কোথায় হবে জানি না, হল চাই
১৯৮৮ সালে ঢাকা এসে আমি প্রথম ভর্তি হয়েছিলাম তখনকার জগন্নাথ কলেজে। মূল ক্যাম্পাসে ঢুকে বা দিকের ভবনের নিচতলায় ছিল বাংলা বিভাগ। তখন বিভাগীয় প্রধান ছিলেন মমতাজউদ্দিন আহমেদ। তিনি শুধু শিক্ষকই ছিলেন না, ছিলেন প্রখ্যাত নাট্যকার ও অভিনেতা। মফস্বল শহর থেকে ঢাকায় পড়তে এসেই মমতাজউদ্দিনের মত তারকা অভিনেতাকে শিক্ষক হিসেবে পেয়ে আমার মুগ্ধতা যেন শেষ হয় না। বছর দুয়েক সেখানে পড়ার সুবাদে আমি জেনেছি, মমতাজউদ্দিন আহমেদ শুধু অসাধারণ অভিনেতা বা নাট্যকারই নন, অনুকরণীয় শিক্ষকও বটে। বছর দুয়েক জগন্নাথে অনার্স পড়ে পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় প্রিলিমিনারিতে ভর্তি হই। তবে মমতাজ স্যারের প্রতি সেই মুগ্ধতা আমার শেষ হয়নি এখনও, রেশ রয়ে গেছে। ক্লাশরুমে প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার বাইরে গিয়ে মমতাজ স্যার আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন জ্ঞানের বিশাল জগতের সাথে। ক্লাশে পড়িয়েছেন শরৎচন্দ্রের ‘গৃহদাহ’, সেই আমলে ভিসিআর ভাড়া করে এনে আমাদের দেখিয়েছেন ‘গৃহদাহ’ সিনেমা, দেখিয়েছেন ‘অন্তর্জলী যাত্রা’। বিশিষ্টজনদের আমন্ত্রণ করে এনেছেন বিভাগে। আমাদের সুযোগ হয়েছে তাঁদের সাথে মতবিনিময়ের।
বর্তমানের জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শুধু বাংলাদেশের নয়, গোটা ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন বিদ্যাপীঠ। ১৮৫৮ সালে প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্ম স্কুল ১৮৭২ সালে নাম বদলে হয় জগন্নাথ স্কুল। বালিয়াটির জমিদার কিশোরীলাল চৌধুরী তার পিতার নামে নামকরণ করেন এই স্কুলের। ১৮৮৪ সালে দ্বিতীয় শ্রেণি এবং ১৯০৮ সালে প্রথম শ্রেণির কলেজে উন্নীত হয় জগন্নাথ কলেজ। ২০০৫ সালে পরিণত হয় পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে। তবে ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর কিছুটা গুরুত্ব হারায় জগন্নাথ কলেজ। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পেছনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল জগন্নাথ কলেজের। এই কলেজের অনেক শিক্ষক চলে যান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এমনকি জগন্নাথ কলেজের লাইব্রেরির অর্ধেকের বেশি বই দেয়া হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে। কৃতজ্ঞতা স্বরূপ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের একটি হলের নামকরণ করে জগন্নাথ হল।
একসময় জগন্নাথ কলেজ ছিল চমৎকার আবাসিক সুবিধার একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। কালে কালে স্কুল থেকে কলেজ, কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে; আর তার সাথে পাল্লা দিয়ে কমেছে আবাসিক সুবিধা। কমতে কমতে এখন শুণ্যের কোঠায়। