বিদেশে বাংলাদেশ বিরোধী জঙ্গি নেটওয়ার্ক
সেপ্টেম্বরও যাচ্ছে। হলি আর্টিজান হামলার প্রায় তিন মাস পার হতে চলেছে। আবার কিছুটা সজাগ হতে শুরু করেছে গুলশান। কিন্তু পুরোপুরি হয়নি। তবে এর মধ্যেই কস্তুরি, ভিলেজসহ বেশ কিছু রেস্তোরাঁ বন্ধ হয়ে গেছে, বন্ধ হয়েছে ছোট ছোট বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। নতুন অর্থ বছরের প্রথম তিনের এই আঘাত অনেক সুদূরপ্রসারি।
গত এপ্রিলে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট-এর মুখপাত্র বলে পরিচিত দাবিক ম্যাগাজিনে শেখ আবু ইব্রাহিম আল হানিফ নামের এক ব্যক্তিকে আইএসের বাংলাদেশি শাখার প্রধান বলে পরিচিত করা হয়। পরে সেই হানিফ সম্পর্কে নতুন তথ্য দেয় কানাডীয় সংবাদমাধ্যম ন্যাশনাল পোস্ট। বলা হয়, আবু ইব্রাহিম আল হানিফের প্রকৃত নাম তামিম চৌধুরী। তিনি ছিলেন একজন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডীয় নাগরিক। এক সময় অন্তারিও উইন্ডসর শহরের বাসিন্দা ছিলেন তিনি। সেই তামিম খতম হয়েছে নারায়ণগঞ্জে। তার ডেপুটি মেজর (অব:) জাহিদুল ইসলাম মারা গেছে মিরপুরের রূপনগরে।
কানাডার নাগরিক তামিম। চাকুরিসূত্রে কানাডা গিয়ে সন্ত্রাসী হয়েছে মেজর জাহিদ। খুঁজলে এমন অনেক সন্ত্রাসী পাওয়া যাবে যারা বিদেশে গিয়ে সন্ত্রাসের দীক্ষা নিয়েছে। এরাই হিন্দু পুরোহিত, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, ধর্মনিরপেক্ষ মুসলমানসহ মানুষ খুন করছে দেশের নানা প্রান্তে।
কিছুদিন আগে জানা গেলো জঙ্গিতৎপরতার অভিযোগে বেশ কয়েকজন বাংলাদেশ নাগরিককে আটক করেছে সিঙ্গাপুর সরকার। এবার তাদের আসল তৎপরতার খবর আসতে শুরু করেছে। তারা পরিকল্পনা করছিল দিনাজপুর থেকে ঘোষণা দেয়া হবে বাংলাদেশ ইসলামিক স্টেটের। আমরা জেনেছি ব্রিটেনে যাওয়া বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত তরুণ কিভাবে জঙ্গি হয়ে উঠছে।
সিঙ্গাপুরে ২৬ জন বাংলাদেশ নাগরিক আটক হয়েছিলেন দেশটির অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা আইনে। সিঙ্গাপুরের গোয়েন্দারা বলছেন গ্রেপ্তার হওয়া ২৬ জন বাংলাদেশে সশস্ত্র জিহাদের কথা ভাবছিল। তারা বাংলাদেশে জঙ্গিগোষ্ঠীর কাছে টাকাও পাঠিয়েছে। এসব ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে দেশে ফেরত পাঠানোর এক মাসের বেশি সময় পর তাদের নাম ও ছবি সিঙ্গাপুরের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। তাতে বলা হয়, জঙ্গি-সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে গত বছরের ১৬ নভেম্বর থেকে ১ ডিসেম্বরের মধ্যে ২৭ জন বাংলাদেশের নাগরিককে গ্রেপ্তার করে সিঙ্গাপুর পুলিশ। তাদের মধ্যে ২৬ জনকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয়। বাকি একজন সিঙ্গাপুরের কারাগারে আছে। সে ২৬ জনের দলে ছিল না, তবে উগ্র মতাদর্শের দীক্ষা নেওয়ার পথে ছিল এবং একজন উগ্রপন্থী ধর্মগুরুর সহযোগী ছিল।
এগুলো সবই আমাদের জন্য ভয়ানক উদ্বেগের খবর। বিদেশে গিয়ে শ্রমজীবী এই মানুষ বা শিক্ষার্থীরা যদি এমন সন্ত্রাসী হয়ে উঠে, তবে এদেশের ভবিষ্যত নিয়ে বড় ভাবনা আছে। তার চেয়েও বেশি আছে, আমাদের গ্রামীণ সমাজ কাঠামোয় এরা যে বীজ রোপন করে চলেছে তা নিয়ে।
কেমন করে এ পথে যায় বা যাচ্ছে এরা? তথাকথিত বয়ান, ইসলামিক পাঠচক্র, ওয়াজ বা তাফসিরের নামে এদেশের ধর্ম ব্যবসায়ীরা এখন বিদেশে বসবাসরত আমাদের সহজ সরল মানুষকে টানছে মগজ ধোলাইয়ের জন্য। বিদেশে গিয়ে মগজ ধোলাই আরো বেশি করে হচ্ছে। সিঙ্গাপুর, ব্রিটেন বা কানাডা, সবখানেই এরা উগ্র মতাদর্শী সংঘবদ্ধ একটি গোষ্ঠীর পাঠচক্র খপ্পরে পরছে। তারা বিদশে বসে বাংলাদেশে সশস্ত্র জিহাদের কথা ভাবে।
এটুকু হলেও যতটা চিন্তার বিষয়, তার চেয়ে আরো ভয়ংকর খবর যেটি উন্মোচিত তা আরো উদ্বেগের। এরা নিঃশব্দ খুনের কৌশল শিখছে। ঠাণ্ডা মাথায় নিখুঁত দক্ষতায় মানুষ হত্যার কথা ভাবনায় নিচ্ছে এরা। এবং আমরা দেখেছি কি নিখুত দক্ষতায় ঢাকায় একটি মার্কেটে নিঃশব্দে প্রকাশক দীপনকে হত্যা করা হয়েছে।
