ড. ইউনূস ও বিএনপির জন্ম
বিদেশি মিডিয়ায় বাংলাদেশের একমাত্র নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে নিয়ে কোনো সংবাদ হলেই দেখি ঢাকার মিডিয়া ঝাঁপিয়ে পড়ে। হোক সেই সংবাদ পুরানো বা নতুন। কিন্তু ইউনূসকে নিয়ে ঢাকার মিডিয়াকে নিজ উদ্যোগে কোনো সংবাদ করতে দেখি না। অবশ্য ঢাকাইয়া মিডিয়ার সাথে তিনি কথাও বলেন না। গত ২৪ আগস্ট আমেরিকান বার্তা সংস্থা এসোসিয়েটেড প্রেস খবর পরিবেশন করল যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক দলের প্রার্থী হিলারি ক্লিনটন পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালে তাদের পারিবারিক প্রতিষ্ঠান ক্লিনটন ফাউন্ডেশনে ড. মুহাম্মদ ইউনূসও অনুদান দিয়েছেন। এনিয়ে কম হৈ চৈ হয়নি আমেরিকা ও বাংলাদেশে।
এপির খবরে বলা হয়েছে, নতুন এই তথ্যের ফলে যুক্তরাষ্ট্রের একজন প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে হিলারি ক্লিনটনের নীতিকথার বিষয়টিকে আবারও প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আসলে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনকে ঘিরে নানা রকম সংবাদ গণমাধ্যমে তুলে আনার প্রতিযোগিতার অংশ হিসেবেই ওই সংবাদটি পরিবেশন করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যমগুলো প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কেউ ডেমোক্রেটদের আর কেউ রিপাবলিকানদের পক্ষে সরাসরিই অবস্থান নেয়। সেটা যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যমের পুরানো রীতি। এবার যুক্ত হয়েছে হিলারি ক্লিনটনের সাথে ড. ইউনূসের ব্যক্তিগত সম্পর্কের জের ধরে সরকারি কোষাগারের অর্থ লেনদেন ইস্যু।
এপি বলেছে, গ্রামীণ আমেরিকা নামের সংস্থা যার চেয়ারম্যান ড. ইউনূস, ক্লিনটন ফাউন্ডেশনে এক লাখ থেকে আড়াই লাখ ডলার অনুদান দিয়েছে। গ্রামীণ রিসার্চ নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠান, যেটির চেয়ারম্যানও ড.ইউনূস, সেই প্রতিষ্ঠান থেকেও ২৫ হাজার থেকে ৫০ হাজার ডলার অনুদান দেয়া হয়েছে। এপির রিপোর্টেই বলা হয়েছে ব্যাংকটির মুখপাত্র জানিয়েছেন ক্লিনটন গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ সম্মেলনে অংশগ্রহণের ফি হিসাবে ওই ডলার দেয়া হয়েছে।
এপি পরিবেশিত ওই রিপোর্টে ইউনূস সম্পর্কে যে তথ্য দেয়া হয়েছে সেটা আমরা গত এপ্রিলেই জানতে পেরেছি। তখন যুক্তরাষ্ট্রেরই গণমাধ্যমে ওঠে এসেছিল সেই তথ্য। গত ১৭ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রেরই গণমাধ্যমে খবর এসেছিল গ্রামীণ ব্যাংক ও এর সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো অন্তত ১৩ মিলিয়ন ডলার বা একশো কোটি টাকারও বেশি অনুদান দিতে হিলারি ক্লিনটন ভূমিকা রেখেছিলেন, তখন তিনি ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। যুক্তরাষ্ট্রের উন্নয়ন সংস্থা ইউএসএআইডির মাধ্যমে ১৮টি কিস্তিতে এই অনুদান দেওয়া হয়। ওই সংবাদেই বলা হয়েছিল ড. মুহাম্মদ ইউনূস এক থেকে তিন লাখ মিলিয়ন ডলার ক্লিনটন ফাউন্ডেশনকে অনুদান হিসেবে দিয়েছেন।
এই খবর বাংলাদেশি মিডিয়াও লুফে নিয়েছিল। তখনই ইউনূস সেন্টার থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো এক প্রতিবাদলিপিতে বলা হয়েছে, ড. মুহাম্মদ ইউনূস মার্কিন সরকারের কোনও টাকা নেননি। ‘ড. ইউনূস ও গ্রামীণ নাম ব্যবহারকারী অন্য প্রতিষ্ঠান এই অনুদান নিয়েছে। প্রতিবাদে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, ইউনূস ক্লিনটন ফাউন্ডেশনকে একবার ১ লাখ ডলার, আরেকবার ৩ লাখ ডলার অনুদান দেওয়ার তথ্য সম্পূর্ণ মিথ্যা। গ্রামীণ আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভে যোগদান করার জন্য ফি বাবদ টাকা দিয়েছেন। ক্লিনটন গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ একটা আন্তর্জাতিক সম্মেলন। এখানে ফি দিয়ে যোগদান করতে হয়। গ্রামীণ আমেরিকার প্রেসিডেন্ট তাই ফি দিয়েছেন।