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এখন একটি সম্পূর্ণ অনাবাসিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। শিক্ষার্থীদের থাকার কোনো ব্যবস্থা নেই, নেই শিক্ষক-কর্মচারিদের কোনো আবাস সুবিধাও। রাজনৈতিক কারণে সংসদে আইন করে বিশ্ববিদ্যালয় করা হলেও বদলায়নি অবকাঠামো। সাড়ে ৭ এশর জমির ওপর প্রায় ২৫ হাজার শিক্ষার্থীর একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়! অবিশ্বাস্য। এই ২৫ হাজার শিক্ষার্থীর বেশিরভাগই ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় মেস ভাড়া করে থাকেন, কেউ কেউ আত্মীয়-স্বজনের বাসায় থাকেন। লজিং সংস্কৃতি এখন খুব চালু না হলেও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের অনেকেই লজিং থাকেন। অনেকে গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, কেরানীগঞ্জসহ দূর-দূরান্ত থেকে আসেন।
আমাদের সময়ে একাাধিক বন্ধুকে দেখেছি গাজীপুর-নারায়ণগঞ্জ থেকে এসে ক্লাশ করতে। একসময় জগন্নাথ কলেজের অবস্থান ছিল ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে। এখন পুরান ঢাকার যানজটপ্রবণ এলাকায় আড়ালে হারিয়ে যাওয়া এক নাম যেন। আমি নয়াপল্টনে থেকে জগন্নাথে পড়তাম। পুরানা পল্টন মোড় বা গুলিস্তান থেকে বাসে উঠতাম। সদরঘাট রুটে তখন সত্যিকারের মুড়ির টিনর মার্কা বাস চলতো। উপচেপড়া ভিড়ের সেই বাসে উঠতে আমাদের জীবনের ঝুকি নিতে হতো, নিতেই হতো, কারণ নইলে ক্লাশ বা পরীক্ষা মিস করার ঝুঁকি থাকতো। অনেকবার এমন হয়েছে বাসের দরজার রডে ঝুলে কোনোরকমে হাচড়ে-পাচড়ে পৌঁছেছি। পরীক্ষার হলে ঢুকে অন্তত আধঘণ্টা কলম ধরতে পারিনি। কারণ ঝুলে থাকতে থাকতে হাত অবশ হয়ে গিয়েছিল। রক্ত চলাচল স্বাভাবিক হওয়ার পর পরীক্ষা শুরু করতে পেরেছিলাম। একসময় পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় জগন্নাথ কলেজের সম্পত্তি ছিল। নব্বই দশক পর্যন্ত বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল বেশ কয়েকটি ভবন, যেগুলো ব্যবহৃত হতো ছাত্রাবাস হিসেবে। তার কোনোটিই আাসলে ছাত্রবাস ছিল না, একেকটা একেক জমিদারবাড়ি। বড় বড় সেসব বাড়িতেই ছাত্ররা থাকতো। কাগজে-কলমে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত ১২টি হলের নাম পাওয়া যায়। কিন্তু সবগুলোই দখল করে নিয়েছে স্থানীয় প্রভাবশালীরা। জগন্নাথ কলেজের প্রথম কার্যকর হল নির্মাণ করা হয় এরশাদ আমলে ক্যাম্পাসের পাশেই, নাম ছিল সম্ভবত এরশাদ হল। তবে এরশাদ পতনের পর অনানুষ্ঠিকভাবে এটির নাম বদলে হয়ে যায় ডাঃ মিলন হল। এই আধুনিক হলে থাকার সৌভাগ্য আমার হয়নি, সিট পাইনি। তবে বড় ভাইদের অনেকেই থাকতেন। তাদের রুমে অনেক আড্ডা মেরেছি, রাতে থেকেছি, দুপুরে খেতেও গিয়েছি অনেকবার।
২০০৫ সালে আইন করে বিশ্ববিদ্যালয় বানিয়ে দেয়ার আনন্দ মিলিয়ে যায় দ্রুত। মাত্র সাড়ে ৭ একর জমির ওপর ২৫ হাজার শিক্ষার্থীর একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় যে রাজনৈতিক অবিমৃষ্যকারিতা, তা বুঝতে সময় লাগেনি। