পাকিস্তানের আঁতে ঘা
একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের দায়ে ঘাতক মীর কাসেমের ফাঁসির দণ্ড কার্যকর হওয়ার পর পাকিস্তান যে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে সেটি শুধু ঔদ্ধত্যপূর্ণই নয়, রীতিমত কূটনীতিক শিষ্টাচার বহির্ভূত। মীর কাসেম আলীর ফাঁসি কার্যকর করার পর এক বিবৃতি দিয়েছে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এতে বলা হয়েছে, প্রশ্নবিদ্ধ বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামির নেতা ও শীর্ষ অর্থ জোগানদাতা মীর কাসেম আলীর ফাঁসি কার্যকরের ঘটনায় পাকিস্তান ‘গভীরভাবে মনক্ষুণ্ণ’। পাকিস্তানের ওই বিবৃতির পর রোববার বিকেলে ঢাকায় নিযুক্ত দেশটির ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার সামিনা মেহতাবকে তলব করেছে বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এ সময় তাকে বলা হয়, একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এ নিয়ে পাকিস্তানের কোনো মতামত দেয়ার সুযোগ নেই। এছাড়া পাকিস্তানের জামায়াতে ইসলামীও শনিবার রাতে কার্যকর হওয়া মীর কাসেম আলীর ফাঁসিকে ‘বিচারিক হত্যাকাণ্ড’ বলে উল্লেখ করে বিক্ষোভ করেছে।
পাকিস্তানের রাজাকারপ্রীতি নতুন নয়। এর আগেও দুই মানবতাবিরোধী অপরাধী জামায়াত নেতা মুজাহিদ ও বিএনপি নেতা সাকা চৌধুরীকে ফাঁসি দেওয়ায় পাকিস্তান উষ্মা প্রকাশ করেছিল। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। একাত্তরে পাক হানাদার বাহিনীর দোসরদের ফাঁসির দণ্ডে পাকিস্তান ক্ষুব্ধ হবে, ব্যথিত হবে, মর্মাহত হবে তাদের দিক থেকে এটাই স্বাভাবিক। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। এর আগেও আরেক যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকরের পর পাকিস্তানের পার্লামেন্টে নিন্দা প্রস্তাব পাস হয়েছে। এসবের মধ্য দিয়ে পাকিস্তান কার্যত স্বীকার করে নিচ্ছে যে একাত্তরে কাসেম, সাকা, মুজাহিদ, কাদের মোল্লা গংরা পাকিস্তানের পক্ষ হয়ে এদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করেছে, ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে, মা-বোনদের সম্ভ্রমহানি করেছে। হত্যা করেছে এদেশের শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবীদের। তাই এদের ফাঁসি হলে পাকিস্তানের আঁতে ঘা লাগে। সে কারণেই তারা প্রতিক্রিয়া দেখায়। আর এই প্রতিক্রিয়া যে তাদের বন্ধুদের আরও বিপদে ফেলে সেটা জানলে পাকিস্তান হয়তো এ ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখাতো না। কারণ বন্ধুর বিপদে সহায়তা করাই তো বন্ধুর ধর্ম। তা যদি এমন পেয়ারের বন্ধু হয়!
আখেরে পাকিস্তান বরং তাদের প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের স্বরূপ আরো উন্মোচন করে দিচ্ছে। দেশের মানুষ নতুন করে বুঝতে পারছে যে পাকিস্তানের কতোটা পেয়ারা বান্দা এই মীর কাসেম সাকা-মুজাহিদরা। তবে পাকিস্তানের এই ঔদ্ধত্য মেনে নেওয়ার কোনো কারণ নেই। এই ধৃষ্টতার জোরালো প্রতিবাদ জানানো উচিত। বাংলাদেশ সরকার পাকিস্তানের ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনারকে ডেকে ইতিমধ্যেই কড়া ভাষায় জোরালো প্রতিবাদ জানিয়েছে। এছাড়া আন্তর্জাতিক পর্যায়েও আরও বেশি করে পাকিস্তানের একাত্তরের বর্বরতার কথা, হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নি-সংযোগের কথা জানানো প্রয়োজন।
পাকিস্তানকে এটা পরিষ্কার ভাষায় জানিয়ে দিতে হবে যে, একটি স্বাধীন দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে তারা কোনোভাবেই ঔদ্ধত্যপূর্ণ মন্তব্য করতে পারে না। তাছাড়া একাত্তরের ভূমিকার জন্য পাকিস্তানের অবশ্যই ক্ষমা চাইতে হবে। ত্রিপক্ষীয় চুক্তি অনুযায়ী পাকিস্তানের যে ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীর বিচার করার কথা ছিল তাদেরকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে। ব্যাখ্যা চাইতে হবে কেন এতোদিনেও তাদের বিচার করা হলো না। এ ব্যাপারে আন্তর্জতিক সম্প্রদায়কেও এগিয়ে আসতে হবে। কারণ যুদ্ধাপরাধ কিংবা মানবতাবিরোধী অপরাধের কোনো সীমা নেই।
পাকিস্তান একাত্তরের পরাজিত শক্তি। তাদের উল্লম্ফন শেষ পর্যন্ত এটাই প্রমাণ করে যে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশ একাত্তরের যেসব ঘাতকদের বিচার করছে তারা প্রকৃতপক্ষেই পাকিস্তানের বন্ধু। বাংলাদেশকে তারা এখনো মেনে নিতে পারেনি। তাই তাদের বিচার করে উপযুক্ত শাস্তি প্রদানই যথাযথ।
এইচআর/এমএস