এই সমাজটাই কি নারীর জন্য ভুল গন্তব্য?
২৪ আগস্ট নিউজ পড়তে বসে ইয়াসমিনকে রিমাইন্ড করলাম। নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস নিয়ে একটা প্যাকেজ ছিল। ডেস্ক থেকে বানানো প্যাকেজ, প্রতিনিধির পাঠানো ছবিতে। নিউজরুমে প্রতিনিয়ত: টানটান উত্তেজনাতেও ইয়াসমিন হারিয়ে যায়নি এত বছরেও। প্যাকেজ চলাকালীন আমার নিউজরুমকে একটা ধন্যবাদ দিই মনে মনে। ইয়াসমিন তো নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে এদেশে একটা শক্ত ঝাণ্ডা। যে ঝাণ্ডা আমাদের আজও মনে করায় ভাস্কর চৌধুরীর সেই কবিতাটা, মানুষকে এতো ক্ষুদ্রার্থে নেবেন না বিভু, মানুষ এতো বড় যে আপনি যদি বোঝেন এবং উচ্চারণ করেন "মানুষ" তো আপনি কাঁদবেন!
৯৫ সালের ঘটনা। আমি তখন ক্লাস নাইন-টেন এ পড়ি। মানুষ কিন্তু জেগেছিল। এক দরিদ্র, সুবিধাবঞ্চিত, প্রান্তিক কিশোরীর জন্য সারাদেশের মানুষ একসূতোয় গেঁথেছিল নিজেদের। সেই সূতোর গাঁথুনিটা এখন আর দেখা যায় না তেমন। সামু, সিরাজ, কাদের নামে এখন আর কাউকে পাওয়া যায় না তেমন যারা অনাত্নীয় এক কিশোরীর জন্য পুলিশের গুলিতে জীবন দেবে। সেইসময়ও মনে আছে ইয়াসমিনকে যৌনকর্মী বলা হয়েছিল। সরকারের নানান যন্ত্র এই চেষ্টা করেছিল। এবং সম্ভবত তখনই প্রথম মানুষ জেগে উঠে বলেছিল, ইয়াসমিন যদি যৌনকর্মীও হয়ে থাকে তাকে ধর্ষণ করে মেরে ফেলার কোন অধিকার কেউ রাখে না।
ঢাকায় একটা বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ করতো ইয়াসমিন। বাড়ি যাওয়ার জন্য রওনা দিয়ে ভুল বাসে উঠে গিয়েছিল সে। পঞ্চগড়ের সেই বাসের হেলপার তাকে দশমাইল নামে একটা জায়গায় নামিয়ে দেয় ভোররাতে। এক চায়ের দোকানীর জিম্মায় দিয়ে তাকে দিনাজপুরের বাসে তুলে দিতে বলে। সেই দোকান থেকেই পুলিশ সদস্যরা ইয়াসমিনকে বাড়ি পৌঁছে দেবে বলে তুলে নেয়। পুলিশ ভ্যানেই চলে ধর্ষণ। এবং মৃত মেয়েটিকে ফেলে রাখা হয় রাস্তার পাশে।
দ্যাখেন, এই যে মেয়েটা ঢাকা থেকে এতোখানি পথ পাড়ি দিল, কত সাধারণ মানুষের সাথে তার দেখা হলো, এরা কিন্তু কেউ মেয়েটাকে ধর্ষণ করে নাই, মেরে ফেলে নাই। মারলো সরকারি উর্দি পরা লোকেরা। এবং তারচেয়েও বড় কথা, সেই ঘটনা মুছে ফেলার চেষ্টা করা হলো, প্রতিবাদে ফেটে পড়া সাধারণ মানুষদের ওপর গুলি চালালো পুলিশ। মারা গেল সাতজন। ইয়াসমিনরা কি চিরদিন ভুল বাসে ওঠে ভুল স্থানে যায়? ভুল করে কোথায় যায়? জঙ্গলে তো নয়। এই সমাজের মানুষের কাছেই তো সে বাড়ি পৌঁছানোর জন্য সাহায্য চেয়েছিল। পুলিশ মানে সরকারি বাহিনীর সদস্যদের শিকার হলো সে। এখন বলেন তো, ক্যান্টনমেন্ট কি ভুল কোন জায়গা? এতো সুরক্ষিত জায়গায় এই যে তনু হত্যা হলো আর সেই হত্যার উপর ক্রমাগত পড়তে থাকলো পলি, এইভাবেই এগিয়ে যাবে আমাদের সমাজ? সম্ভব সেটা কোনভাবে?
আফসানা কোন ভুল পথে গিয়েছিল? বলা হচ্ছে, ছাত্রলীগ নেতা হাবিবুর রহমান রবীনের সঙ্গে সে স্বামী-স্ত্রীর মতো থাকতো। কেউ বলছেন, বিবাহিত কেউ বলছেন প্রেমের সম্পর্ক। আফসানাকে মেরে ফেলে সারারাত তার পরিবারের লোকেদের থানা-হাসপাতাল ঘুরিয়ে লাশ দেওয়া হলো। যদি জোর আন্দোলন গড়ে তোলা যায়, তাহলে হয়তো আফসানার লাশ আবারও তুলে ময়নাতন্দন্ত করা হবে। কিংবা আর না-ও হতে পারে। কামদাপ্রসাদ সাহারে কপি করে ময়না তদন্তকারী চিকিৎসক ডা. শফি আগেই বলে দিয়েছেন, এইটা আত্মহত্যা। মামলা শেষ!
আমি বলি কি, ধর্ষণ কিন্তু শুধুই জৈবিক বিষয় নয়। এটা সামাজিক, রাষ্ট্রীক। পুরুষের ক্ষমতা আর হ্যাডম দেখানোর একটা উপায় হলো, ধর্ষণ। কিন্তু এরকম একটা ঘটনা ঘটলে, এই যারা বিচারটা করবেন তাদেরই সর্বশক্তি দিয়ে ঘটনা চাপা দেয়ার যে প্রবণতা- এ থেকে কি এদেশের মানুষের মুক্তি নাই? রবীন ছাত্রলীগের কোন মাপের নেতা? তাকে বাঁচাতে কেন প্রশাসনকে একটা স্পষ্ট হত্যাকাণ্ডকে ডাক্তারকে দিয়ে বলাতে হবে, এটা আত্মহত্যা? তনু, মিতু, আফসানা হত্যার বিচার হবে কি না আমরা জানিনা। আমাদের মিথ্যা আর ফাঁকা আশ্বাসের কথা প্রায়শই শোনানো হয়ে থাকে। বলা হয়, আস্থা রাখুন, সব হত্যার বিচার হবে। কিন্তু তার আগে যেসব কথাবার্তা বলা হয়, তদন্তের যে ধরনের রিপোর্ট দেওয়া হয়, রাষ্ট্রযন্ত্র যে বডি ল্যাংগুয়েজ দেখায়, তাতে ধর্ষক আর এই রাষ্ট্র ক্রমশই সমার্থক হয়ে উঠতে থাকে।
লেখক : সিনিয়র রিপোর্টার, ডিবিসি নিউজ
এইচআর/এমএস