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা ছিল জগন্নাথ কলেজের শিক্ষার্থীদের। কিন্তু গত কয়েকবছর ধরে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলন হলকেন্দ্রিক। হল পুনরুদ্ধার, হল নির্মাণের দাবিতে প্রায়শই আন্দোলন হয়। কিন্তু কোনো আন্দোলনেই কোনো কাজ হয়নি। বছর দুয়েক আগে হল আন্দোলন কাভার করে আসা আমাদের রিপোর্টার লিখলেন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি হলও নেই। আমি তাকে বকা দিলাম, না জেনে লেখেন কেন। আর কোনো হল আছে কি নেই না দখল হয়ে গেছে জানি না। কিন্তু মিলন হল তো বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজের, এটা কোথায় গেল? রিপোর্টার অনেকের সাথে কথা বলেও মিলন হলের অস্তিত্ব বের করতে পারেনি। এই দফা আন্দোলন শুরুর পর আমি আবার মিলন হলের সন্ধানে নামি। বর্তমান শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অনেকের সাথে কথা বলেও মিলন হল খুঁজে পাইনি। তারা জানেই না। আমাদের আমলের শিক্ষার্থীদের অনেককে ফোন করলাম। তারাও বলতে পারছে না। শেষ পর্যন্ত গুগল ম্যাপ খুঁজে, বর্তমান শিক্ষার্থীদের লোকেশন বুঝিয়ে যেটা আবিস্কার করলাম, মিলন হল এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন। কবে এর রূপান্তর ঘটেছে কেউ বলতে পারেনি।
সম্প্রতি পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোড থেকে কেন্দ্রীয় কারাগার সরিয়ে নেয়া হয়েছে কেরানীগঞ্জে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করছে, কারাগারের জায়গায় চার জাতীয় চার নেতার নামে চারটি হল নির্মাণের দাবিতে। কিন্তু কারাগারের জায়গা নিয়ে সরকারের পরিকল্পনা ভিন্ন। এখানে জাদুঘর হবে, প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট হবে আর হবে পার্ক। কেন্দ্রীয় কারাগারের খালি জায়গায় আরো কিছু ভবন নির্মাণ করে কংক্রিটের জঙ্গল আরো বাড়ানো হোক আমি চাই না। বরং আমি চাই, কেন্দ্রীয় কারাগারের জায়গায় সবুজ পার্ক বানানো হোক, এলাকাটি হয়ে উঠুক পুরান ঢাকার ফুসফুস। কিন্তু জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের চেতনার সাথে আমি দুইশ ভাগ একমত। ছাত্র-ছাত্রীদের আবাসনের ব্যবস্থা করতেই হবে। বিশেষ করে গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার পর শিক্ষার্থীদের মেস করে থাকা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে গেছে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিরাপদ আবাসন ব্যবস্থা করা অবশ্যই সরকারের দায়িত্ব। কিন্তু সরকার সে দায়িত্ব পালন তো করছেই না। উল্টো শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক আন্দোলন দমন করতে চাইছে পুলিশের শক্তিতে। এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক।
কোথায় হবে আমি জানি না। কিন্তু হল হতেই হবে। কেরানীগঞ্জে খালি জায়গায় হতে পারে, এমনকি হতে পারে ঝিলমিল বা পূর্বাচলেও। ২৫ হাজার শিক্ষার্থীর থাকার কোনো ব্যবস্থা না করেই আস্ত একটা বিশ্ববিদ্যালয় বানিয়ে ফেলা কোনো কাজের কথা নয়। দুর্জনেরা বলছেন, যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়টি বিএনপি আমলে হয়েছে, তাই আওয়ামী লীগ সরকার এর প্রতি যথাযথ মনোযোগ দিচ্ছে না বা দেবে না। আমি এই কথা বিশ্বাস করিনি, করতে চাইও না। আমি চাই ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি যুগের সাথে তাল মিলিয়ে সব ধরনের অবকাঠামোগত উন্নয়ন, শিক্ষার গুণগত উৎকর্ষে এগিয়ে যাক।
[email protected]
এইচআর/এবিএস