ভিডিও EN
  1. Home/
  2. মতামত

১৫ আগস্ট : জাতীয় শোক দিবস এবং লজ্জিত হওয়ারও দিন

প্রকাশিত: ১১:৪৭ পিএম, ১৪ আগস্ট ২০১৬

১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে যখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতা গ্রহণ করে এবং সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার শুরু হয় তখন অনেক বিজ্ঞজনকেই বলতে শুনেছি যে, এতোদিন পরে ক্ষমতায় এসে কোথায় দেশ চালাবে, তা না করে নিজের বাবা-মা হত্যার বিচার নিয়ে পড়েছেন শেখ হাসিনা। এমনকি এই কথাও বলেছেন কেউ কেউ যে, শেখ হাসিনা পিতা হত্যার প্রতিশোধ নিয়ে ব্যস্ত, দেশ চালাবেন কখন? এই মানসিকতার মানুষের এখনও যে অভাব নেই, সে কথাতো বলাই বাহুল্য।

যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু হওয়ার পর থেকে আমরা শুনেছি যে, এতোদিন পরে এই বিচার কেন হচ্ছে? আন্তর্জাতিক মান সম্পন্ন হচ্ছে কিনা? বিচার চাই কিন্তু এভাবে নয় কিংবা এই কাদের মোল্লা/সাঈদী সেই কাদের মোল্লা/সাঈদী নয় ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু যে মূল প্রশ্নটি আমরা জাতিগতভাবে সব সময়ই সচেতনভাবে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছি তা হলো, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কি কেবল শেখ হাসিনা বা শেখ রেহানার পিতা ছিলেন? তিনি তো একটি জাতির নির্মাতা, তাই নয় কি? নাকি এ কথাও অস্বীকার করার মতো লোকের অভাব নেই এদেশে?

বাকি যে প্রশ্নগুলো আমাদের উচ্চারণ করার কথা কিন্তু আমরা সেসব ভুলেও তুলি না সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো, ধরে নিচ্ছি যে, শাসক শেখ মুজিবকে অনেকেই গ্রহণ করতে চাননি, কিন্তু সে জন্য তাকে হত্যা করার অধিকার কারো আছে কি? এমনকি শেখ মুজিবকে হত্যার সঙ্গে সঙ্গে তার পরিবারের সদস্যদের এমনকি তার শিশুপুত্রকেও কেন খুন করা হয়েছিল? কোন সে রাজনৈতিক কারণ ছিল এই দীর্ঘ লাশের সারির পেছনে? আরো বড় প্রশ্ন হলো, শেখ মুজিবকে হত্যার মতো ঐতিহাসিক ও জঘন্যতম অপরাধের পর হত্যাকারীদের দেশে-বিদেশে রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধি হিসেবে চাকরি দিয়ে পুরষ্কার করার পেছনে যুক্তি কি?

ইনডেমনিটি দিয়ে খুনিদের বিচারের পথ রুদ্ধ করা হয়েছিল কেন? আর কেনইবা শেখ মুজিব হত্যার পর থেকে এ পর্যন্ত কারণে-অকারণে তার রাজনৈতিক চরিত্র হনন করা হয়? কেনই বা দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দলের কর্তা ব্যক্তিরা গত একচল্লিশ বছর ধরে আমাদের জাতি ইতিহাসকে বিকৃত করার জন্য কেবলমাত্র শেখ মুজিবকেই বেছে নিয়েছেন?
 
এ রকম হাজারো প্রশ্ন উত্থাপন সম্ভব, আজকের দিনে অর্থাৎ ১৫ আগস্টের এই দিনে এসব প্রশ্ন উত্থাপন অত্যন্ত সঙ্গত এ কারণেই যে, বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে একচল্লিশ বছর আগে, তারপর এদেশের উপর দিয়ে ঝড়-ঝাপ্টা কম যায়নি, কিন্তু এতো কিছুর পরও এদেশের যদি কিছু অর্জন থেকে থাকে তাহলে এটাই অন্যতম অর্জন যে, বাঙালি জাতির পিতাকে হত্যার বিচার এদেশে হয়েছে কিংবা অন্যভাবে বলতে হয় যে, এদেশে একজন রাষ্ট্রপ্রধানকে হত্যার বিচার করা হয়েছে। যার মাধ্যমে এটা অন্ততঃ প্রমাণ করা গেছে যে, এদেশে সামান্য হলেও আইনের শাসন রয়েছে এবং হত্যাকারীরা আসলে শেষ পর্যন্ত পার পায় না।

