতাদের মুখে একটু হলেও উল্লাসের ছাপ পড়েছে যে, অন্তত আরও একজনকে পুড়িয়ে মেরে আন্দোলনটাকে একটু এগিয়ে নেওয়া গেছে। আমি যখন এটা লিখছি, তখন পর্যন্ত ৩৬ জনকে পুড়িয়ে কিংবা বোমা ছুড়ে মারা হয়েছে। আন্দোলনের সাফল্যের জন্য সংখ্যাটিকে কতদূর নেওয়া হবে, আমরা কেউই এখনও জানি না।

এই ৩৬ জনের মৃত্যু তালিকায় মাহবুবুর রহমান বাপ্পীর নামও আছে। সে ছাত্রদলের কর্মী, ঘরে বসে বোমা বানানোর সময় হঠাৎ করে বোমা বিস্ফোরিত হয়ে খুবই খারাপভাবে আহত হয়েছিল। ছিন্নভিন্ন একটা হাতকে কেটে বাদ দিয়েও তাকে বাঁচানো যায়নি। বিএনপির কোনো নেতা সম্ভবত তাদের এই কর্মীর জন্য কোনো সমবেদনা জানাতে আসেননি। তার জন্য নিশ্চয়ই কোনো শোকবই খোলা হয়নি। সেই শোকবইয়ে কেউ স্বাক্ষর দিতে আসেনি। বাপ্পীর মায়ের কথা আমার খুব মনে পড়ে। রাজনৈতিক দলের যে নেতারা তার সন্তানকে এই পথে ঠেলে দিয়েছেন, তিনি কি কখনও তাদের ক্ষমা করতে পারবেন?

খবরের কাগজে একটি অত্যন্ত বিচিত্র খবর চোখে পড়েছে। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সেলিমা রহমান `এজেন্ট ও গোয়েন্দা দিয়ে পেট্রোল বোমা মেরে নিরপরাধ মানুষ পুড়িয়ে তাদের পোড়া দেহ নিয়ে কুৎসিত রাজনৈতিক বেসাতি বন্ধ` করার জন্য সরকারের কাছে আহ্বান জানিয়েছেন। আমি ঠিক জানি না কোন অপরাধটি বেশি জঘন্য_ মানুষকে পুড়িয়ে মারা, নাকি পুড়িয়ে মারার পর এ রকম একটি বিবৃতি দেওয়া!

আমি অবশ্য এ ধরনের রাজনৈতিক নেতাদের খুব একটা দোষ দিতে পারি না। আমাদের দেশের খুব গুরুত্বপূর্ণ খবরের কাগজ কিন্তু পেট্রোল বোমা কে মারছে, সেটা লিখতে খুবই সতর্ক। তারা সবসময় তাদের দুর্বৃত্ত বলে সম্বোধন করে। দেশের গুরুত্বপূর্ণ সংবাদপত্র যেহেতু এখনও জানে না কারা এই অমানুষিক নৃশংসতা করছে, তাহলে সেই সুযোগটি কেন জামায়াত-বিএনপি নেবে না? এ দেশে এত বড় সুযোগ আর কেউ কি তাদের জন্য তৈরি করে দেবে? পত্রপত্রিকা পড়ে মাঝে মধ্যে আমার গলায় আঙুল দিয়ে বমি করে ফেলতে ইচ্ছা করে।