এখন থেকে বাংলাদেশের শ্রমিক, শিক্ষার্থী, এমনকি চিকিৎসার জন্য যারা বিদেশ যায় তারাও কঠোর নজরদারির মধ্যে থাকবে। জনশক্তি রপ্তানিতে এই ঘটনা নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম এই খাত এখন বড় ঝুঁকির মধ্যে। বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে দেখা হবে আশা করছি। বিদেশে জনশক্তি রপ্তানির সময়, এসব কর্মীকে বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ দেয়ার রেওয়াজ আছে। কাজের প্রশিক্ষণ দিতে হবে, আচার ব্যবহারের প্রশিক্ষণ দিতে হবে, কিন্তু মনে হচ্ছে সিলেবাসে নতুন কিছু বিষয় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তাদের মগজে ধারণা দিতে হবে, বিদেশে গিয়ে এসব মাহফিলে যাওয়া কতটা ঝুঁকির। নিজের ধর্ম নিজের মতো করে পালন করা আর কারো দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পালন করা এক নয়। তাফসিরের নামে দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর নোংরামী শোনা, বা অন্য কারো জ্বালাময়ী বক্তৃতা শোনার মধ্যে সওয়াব নেই, আছে সন্ত্রাসী হয়ে উঠার ঝুঁকি।
যেসব দেশে আমাদের মানুষগুলো যাচ্ছে সেখানে পাকিস্তানি, আফ্রিকান, পশ্চিম এশিয়ার নাগরিকদের সাথে উঠাবসা কতটা ঝুঁকিপূর্ণ তা এদের বুঝিয়ে দিতে হবে দেশ ছাড়ার আগেই। সজাগ থাকা জরুরি আমাদের দূতাবাস ও কূটনৈতিক মিশনগুলোকেও। বেশি বেশি রেমিটেন্সের সন্তুষ্টি আমাদের থাকবে না যদি এরা টাকা পাঠানোর পাশাপাশি বিদেশ সন্ত্রাস আর সন্ত্রাসী মতবাদ প্রচার করতে তাকে। তাই প্রয়োজনে দূতাবাস কর্মকর্তারা বাংলাদেশ নাগরিকদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ বা বৈঠকের আয়োজন করবেন। প্রয়োজন গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচারণা। তেমনি ভাবে পড়াশোনা বা কাজের জন্য যারা ইয়োরোপ বা পশ্চিমা দেশে যাচ্ছে তাদের অনেকেই সাইফুল হয়ে উঠছে। এমনিতেই খবর যা পাচ্ছি তা ভয়ানক। পশ্চিমা উন্নত গণতানন্ত্রিক উদার পরিবেশে থেকেও অনেক বাংলাদেশি নাগরিক গোড়া মৌলবাদি হয়ে পড়ছে। এদের অনেকের সন্তানেরা ইংরেজী জানে, সেই দেশের ভাষা জানে, আর জানে আরবী, কিন্তু বাংলা জানেনা।
সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও পাকিস্তানে বসেই বাংলাদেশে শক্তিশালী জঙ্গি নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে দেশি জঙ্গি নেতারা। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে সেখানে বসে নানা ধরনের জঙ্গি হামলার নির্দেশনা দিচ্ছে তারা। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, অভিজাত পরিবারের ছেলেদের স্টুডেন্ট ভিসা দিয়ে প্রথমে সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়া নিয়ে যাচ্ছেন জঙ্গি নেতারা। সেখানে মোটিভেশন দিয়ে জঙ্গি প্রশিক্ষণের জন্য সিরিয়া, তুরস্কসহ বিভিন্ন দেশে পাঠান। প্রশিক্ষণ নিয়ে বাংলাদেশে ফিরেই বিভিন্ন স্থানে হামলা করছেন তারা। পুলিশের দাবি, গুলশানের হলি আর্টিজান ও কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় হামলাসহ সম্প্রতি সময়ের সবগুলো হামলায় জড়িত জঙ্গিরা বিদেশ থেকে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত। গুলশান হামলায় নিহত জঙ্গি সদস্য নিবরাস ইসলামসহ অন্তত ৭ জঙ্গি কয়েক মাস আগে জঙ্গি প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে ফিরেন। বিদেশে থাকা জঙ্গি নেতারা তাদের স্টুডেন্ট ভিসা দিয়ে মালয়েশিয়া নিয়ে যান। মোটিভেশনের পর থেকেই এসব তরুণ জঙ্গি সদস্যরা পরিবারে সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়।
বাংলাদেশ এখনো এমন দেশ যেখানে খুব সহজেই ধর্ম ব্যবসায়ীরা চাইলেই ধর্মের নামে হাজারো তরুণকে উগ্রপন্থায় সহিংস করে তুলেত পারে। মাদ্রাসা ছাত্র, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া তরুণদেরও ধর্মের দোহাই দিয়ে ইসলাম গেল গেল রব তুলে ভাতৃঘাতী পথে নামিয়ে দিতে পারে। হেফাজতে ইসলাম ২০১৩ সালের ৫ মে আমাদের সেটা জানিয়ে দিয়েছে। বিদেশে বসে যারা জঙ্গি তৎপরতা চালাচ্ছে তাদের বিষয়ে তদন্ত করে দেখা দরকার। সমাজেরও উপলব্ধি প্রয়োজন।
এইচআর/এমএস