কিন্তু এই একচল্লিশ বছরে যে চারটি নতুন প্রজন্ম এদেশে তৈরি হয়েছে তারা কি সত্যিই জানে যে, বঙ্গবন্ধুকে তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে হত্যা করা আসলে কেবলমাত্র কয়েকজন বিপথগামী সেনা সদস্যের কাজ ছিল না, এর পেছনে ছিল একটি নবীন জাতিকে পিতৃহীন, অভিভাবকহীন করে তোলার সম্পূর্ণ আয়োজন? আমার মনে হয় না, এই কাজটি করা সম্ভব হয়েছে, কারণ এই সেদিনও এক ঘরোয়া আয়োজনে একজন বাঙালি পুঙ্গব বলতে চাইছিলেন যে, শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছিল তার শাসন ব্যবস্থার ত্রুটির কারণে। এখানে যতোটা ভদ্রভাবে বাক্যটি বলতে পারলাম, ভদ্রলোক ঠিক ততোটা ভদ্রভাবে কথাটা বলেননি, আমার বিশ্বাস এই লেখার অনেক পাঠকেরই এমনতর ব্যক্তির সঙ্গে নিয়মিত দেখা হয়। নিশ্চয়ই এমন কোনো ব্যক্তির সন্তানের পক্ষে এ কথা জানা মোটেও সম্ভব নয় যে, শেখ মুজিবকে হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক চরিত্রকেই বদলে ফেলা হয়েছিল?

খুব সাধারণভাবে অনেককেই বলতে শোনা যায় যে, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে বাকশালের জন্য এবং বাকশাল সম্পর্কিত যতো অপপ্রচার রয়েছে সেই সঙ্গে সেসবও তুলে ধরা হয়। অথচ ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালে বাকশাল অফিশিয়ালি প্রণীত হয়নি, ২৩ আগস্ট বাকশাল কার্যকর হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু তার আগেই বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছিল। তাহলে পাল্টা প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই উঠে আসে যে, বাকশালে কি এমন কিছু ছিল যা আসলে বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু-বিরোধীদের জন্য ভয়ের কারণ হতো এবং সে কারণেই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছিল? আগেই বলেছি, আমরা জাতীয়ভাবেই এসব প্রশ্নকে এড়িয়ে যাওয়াটা পছন্দ করি এবং আমাদের জাতীয় মেধা বা মননে এমন ঘুণ ধরেছে যে, এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার দায় আমাদের কারোরই নেই। আমরা এমনই নিম্ন মেধার মানুষে পরিণত হয়েছি যে, আমরা একাধিক গলাকাটা লাশকে সামনে রেখে চিংরি মাছ রান্না করে সেহরি খাওয়া ব্যক্তি জঙ্গি কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিন পার করছি।
 
আমরা কি এ কথাও আসলে জাতিগতভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছি যে, ১৫ আগস্ট আসলে আমাদের সকলের জন্য একটি লজ্জার দিন? না পারিনি। পারলে, একটি প্রধান রাজনৈতিক দলের নেত্রী তার মিথ্যে জন্মদিন উদযাপনের জন্য এ দিনটি বেছে নিতেন না এবং নির্লজ্জের মতো শ’খানেক পাউন্ড ওজনের কেক কেটে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডকে উদযাপন করতেন না। তিনি আসলে দেশের সেই পক্ষটিকেই উস্কে দেন যারা মনে করেন যে, শেখ মুজিবকে হত্যার মাধ্যমে তাদের জন্য একটি সুযোগ উন্মুক্ত হয়েছিল, তারা এদেশকে লুটেপুটে খাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। যে কোনো হত্যাকাণ্ডই নিন্দার, তা তিনি বিখ্যাত কিংবা কুখ্যাত, যাই-ই হোন না কেন। কিন্তু কেবল মাত্র বাঙালি জাতির ক্ষেত্রে এই প্রতিষ্ঠিত সত্যের ব্যত্যয় ঘটেছে, এই জাতির একটি অংশ এখনও শেখ মুজিবের হত্যাকে বৈধতা দেওয়ার জন্য, এই হত্যাকাণ্ডকে উদযাপন করার জন্য তৎপর।

সুতরাং, আমরা আসলে ব্যর্থ হয়েছি, ১৫ আগস্টকে একটি লজ্জাকর দিন হিসেবে ইতিহাসে প্রতিষ্ঠিত করতে। অথচ কেবলমাত্র বঙ্গবন্ধুকে হত্যার জন্য নয়, একটি পরিবারকে এক রাতের মধ্যে নিঃশ্চিহ্ন করে দেওয়ার মতো বর্বরতা ঘটেছে এই তারিখে; একটি দেশ ও জাতির রাজনৈতিক চরিত্র বদলেছে এই হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে; একাত্তরের পরাজিত শক্তিকে এদেশের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে এই হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে -এসব প্রতিটি ঘটনাই যে একটি জাতির জন্য চরম লজ্জার সেটা উপলব্ধির মতো বোধও আমাদের মধ্যে আজও তৈরি হয়নি, এটা সত্যিই বিস্ময়কর। আমি নিশ্চিত যে, এখন দেশের শাসনভার আওয়ামী লীগের হাতে বলেই প্রতিটি টেলিভিশন চ্যানেলে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের এই দিনে বা জাতীয় শোক দিবসে নানাবিধ অনুষ্ঠানমালা প্রচারিত হচ্ছে, যদি ক্ষমতা অন্যদের হাতে থাকতো, তাহলে দৃশ্যপট অন্যরকম হতো।