অর্থাৎ ইউনূস প্রতিবাদ করেছিলেন আসলে তিনি ব্যক্তিগতভাবে কোনো টাকা নেননি এই যুক্তিতে। এসব অনুদান যে ব্যক্তির নামে আসে না সেটা কে না জানে। কোনো না কোনো প্রতিষ্ঠানের নামেই আসে, আর ইউনূস সেটা স্বীকারও করেছেন যে তার নামেই নানা প্রতিষ্ঠান সেই টাকা নিয়েছে, তবে তারই প্রতিষ্ঠান থেকে যে ক্লিনটন ফাউণ্ডেশনকে টাকা দেয়া হয়েছিল সেটাও তিনি স্বীকার করেছেন। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র থেকে হিলারি ক্লিনটনের প্রভাবে টাকা এনে তিনি আবার হিলারি ক্লিনটনেরই পারিবারিক ফাউন্ডেশনে জমা দিয়েছেন। তার প্রতিষ্ঠান নিয়েছে ১০০ কোটি টাকা আর তার প্রতিষ্ঠান দিয়েছে ২০ কোটি টাকা।
এপ্রিলের সেই সংবাদটি আবার আগস্টে এপি পরিবেশন করলো আর বিবিসি বাংলাও লুফে নিল সেই সাথে বাংলাদেশের মিডিয়াও ঝাঁপিয়ে পড়লো। এর কারণ কী ইউনূসকে বিতর্কিত করে তোলা নাকি, ইউনূসের যেকোনো কিছুই সংবাদমূল্য আছে সে কারণে, নাকি আওয়ামী লীগ সরকারের সাথে তার বিরোধ, নাকি তিনি রাজনীতিতে নামতে চেয়ে সেনা সহায়তায় রাজনীতিবিদদের বের করে দিতে চেয়েছিলেন বলে, নাকি তার সাফল্যে ঈর্ষান্বিত হয়ে? নাকি ইউনূস মানেই সংবাদ? এ নিয়ে ছোটখাট একটি গবেষণা সাংবাদিকতার নবীন ছাত্ররা করতেই পারে।
আওয়ামী লীগ ঘরানার মিডিয়া ইউনূসের আরো একটি সংবাদ কেন লুফে নিল না সেটাও বোধগম্য হলো না। আওয়ামী লীগের নীতি নির্ধারকদের একটা ধারণা আছে যে ইউনূস বিএনপির প্রতি একটু সহানুভূতিশীল। আওয়ামী লীগের প্রতি তার ধারণা নেতিবাচক। কিন্তু এবারতো স্পষ্ট করে দিয়েছেন গণস্বাস্থ্যের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ। তিনি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে লেখা খোলাচিঠিতে বিএনপির জন্মের ইতিহাস সংক্ষেপে তুলে ধরে বলেছেন,‘আপনাদের গঠনতন্ত্র সৃষ্টি হয়েছিল ১৯৭৮ সনে আগস্ট মাসে। ঘোষণাপত্র ও গঠনতন্ত্র তৈরিতে জিয়াউর রহমান কে প্রভাবিত করেছিলেন প্রবাসী সরকারের বৈদেশিক সচিব খন্দকার মোস্তাক আহমেদের প্রিয়জন মাহবুবুল আলম চাষী, প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের অত্যন্ত ঘনিষ্ট সচিব ড. এম এ সাত্তার এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।’
অর্থাৎ ড. ইউনূসের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক নতুন নয়। বিএনপির জন্মলগ্ন থেকেই তিনি আছেন। এটারও কোনোদিন রিপোর্ট হতে দেখিনি। জাফরুল্লাহ এই তথ্য না দিলে ইতিহাসের একটি দিক অজানাই থেকে যেত। আর আওয়ামী লীগের নীতি নির্ধারকদের সঙ্গে যে ইউনূসের সম্পর্ক খারাপ ছিল তাও না। বিশেষ করে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার পর ইউনূস সম্পর্কে তাদের ধারণার আমূল পাল্টে যায়। তখন আওয়ামী লীগ ঘরানার বুদ্ধিজীবীদের উদ্যোগে ওই গ্রেনেড হামলার নিন্দা জানিয়ে গণমাধ্যমে একটি বিবৃতি দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়। দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের দিয়ে দলমত নির্বিশেষে ওই বিবৃতিতে সই জোগাড় করা হয়। ড. ইউনূসের সই নিতে কয়েকদফা চেষ্টা করা হয়। এজন্য দুইদিন বিবৃতিটি আটকেও রাখা হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ইউনূস ওই নিন্দা বিবৃতিতে সই করেননি।
তিনি যে নোবেল প্রাইজ পেয়ে বলেছিলেন পুরস্কারের অর্থ ১৪ লাখ ডলারের একটা অংশ খরচ করবেন গরীবদের জন্য। কমদামে উচ্চ পুষ্টিমান সম্পন্ন খাদ্য উৎপাদনের ব্যবসা খুলবেন আর বাকি টাকা দিয়ে গরীবদের জন্য চোখের হাসপাতাল গড়বেন, বাংলাদেশের মিডিয়ায় এটা নিয়ে কোনো ফলোআপ রিপোর্ট দেখলাম না। অবশ্য ড. ইউনূস গরীবদের জন্য পুষ্টি সরবরাহের ব্যবসা শুরু করে দিয়েছিলেন নোবেল প্রাইজ পাওয়ার ৬ মাস আগেই। ফরাসি কোম্পানি ডানোনের সাথে ২০০৬ সালের মার্চেই যৌথভাবে শুরু করেন গ্রামীণ ডানোন ফুডসের। তবে গরীবদের জন্য চোখের হাসপাতাল করেছেন কিনা সেই ফলোআপ রিপোর্ট দেখছিনা।
চক্ষু হাসপাতাল আর বিএনপির গঠনতন্ত্র তৈরিতে ইউনূসের ভূমিকা কেমন ছিল আশা করি কোন দেশি অনুসন্ধানী রিপোর্টার সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করবেন।
লেখক : সম্পাদক, ডিবিসি নিউজ
এইচআর/পিআর