একুশে আগস্ট ও বিএনপির রাজনীতি
বাংলাদেশকে পাকিস্তানের অংশ বানানোর জন্যে যুদ্ধ চলাকালে প্রবাসী সরকারের মন্ত্রী থেকেও খন্দকার মোশতাক এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ আমলা মাহবুব আলম চাষী চেষ্টা চালিয়েছিলেন। সে চেষ্টা প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের দূরদর্শিতা ও ভারতীয় উপদেষ্টাদের সহযোগিতায় ব্যর্থ হয়ে যায়। ১৯৭৫-এ মোশতাককে শিখণ্ডি হিসেবে সামনে রেখে এদেশের পাকিস্তানিচক্র বঙ্গবন্ধু এবং তাজউদ্দিনসহ জাতীয় নেতাদের হত্যা করে ক্ষমতা দখল করে নেয়। এই চক্রান্তের সাথে সামরিক বাহিনীর উপ-প্রধান মেজর জেনারেল জিয়ার সম্পৃক্ততা নিয়ে জোরালো সন্দেহের কারণ আছে। কারণটা আর কিছুই নয়, বঙ্গবন্ধু হত্যার দিনে জিয়ার ভূমিকা, কিছু মন্তব্য এবং বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় নেতাদের হত্যাকারীদের প্রতি তাঁর তোষণ ও পোষণমূলক ভূমিকা। জিয়া সন্দেহের ঊর্ধ্বে থাকতে পারেন না।
পরবর্তীকালে জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় বসে দেশে পাকিস্তানি ধারার সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ফিরিয়ে এনেছিলেন। বলা হত, দেশকে তিনি মিনি পাকিস্তান বানিয়েছেন। তিনি আইউব খানের মতই গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে সামরিক স্বৈরাচার ছিলেন। পাকিস্তানি কায়দায় ক্ষমতায় যুক্ত করলেন সামরিক বাহিনী, সরকার পরিচালনায় সামরিক গোয়েন্দাদের ভূমিকা হল গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর সময় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত হল। তাঁর পরে জেনারেল এরশাদও একই ধারায় দেশ শাসন করে গেছেন।
নব্বইয়ের পরে প্রথম সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে বেগম জিয়ার নেতৃত্বে যে বিএনপি ক্ষমতায় এলো তার রাজনীতিতে কোনো গুণগত পরিবর্তন আসে নি। জিয়ার অনুসৃত রাজনীতিই তাঁরা করে গেছেন। তবে ২০০১ সনে জামায়াতের সাথে জোটবদ্ধ হয়ে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পরে বিএনপি কেবল পাকিস্তানি সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নয়, এবারে পৃষ্ঠপোষকতা দিল জঙ্গি ও ধর্মীয় মৌলবাদীদের। এরা আফগান, কাশ্মীর, প্যালেস্টাইনের যুদ্ধে অংশ নিয়ে বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠীর সাথে কাজ করার অভিজ্ঞতা সম্পন্ন। বিএনপির কিছু নেতার পৃষ্ঠপোষকতায় এইসব জঙ্গি দ্রুত তাদের শক্তি বৃদ্ধি করেছে। এটাও দেশে ওপেন সিক্রেট ছিল যে জিয়ার আমল থেকেই দেশে পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই গোপনে তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছিল। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ করে স্বাধীন হওয়া দেশে তাদের সামরিক গোয়েন্দাদের অবাধে কাজের সুযোগ দেওয়া হল। তারাই এদেশে জঙ্গিবাদ সৃষ্টির পেছনে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছে।