২. আমাদের দেশে রাজনীতির হিসাব খুব সোজা। যদি সোজাসুজি পাওয়া না যায় সেটা জোর করে আদায় করে নিতে হবে। গত বছর ৫ জানুয়ারির নির্বাচনটা জোর করে বন্ধ করার জন্য জামায়াত-বিএনপি অনেক চেষ্টা করেছিল, অনেক বেশি মানুষ পুড়িয়ে মেরেছিল। শুধু স্কুলই পুড়িয়েছিল প্রায় দেড়শ`। তবু একটা নির্বাচন হয়েছিল এবং নির্বাচনের পর মানুষ পুড়িয়ে মারা বন্ধ হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত আমরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিলাম। তারপর থেকে শুনছি আন্দোলন হবে, সেই আন্দোলনে বেআইনি সরকার উৎখাত করা হবে। আমরা সবাই সেই আন্দোলন দেখার জন্য অপেক্ষা করে ছিলাম। কখনও ভাবিনি আন্দোলনের অর্থ ঘরে বসে অবরোধ-হরতালের ডাক দেওয়া আর সেই অবরোধ-হরতালের ডাকটি যেন মানুষের কানে যায়, সে জন্য পথেঘাটে যেখানে সম্ভব পেট্রোল বোমা দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে মারা। যত বেশি মানুষ মারা যাবে, পঙ্গু করা যাবে, তত সফল আন্দোলন। রাজনীতির জন্য আর সাধারণ মানুষের সমর্থনের প্রয়োজন নেই। দলের মানুষকে নৃশংস খুনি হিসেবে গড়ে তুলতে পারলেই হলো। পুলিশ-র‌্যাব-বিজিবির ভয় থাকলে টাকা দিয়ে কাজ সেরে নেওয়া যায়। এক একজন মানুষকে খুন করার জন্য ২০ হাজার টাকার চুক্তি। এ দেশে টাকার অভাব নেই। এক কোটি টাকার বাজেট করা হলে শ`পাঁচেক মানুষকে নিশ্চিন্তে পুড়িয়ে মারা যাবে, কী সহজ একটা হিসাব।

রাজনীতির এই হিসাব আমাদের দেশে ছিল না, এটা নতুন আনা হয়েছে। আফ্রিকায় বোকো হারাম ও মধ্যপ্রাচ্যে আইএস এ রকম অবলীলায় মানুষ মারতে পারে। আমাদের খুবই দুর্ভাগ্য, এ দেশের বিএনপির মতো বড় একটি রাজনৈতক দল জামায়াতের সঙ্গে একত্র হয়ে গেল! বিএনপির রাজনৈতিক চরিত্রটি ধীরে ধীরে পাল্টে যাচ্ছে। এখন মানুষকে পুড়িয়ে মারা আর নৃশংসতা নয়, মানুষ হত্যা নয়_ এটা খুবই সাধারণ একটা রাজনৈতিক প্রক্রিয়া। আমার সঙ্গে বিএনপির কোনো রাজনৈতিক নেতার পরিচয় নেই। থাকলে তার একটি আঙুলকে ধরে তার নিচে একটা ম্যাচের কাঠি জ্বালিয়ে দেখাতাম, পুড়ে গেলে কী অমানুষিক যন্ত্রণা হয়। তারা এ দেশের সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ, শিশু-মহিলা সবাইকে এভাবে পুড়িয়ে যাচ্ছেন, এর মাঝে ৩৬ জন মারা গিয়ে যন্ত্রণার অবসান ঘটিয়েছেন। বেঁচে থেকে যন্ত্রণায় ছটফট করছেন আরও শত শত মানুষ।