আমরা কিন্তু ২০০১ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত দেখেছি, এই দিনটি জাতীয় দিবস হিসেবে পালিত হওয়া তো দূরের কথা, জাতীয় পত্রিকাগুলোতে পর্যন্ত শোক দিবসের বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশে অনীহা লক্ষ্য করা গেছে। এমনকি দু’একটি পত্রিকা ছাড়া জাতীয় শোক দিবস, বঙ্গবন্ধু বা বাঙালি জাতীয়তাবাদ নিয়ে কোনো লেখা প্রকাশেও অস্বীকৃতি জানিয়েছেন সম্পাকদকগণ। এইতো আমাদের জাতীয় চরিত্র, অন্যায়কে অন্যায় হিসেবে স্বীকৃতি না দেওয়ার পক্ষে আমরা সম্মিলিতভাবে দাঁড়িয়ে পড়ি। অথচ, এদেশেই জাতীয় দৈনিকে ক’টি টাকার জন্য পাকিস্তানের জাতীয় দিবসে বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশিত হয়, একে আবার অনেকেই মত প্রকাশের স্বাধীনতার প্রমাণ খুঁজে পান; সত্যিই বিচিত্র, নয়?
 
লেখার শুরুতেই যে প্রশ্নগুলো উচ্চারণ করেছি সে রকম অসংখ্য প্রশ্নের উত্তর খোঁজার দিন ১৫ আগস্ট, একথাও আগেই বলেছি। কিন্তু যে কথা বলতে চেয়ে আজ লেখাটি শুরু করেছি তা হলো, আজকে আসলে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবারের জীবিত সদস্যদের কাছে বাঙালি জাতির ক্ষমা চাওয়ার দিন। কারণ, এই দুই সদস্য জীবিত না থাকলে আমরা আসলেই জানতে পারতাম না যে, এদেশে হত্যাকাণ্ডের বিচার হতে পারে, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হতে পারে এবং জানতাম না যে, একাত্তরেও এদেশে আসলে বাংলাদেশ-বিরোধী, স্বাধীনতা-বিরোধী বাঙালির অস্তিত্ব ছিল এবং তারা পাকিস্তানিদের সঙ্গে মিলে অকাতরে বাঙালি নিধনে সহযোগিতা করেছে। আমাদের জাতি-ইতিহাস থেকে বঙ্গবন্ধুকে, তার অবদানকে, মুক্তিযুদ্ধকে মুছে দেওয়া হতো যদি না শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে বাঙালি জাতি-ইতিহাসকে আবার ফিরিয়ে আনতেন তার মূলধারায়। হ্যাঁ, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ আর শেখ হাসিনার বাংলাদেশে নিশ্চিত ভাবেই পার্থক্য রয়েছে কিন্তু সেটা পৃথিবীর সর্বত্রই ঘটে থাকে, স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই কোনো দেশ যে পথে হাঁটে কালের পরিক্রমায় তা থেকে সামান্য হলেও বিচ্যুতি ঘটে কিন্তু মূল সুরটা কোনো না কোনো ভাবে ঠিক থাকেই। বাংলাদেশেও শেখ হাসিনার কারণেই সে রকমটি সম্ভব হয়েছে।

আমরা কখনওই ধারণা করতে পারবো না যে, পিতা ও পরিবারের সকল সদস্যকে নির্মমভাবে হারানোর বেদনা কতোটা গভীর, আর সেই পিতা কোনো সাধারণ পিতা নন (যদিও তাতে কষ্ট কিছু কম হতো না), একটি জাতির জন্মদানকারী পিতা। আমরা কোনোদিনই শেখ হাসিনা বা শেখ রেহানার ভেতরকার ক্ষতকে উপলব্ধিতে ধরতে পারবো না। কিন্তু আজকের দিনে আমরা তাদেরকে এই কথা বলতেই পারি যে, আমরা লজ্জিত, আমরা আপনাদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করি, আপনারা এই দিনে আপনাদের পিতা ও পরিবারের সদস্যদের হারিয়েছেন ঠিক, কিন্তু আমরাও আমাদের জাতির পিতাকে হারিয়েছি, হারিয়েছি আমাদের জাতীয় চরিত্র এবং মূলধারার সংস্কৃতি, আমাদের বিসর্জনও কোনো অংশে কম নয়। হয়তো তারা কিছুটা হলেও এতে শান্তি পেতে পারেন। আর এই ক্ষমা চাওয়ার মাধ্যমে জাতি হিসেবে আমাদের পাপও কিছু হলেও হয়তো স্খালন হতে পারে, কারণ গত একচল্লিশ বছর ধরেই তো বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পাপের সঙ্গে আমাদের জাতির উপর জমেছে এই হত্যাকাণ্ডকে বৈধতা দেওয়ার পাপ, জাতি ইতিহাসকে বিকৃত করার পাপ আর জাতি-চরিত্র নষ্ট হওয়ার পাপ।

১৫ আগস্ট তাই জাতীয় শোক দিবসের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের লজ্জিত হওয়ার ও ক্ষমা চাওয়ারও দিন, সেটাও জাতীয়ভাবেই আমাদের করা উচিত।
 
ঢাকা, ১৫ আগস্ট, সোমবার, ২০১৬
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট
ই-মেইল[email protected]

আরএস

আরও পড়ুন