স্বভাবতই জঙ্গিবাদ ও মৌলবাদ কেবল বিএনপির রাজনীতিতে সন্তুষ্ট থাকবে না। এমনকি জামায়াত নিয়েও তাদের সন্তুষ্টির কোনো কারণ নেই। তারা এখন কাজ করছে আইএসের মতাদর্শে ইসলামি খেলাফত প্রতিষ্ঠার জন্যে। তাদের প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক শক্তি আওয়ামী লীগ আর সামাজিক শক্তি হল মুক্তচিন্তার মানুষ। তারা এ দুটিকেই টার্গেট করেছে। এক সময় বিএনপি ক্ষমতায় থেকে আওয়ামী লীগকে দুর্বল করার জন্যে এদের তৎপরতাকে সমর্থন দিয়েছিল। এই সময়েই আওয়ামী লীগ প্রধান ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জীবননাশের জন্যে একে একে তিনবার হামলা হয়। সবচেয়ে জোরালো হামলা ছিল একুশে আগস্টের গ্রেনেড সন্ত্রাস যাতে দলের ২৪ জন নেতা-কর্মী নিহত হন এবং অসংখ্য কর্মী গুরুতরভাবে জখম হন। এই আক্রমণ প্রথম থেকে যেভাবে সরকারি চেষ্টায় ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা চলেছে তাতে বিএনপির ভূমিকা ও সম্পৃক্ততা নিয়ে সন্দেহ ঘনীভূত হয়। এই মামলায় একাধিক বিএনপি নেতা অভিযুক্ত ও কারারুদ্ধ আছেন। দশ ট্রাক অস্ত্র মামলার কথাও জাতি ভোলে নি।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড ও জাতীয় নেতাদের হত্যার পরও বাংলাদেশ তার হারানো আদর্শ খোঁজার সংগ্রাম চালিয়েছে এবং বলা যায়, আজ খুঁজেও পেয়েছে। তাই বঙ্গবন্ধুর কন্যা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের গণতান্ত্রিক শক্তির প্রধান নেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রাণনাশের চেষ্টাতেও এই শক্তি ক্ষান্তি দেয় নি। বিএনপি আবারও সন্দেহের ঊর্ধ্বে থাকতে পারে না একুশে আগস্টের হামলার ব্যাপারে। এটা জাতির জন্যেও এক দুর্ভাগ্যের বিষয়। গণতান্ত্রিক ধারা সুষ্ঠুভাবে চালাতে গেলে অন্তত দুটি রাজনৈতিক দল সক্রিয় থাকা দরকার। কিন্তু এটা এখনও স্পষ্ট নয় যে বিএনপি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বা বাংলাদেশের স্বাধীনতার আদর্শে বিশ্বাসী কিনা। এ বিষয়ে তাদের ভূমিকা স্পষ্ট হবে যদি প্রথমত, জামায়াতের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে এবং দ্বিতীয়ত, পনের আগস্ট ও একুশে আগস্টের ঘটনাবলি সম্পর্কে দলীয় অবস্থানের সন্তোষজনকভাবে ব্যাখ্যা দেয়।
বাংলাদেশে যদি কোনো কারণে জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদ সফল হয় তবে কার্যত আওয়ামী লীগের মতই বিএনপিও টিকতে পারবে না। জামায়াত ও এদের তোষণ করে বিএনপি আখেরে লাভবান হবে না, কারণ উভয়েরই লক্ষ্য হল কট্টরপন্থী ইসলামি রাষ্ট্র কায়েম। সে কাজে বিএনপিও শেষ পর্যায়ে তাদের কাছে প্রতিপক্ষই গণ্য হবে। তাই বিএনপির জন্যে রাজনীতির সঠিক রাস্তা হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় থেকে আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ হওয়া।
সেক্ষেত্রে ছাত্রলীগ-যুবলীগ ও ক্ষমতাসীনদের অন্যান্য স্থানীয় নেতা-কর্মীদের দখলদারি-মাস্তানি-লুটপাট ও ক্ষমতার অপব্যবহার এবং ব্যাংকের ঋণখেলাপিসহ আর্থিক দুর্নীতি, ক্রসফায়ার ইত্যাদি নানা ইস্যুতে নাগরিক সমাজের বিক্ষোভকে রাজনৈতিকভাবে কাজে লাগাতে পারত। এতে ক্ষমতাসীনদের অন্যায় সম্পর্কে জনগণের যুক্তিযুক্ত প্রতিবাদ জোরালো হয়ে সরকারের টনক নড়বে, দেশেরও লাভ হবে। গণতন্ত্রও হবে শক্তিশালী। আদতে দেশে দুর্নীতি, উন্নয়নের ভ্রান্তনীতিসহ জনস্বার্থের কত ইস্যুই তো রয়েছে যা নিয়ে রাজনৈতিক প্রতিবাদ হওয়া উচিত। বিএনপি সেদিকে কোনোই নজর দিচ্ছে না। অথচ এতে অতিষ্ঠ মানুষ যে বিকল্প রাজনীতির সন্ধান করছে তার খোঁজ পেত। জানি না, বিএনপি নেতৃত্ব কেন রাজনীতির এই সহজ পথটি গ্রহণ করে না।
লেখক : কবি, সাংবাদিক, চিন্তাবিদ
এইচআর/পিআর