৩. বিশ্ব ইজতেমা এ দেশের সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষের জন্য অনেক বড় একটি ব্যাপার। টেলিভিশনে একজনের বক্তব্য শুনছিলাম। হতদরিদ্র মানুষটি বলছিলেন, `আমার তো আর হজে যাওয়ার মতো টাকা নেই, তাই কোনোদিন হজে যেতে পারব না। শুনেছি, এটা হজের পর সবচেয়ে বড় সম্মেলন, তাই এখানে এসেছি।` আমরা সবাই ভেবেছিলাম, নিশ্চয়ই বিশ্ব ইজতেমার সময়টুকুতে অবরোধ তুলে নেওয়া হবে। তুলে নেওয়া হয়নি। শুধু যে তুলে নেওয়া হয়নি তা নয়, বিশ্ব ইজতেমা থেকে ফিরে আসা মুসলি্লদের বাসেও পেট্রোল বোমা মারা হয়েছে, নীলফামারীতে এভাবে একজন বিএনপি নেতার বাবা পুড়ে মারা গেছেন। বিএনপির সেই নেতা হতবাক হয়ে আছেন। এই ২৫ তারিখে সরস্বতী পূজা ছিল, কেউই আশা করেনি পূজার জন্য অবরোধ তুলে নেওয়া হবে; কিন্তু অবরোধের সময় সেদিন আলাদাভাবে হরতাল ডেকে দেওয়া হবে_ সেটি কেউ বুঝতে পারেনি। সিলেটে সেদিন হরতাল ছিল। সামনে এসএসসি পরীক্ষা। অবরোধ-হরতালের কারণে `ও` লেভেল, `এ` লেভেল পরীক্ষাগুলো এ দেশে বাতিল করতে হয়েছে। কাজেই এসএসসি পরীক্ষার সময় অবরোধ-হরতাল তুলে নিয়ে ছেলেমেয়েদের শান্তিতে পরীক্ষা দিতে দেওয়া হবে_ সে রকম মনে হয় না। এক-দু`দিনের অবরোধ-হরতাল হলে পরীক্ষা এক-দু`দিন আগে-পিছে নেওয়া যায়। অনির্দিষ্টকালের অবরোধ-হরতাল থাকলে পরীক্ষা আগে-পিছে নেওয়া যায় না। মনে হয়, এই অবরোধ-হরতালের মাঝেই পরীক্ষা নেওয়া হবে। মা-বাবা তাদের সন্তানদের পরীক্ষা দিতে পাঠিয়ে দুরু দুরু বক্ষে অপেক্ষা করবেন। এসএসসি পরীক্ষার সময় সন্ত্রাস-তাণ্ডব আরও বেড়ে যাবে কি-না আমরা জানি না। যারা এই সন্ত্রাস-তাণ্ডব-নৃশংসতা করছে, তাদের বলে কোনো লাভ নেই। তাই সে চেষ্টাও করছি না। খোদার কাছে দোয়া করি, আমাদের দেশের এই ছেলেমেয়েরা যেন ঠিকভাবে পরীক্ষা দিয়ে সুস্থ দেহে তাদের বাবা-মায়ের কাছে ফিরে যেতে পারে।

৪. আমরা খুব দুঃসময়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। প্রতিদিন খবরের কাগজে মানুষ পুড়িয়ে মারার ছবি দেখে, মানুষকে হত্যা করার খবর পড়ে দিন শুরু করতে হয়। মাঝে মধ্যে খবরের কাগজটি সরিয়ে রাখি, যেন চোখের সামনে থেকে সরিয়ে নিলেই সেই দুঃসহ ঘটনাগুলো জীবন থেকে সরে যাবে। তারপরও আমরা আশায় বুক বেঁধে আছি, এ দেশ এর থেকে অনেক বড় বিপর্যয়ের পরও মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। মানুষ হত্যার এই নৃশংসতা নিশ্চয়ই এক সময় বন্ধ হবে। মা তার সন্তানকে স্কুলে পাঠানোর পর একটুখানি শান্তিতে থাকতে পারবেন। ট্রাক ড্রাইভারের স্ত্রী, হেলপারের আপনজনকে ভয়াবহ আতঙ্ক নিয়ে অপেক্ষা করতে হবে না। একজন বাসযাত্রীকে পুলিশ প্রহরায় পথ চলতে হবে না। একজন ট্রেনযাত্রীকে নিজের জীবনটা হাতে নিয়ে ট্রেনে উঠতে হবে না।

সাধারণ মানুষের জন্য গভীর ভালোবাসার কথা মনে করে এই নৃশংসতা আর তাণ্ডব বন্ধ হবে, সেটা আমরা কেউ মনে করি না। কিন্তু একটা রাজনৈতিক দল রাজনীতির কথা বলে এই হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যে এক সময় রাজনৈতিক জগতে পুরোপুরি মূল্যহীন হয়ে যেতে পারে, অন্তত সেই কথাটি মনে রেখে কি তারা এই হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করতে পারে না?

এ দেশের মানুষ তো খুব বেশি কিছু চাইছে না। শুধু একটুখানি নিরাপদ জীবন চাইছে, সেটি কি খুব বেশি চাওয়া হলো?

লেখক :কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট

আরএস